তখন আমার বয়স কত হবে আর,
মনে আছে তোমার?
আমার কিন্তু ঠিক মনে আছে,
ষোল বছর দুই মাস চারদিন।
আর, তোমার বোধহয় একুশের মতো ছিলো।
আশ্চর্য এভাবে কেউ বলে - আমাকে নাকি তোমার ভালো লাগে!
আমার কথা ভাবতে গিয়ে তোমার প্রায়ই রাতে ঘুম হয়না।
এভাবে কেউ যে ভালোলাগার কথা বলতে পারে
আমি তখনও জানতাম না!
আমাদের তেতলা বাড়ির রেলিংবিহীন ছাদে দাঁড়িয়ে
কাপড় রোদে দিতে গিয়ে আচমকা তোমার এই কথা শুনে
সেদিন আমি আরেকটু হলে‌ই ছাদ থেকেই পড়ে যেতাম।
কেউ ভালো লাগার কথা বললে,
উত্তরে ঠিক কী বলতে হয় তখনও আমি জানতাম না।
আমার জানার কথাও না,
সে বারই তো প্রথম শুনলাম।
তাই প্রত্যুত্তরে আমি কিছুই বলতে পারিনি,
আমি শুধু বুঝতে চেয়েছিলাম এই ভালো লাগার মানে,
তোমার রাতের ঘুম না হওয়ার মানে।
তোমার এই ভালো লাগার মানে বুঝতে আমার যতটুকু সময় দরকার ছিলো,
তুমি কিন্তু আমায় দিলেনা,
তোমার একটুও তর সইছিল না
তক্ষুনি উত্তরে কিছু বলতে হবে,
আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়।
সে‌ই যে গেলে জীবন থেকে,
আর খোঁজও নাওনি কোনোদিন আমার,
তুমি রাগ করে চলে গিয়েছিলে,
অভিমান করে গেলে হয়তো ফিরতে আগের মতো করে।
সেদিন কিছু একটা জবাব দিতে না পারার যে গ্লানি আর হাহাকার,
সেটা আমাকে সারাজীবন টানতে হয়েছে,
না ঘুমিয়ে থাকতে হয়েছে হাজার রাত।
প্রায় দুই যুগ পর এভাবে দেখা না হলেই হয়তো ভালোই হতো দু’জনের;
সেদিন বিয়ে বাড়িতে তোমাকে দেখে আমি না চিনলেই পারতাম।
আমি লজ্জাহীনভাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলে ফেললাম তোমার সাথে,
আবার বিদায়ের সময় তোমার ফোন নাম্বারটা কেন যে নিলাম,
তাও বুঝলাম না!
হয়তোবা আমার অপরাধবোধ ছিল কিছু এই বুকে সারাজীবন ধরে,
-দুই যুগ আগে সেদিন উত্তরে তোমাকে ‘হ্যাঁ’ বলতে না পারার গোপন অপরাধবোধ।
অনেক কাল পর সেই রাতে বোধহয় ঠিকমতো ঘুমালাম।
তারপর অনেকবার দেখা হলো দু’জনের কারণে অকারণে।
সুযোগ পেলেই তুমি সেই তেতলা বাড়ির গল্প করতে করতে আমাকে আবার সেই ষোল বছরে নিয়ে গেলে।
আমি না বুঝে নিজেকেই নিজে ফাঁকি দিয়ে কখন যে তোমার জন্য পুষে রাখা পুরনো ষোল'র সেই হাহাকারটা
আবার নতুন করে এই বুকে উড়তে দিলাম একটুও টের পেলাম না।
এবার যখন টের পেলাম
তখন অনেক দেরি হয়ে গেলো
আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম।
সবা‌ই যদি জেনে যায়,
তাহলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে আমার এই গোছানো সংসারে।  
আমার  একান্ত ষোল'র এই উড়াল হাহাকার যখন তুমিও পুরোপুরি টের পেলে,
তুমি আমায় একটু বাজিয়ে দেখলে,
চল্লিশের এই হাহাকার সত্যি কিনা।
তুমি আমাকে আশকারা দিলে,
ইঙ্গিত দিলে, আশা দিলে
আমার সাজানো জীবনে সেই ষোল'র পুরনো হাহাকার ফিরিয়ে দিলে বুকের ভিতরে ঝড় উঠিয়ে আরেকবার এই চল্লিশে।
আর দিলে ভালোলাগার এক গোপন ভয় এই বুকে।
এরই মাঝে একদিন হঠাৎ করেই
বুকের মাঝে আমি টের পেলাম,
তুমি আমাকে বাজিয়ে দেখছ
তোমার এই পড়তি বয়সে পাকা খেলোয়াড়ের মতো।
আমি এখন শুধুই তোমার অবসর সময় কাটানোর খেলনা
আর তোমার মনের মধ্যে গোপন অহংয়ের শোধ তোলা।
সেদিনকার সেই ষোল'র আমি তোমাকে হ্যাঁ বলতে না পারার তুমুল প্রতিশোধ নিলে তুমি আমার চল্লিশে।
সুতোকাটা ঘুড়ি আসলে কখনো অক্ষত ভাবে নাটাইয়ে ফিরে না
-ফিরলে ফিরে ছিড়ে যাওয়া কাগজ আর তার আবছায়া।
তুমি যদি ভেবে থাক তুমি জিতে গেলে,
তাহলে ভুল ভেবেছ।
দু’জনেই হারালাম।
পার্থক্য একটাই,
আমি না বুঝে হেরেছি আমার ষোলতে
আর তুমি বুঝেশুনে হারলে তোমার পড়তি বেলায়।
————————————
র শি দ  হা রু ন
০২/১১/২০২০