অ-কবিতার দিনে অ-ঘুম আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।
এমন সব অ-ঘুমের রাতে ভোরের দিকে ড্রইং রুম হতে পরিচিত মানুষের হাটার শব্দ আর কন্ঠ ভেসে আসে।
খুব ‌অস্থিরতা নিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকলেই দেখি-
বাবা ধীরলয়ে হাঁটতে হাঁটতে
আমার লেখা কবিতার বই পড়ছেন।


একই ভরাট কন্ঠের সেই চওড়া বুকের টানটান ছয় ফুটের লম্বা শরীর,
সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, কলপ দেওয়া কালো চুল- দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, বা’হাতে সেই পরিচিত সিকো ঘড়ি।


আমাকে দেখলেই হাসি মুখে তিনি একেকবার একেক কথা বলেন।


কখনো বলেন,
“ভুল হয়েছেরে, মস্ত বড় ভুল।
তোর ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়লেই শুধু শুধু বকতাম।
অথচ এসব বই পড়ে তুই কত্তো কিছু শিখেছিস,
আজকাল সুন্দর করে কবিতা লিখিস,
মানুষের জন্য লিখিস,
মাঝেমাঝে আমার কথাও থাকে।
আরকি জানিস?
সব বাবাদেরই একটা বড় দোষ,
তারা মনে করেন তারাই সংসারে সবচেয়ে বেশি জানেন।


নয়তো বলবেন,
কিসব আজেবাজে কবিতা লিখিস!


হয়তোবা বলেন,
এতো মন খারাপের কী আছে! আরেকদিন লিখিস, ঘুমোতে যা।"


এসব বলেই হাসতে থাকেন তিনি প্রতিবার।


এই হাসির শব্দ বুকে বাজতে বাজতে দূর মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসে।
আজানের শব্দে হঠাৎ করেই বুকে ধাক্কা দিয়ে
-বাবা হাওয়ায় মিলিয়ে যান।


তখন মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকি।
ভোরের বিরহী আকাশের দিকে তাকিয়ে
হঠাৎ দেখি অস্হির কিছু রঙবেরঙের শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাওয়ায় ভাসছে।
সেখান থেকে যখন যেটা দরকার টেনে নিই বুকে-
অ-কবিতার দিনে বুকে বাসা বাধে এক একটা পলাতক কবিতা।


সবাই বলে মৃত মানুষ ফিরে না!
আমার কেন যেন মনে হয়,
আমরা অনেক কিছুই জানিনা।
গত পনেরো বছর ধরে আমার মৃত বাবা আমার অ-সময়ে প্রতিবারই আমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেন।


যেদিনগুলোতে বাবার সাথে দেখা হয়
সেইদিনগুলোতে ফজরের নামাজের সময় খোদার কাছে প্রার্থনার সময় বলি,
-“খোদা, সকল বাবার কথা আমি জানিনা,
তবে আমার বাবা,
-সব কিছুই আমার চেয়ে বেশি জানতেন।”
——————————
রশিদ হারুন
২৬/০৫/২০২০
আমার পিতৃঋণ কবিতা সিরিজের শেষ কবিতা এটি। কেমন হলো জানিনা? ধৈর্য্য সহকারে পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।