দূরতম-দিন,
ছায়ার পাশাপাশি ছায়া
হেঁটে গেছে প্রাচিন রমণীরা;
পুত্রের কানে বাজে মসগুল পথিকের সুর
মা বুঝি সেই পথিক
আমি যেন তার সহচর ---বিব্রত শ্রোতা এক,
আমার জন্ম কোনো সুবহেসাদিকে
মায়ের কোল থেকে আরেক কোলে।
শূন্যস্থান পুরনের নিমিত্তে এ জন্ম ব্যবধান,
যেন যাযাবর জাতি এক
ক্লেশে নুয়ে গেছে সর্দার
অথবা নিখোঁজ সংবাদ কবেকার ----
দ্যাখিনি অনেকের মত শুনেছি
রূপের মহাল,
আর অন্ধ মাতামহের জানালায়
কাটিয়ে দিয়েছি বেরহম সময়
নিয়ম বলে জানালায় চোখ রাখো
আর আকড়ে ধরো তারে,
যেন যা দেখছো সে সবে মিশে না যাও,
অথচ মাতামহের ব্যবহার্য জানালায়
স্পর্শ বাঁচিয়ে দেখেছি মেদুর সন্ধ্যা
সাক্ষী সে প্রাচীন গাছ গুলি
যদিও তারা আর নেই মনে হয়
যেমন থাকেনা সে সকল মানুষ
যারা গেছে পাঁচ, দশ,পঁচিশ, আরো আগে,
কোন এক বর্ষায়,
কোন এক শীতে,
কোন এক কুরবানি ঈদে ----
প্রথম মউয়তের স্মৃতি অথবা
মৃত্যু যেন এক আশ্চর্য উৎসব হয়ে
হাজির শিশুর চোখে;
আমি তো ছিলাম সে জানালায়
গেরস্থ ঘরের যাবতীয় অনুদান নিয়ে
গবাদিপশুর চোনার মিহি শব্দ
সন্ধ্যা-বাতি,লালা চা,খড়ের ধোঁয়ায়;
এক পক্ষকাল ক্রমাগত বৃষ্টির সমাগম
আর পাখি-চক্ষুর আড়ালে মানুষ
ক্রমাগত গৃহবন্দি থেকে
কানে বাজায় পকেট রেডিওর পোষা ডাক।
দ্বাদশ বর্ষে ফিরে আসে গান,
ফিরে ফিরে শুনি কালজয়ী স্বর
হাওয়ায় ছুড়ে বালকের চাবুক
খুলে যায় ছায়ার আলমারি
লৌহ মুলুকে ---
কে ডাকে ফোরাত ফোরাত!
চৈতালি মাঠের ওপারে নদী,
ভেলার রেসেপি নিয়ে কোথায় সাগরেদ
দূর প্রাচ্যে থেকে ডাকে তুলাতলি স্বরে,
পরিচিত নদীর মত --- ফোরাত ফোরাত!
অথবা আম্মাই এমন সফল বিলাপ
ছুড়ে ছিল সন্ধ্যার আগে পিছে;
গৃহস্থ মাতামহীরা যখন বুনে ছিল
সরীসৃপ বীজ বৈশাখের সফল দিনে
কোমল সুতানড়ি সাপের মাচায়
ফি বর্ষায় দুলে কুমারীর স্তনবোটা;
আউষ চালের ফ্যান হাতে নিয়ে
কিশোর ফেরেস্তা ভাবে এই বৃদ্ধা
হুরদের হাতে আর কতই না মেওয়া
আর আবে জমজম আছে;
আর বৃদ্ধারা এ ঘর ও ঘড়ে যায়
ফেতনার ব্যাপ্তি ভুলে
তুলে নেয় বাটনার  শিলনোড়া,
হলদে সালুন রাঁধে আর বলে
বিয়ানো দুধেল গাইয়ের বাটে
দুধরাজ সাপের চুমু -----
পুত্রেরা বেঁধে দেয় খোয়াব কবচ আর
খোদার রহমে থাকে গৃহস্থ দুধভাত।
নিকানো পাছ দুয়ারে ভাঙা হাটের মত
উনুনের আচ কমে এলে
বৃদ্ধা মাতামহী সুললিত স্বরে পাঠ করে
আসমানি সওয়াল জওয়াব,
অথচ তারে কত আদবে ডাকতো যারা
তারা চলে গেছে নদী ওপারে
ভরা তুলাতলি তীরে ------
করিম বয়াতির লাশের খবর ভাসে!
