পিতৃঋণ -১২
———————
খুব ছোট্ট বেলায়,
ঠিক মনে নেই তখন বয়স কত ছিলো আমার।
একদিন ব্লেড দিয়ে হাত-পায়ের নখ কেটে দিতে গিয়ে মা একটু অমনোযোগী হতেই
আমার আঙুলে হালকা ব্লেডের আঁচড় লেগে গিয়েছিল।
আর তাতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়তেই ব্যথা আর ভয়ে
আমি তীব্র স্বরে কাঁদতে শুরু করেছিলাম;
আমার দেখাদেখি মাও কাঁদতে লাগলো।
বাবা কাটা আঙুলে স্যাভলন লাগাতে লাগাতে বললো,
-“আমার ছেলেটা এত্তো বোকা কেন,
তুই না পুরুষ মানুষ,
ব্যাথা পেলেও পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।"
বাবার সেই কথা শুনে
তারপর আমি হঠাৎ করেই যেন সেদিন সে‌‌ই শৈশব বেলাতেই পুরুষ মানুষ হয়ে গেলাম!
তারপর আমি অনেক বছর আর কাঁদিনি,
পেট ব্যাথা, ক্ষুধা, অপমান, অবহেলা,
কোনো কিছুতেই কাঁদিনি একবারের জন্যেও।
বাবা বলেছেন -পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই
তাই আমিও কাঁদতাম না।
কয়েক বছর পর যেদিন বড় বোনের বিয়ের রাতে বাবাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না,
খুঁজতে খুঁজতে ছাদের সিঁড়ির ঘরে গিয়ে দেখলাম আমার বাবা নিরবে কাঁদছেন,
আর বিড়বিড় করে বড় বোনের নাম ধরে ডাকছেন!
চাঁদের মায়ার আলোতে বাবার চোখের জল চিকচিক করছিলো তখন,
আমি শুধু নিরবে চলে এসেছিলাম।
সেদিন বুঝলাম পুরুষ মানুষও কাঁদে,
রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে।
আবার মা যখন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল,
বাবাকে দেখতাম হাসপাতালের মার  বিছানায় পাশে বসে নিরবে কাঁদতে।
মা যেদিন মারা গেলো,
বাবাকে এই প্রথম দেখলাম চিৎকার করে কাঁদতে।
সেদিনও আমি কাঁদিনি,
শুধু চুপ করে বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে
আকাশের মেঘে  মেঘে শুধু মাকে খুঁজছিলাম।
মা মারা যাবার পর প্রায়ই রাতে বাবার কান্নার শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যেতো,
একদিন কি মনে করে বাবাকে বলে ফেললাম,
-বাবা, পুরুষ মানুষের এভাবে কাঁদতে নেই।
বাবা খুবই আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল অনেকক্ষণ।
এরপর থেকে বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন
শব্দ করে আর কোনোদিনই কাঁদেনি।
অনেকদিন পর আমিও একদিন চিৎকার করে কাঁদলাম,
যেদিন আমার বাবা পনেরো দিন হাসপাতালের বিছানায় থেকে
অচেতন অবস্থা থেকে আর ফিরলোনা,
সেদিনই আমার সারা জীবনের জমানো কান্না
একসাথে বুক থেকে বের হয়ে আশেপাশের সবাইকেও ভিজিয়ে দিচ্ছিলো।
হঠাৎ আমার এগারো বয়সের ছেলে আমাকে সেই সময় কান্নার জল থেকে টেনে তুলে বললো,
-“বাবা, পুরুষ মানুষের এভাবে কাঁদতে নেই”।
আমিই হয়তো কোনো একদিন আমার ছেলেকে এই একই কথা বলেছিলাম আমার বাবার মতো করেই,
- পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।
———————————
রশিদ হারুন
র শি দ  হা রু ন
০১/১০/২০২০