তার বুকের গভীরে নায়ের গলোই
কোমরের গামছা খানা পাগলা বউয়ের
তবু সেই গাজী বাহাদুর
জিয়রতের দিনে, কুরবানি আসে তার,
গাজীর নামে পাঞ্জা লড়াই তুলে,দেখে
মৃত্যুর যেন  ইস্পাতের ফণার ঝিলিক
তুলাতলী জলে ভাসে বয়াতির শেষ পয়গাম;
তারপর শেষ গান নেমে আসে বর্ষার গাঙ্গে
বর্ষাই বুঝি পৃথিবীর শেষ ঋতু ------
বৃষ্টি শেষে বালিকারা প্রথম
ঋতুবতী হলে আমরা বিগলিত হই,
লায়েক বয়সে গিবত শিখেছি
আর নারীর ভিতরে দেখা হলে দুজনে
হাত বাড়িয়ে তুলেছি দীর্ঘ পরিচয় ;
মাতুল বোনেরা গেয়েছে প্রার্থনা সংগীত,
দুর্লভ ফল হাতে গুঁজে
তারা শিখায়েছে ভাগ করে খেতে হয়
যেন ইভ আর আদম যুগ -----
উজ্জ্বল দুচোখ বেয়ে উঠানে নেমেছিল
চার জন দেবদূত বলেছিল ঈশ্বরের শপথ
আমরাই পৃথিবীর শেষ বান্ধব!
আর আম্মাদের ডাকে ছিটকে গেছি
চার জন চার দুয়ারে
যেন কক্ষ পথে মিলে ছিল
প্রিয় নক্ষত্র-রাজি
এ শতাব্দীর দূরতম অঙ্গিকার নিয়ে,
কত দূরের দুয়ারে আছে সেই
নাম ফলক --- সোনালী কড়া,
কেই বা রেখেছে কারে আর মনে
বন্দরে বন্দরে ঘুরে
ফিরে যাবো এক নরম বিকেলে,
ফিরে যাবো আশাতীত সুমহান নিরবতা নিয়ে
রুগ্ন ক্লান্ত বাগানের পথ ধরে,যেখানে
প্রাচীন বালক বালিকারা দেখে ছিল
জলের প্রপাত
আর ভেসে ছিল দাড় টানা নৌকায়,
কে বলে ফিরে আয় নূহের কবল থেকে
কে দেখায় কদম-রসূল!
দৌড়ায় দুই শার্দূল
বাজির ঘোড়া যেন তারা
পৌঁছাবে তুলাতলি চরে,
কদম রসূলের চিমনির ধোঁয়ার আগে পরে
কে পৌঁছায় আর কে বাজি হারে
আমি কি ছিলাম তবে জ্বরের ঘোরে!
পায়রার খোপে খোপে চৈতালি রাত
বালিসে কাগজী লেবুর ঘ্রাণ ----
বড়-পুকুরে এক দিন ভেসে ভেসে
ডুবে গেছে মজনুর এক পাটি জুতা
আমি জ্বরের জামা গায়ে দেখেছি
কথা বলা মৎস মানব
ভুলে গেছে তার মাতৃভাষা ;
বাতাবী লেবুর  ঘ্রাণ মাখা
রমণীর কোলে শৈশব ছায়া
যেন আমি এক মেলায় হারানো ছেলে -----
পথ ভুলে চলে গেছি পৃথিবীর শেষ শহরে;
দেখেছি তরুনীর সবুজ ওড়নায় বাঁধা
গোপন কথার ঠিকানা -----
বাতাস কেটে উড়ে গেছে তার
ময়ূর মুখ নিরবতা ---অন্য কোথাও;
যেন ঝড় শেষে ফিরে আসে সমস্ত পাখি,
আমরা রেখেছি গেঁথে বিস্তর কথার বিভব
পাতারা ঝড়ে যায় পাখিদের অসুখে
মহামারি শেষে সমস্ত গাছের সংসারে
আবারো বসন্ত আসে -----
আমাদের দরজায় লেখা আছে
গাছেদের রুগ্ন ইতিহাস;
কথা বলা অন্ধ গাছটি
শুয়ে আছে মাটির শিথানে
তারে বলো শুকরানা শেষে কেউ
ফেরেনি ঘরে ----
কাঠবাদামের ডালগুলো যেন কারো
শোক ভারে নুয়ে ছিল বিরাশি বছর
পৃথিবীর শেষতম ঝড়ে কেঁপে ছিল
তার বাস্তুকলা,
কামিনি ফুলের ঝুলবারান্দা থেকে দেখেছি
প্রাচিন নারীদের দৈন্যদশা,
আমিও ঘুমিয়েছি তার অন্ধ জঠর গুহায়
যেন এক ভীতু জন্তুজাত শরীর
পাথুরে ফাঁক গলে ছুটে গেছি
পৃথিবীর শেষ শহরে,বিনিময়ে রেখে গেছি
কামিনী ফুলের ঘুম,রূপান্ধ পাখির ঠোঁটে
ডুমুরের ঘ্রাণ;
বেদের বহর থেকে পালানো
সোনালী কেশের বালক
খুঁজে ফেরে তার সাতান্ন পানসী বহর,
ঘুমের ভিতর খুঁজি কার শীতল আঙুল
সুললিত স্বরে পাঠ করে যেন
কোন মৌন নারী,খুলে তার হাওয়ার নেকাব,
যেন তার ঘুমে মিশে আছে মশহুর গোলাপ;
কার ফুৎকারে নিভে গেল সাতাশটি
সুযোগ সকাল,
জন্মান্ধ পাখি উড়ে উড়ে বলে -----
অভিশাপ অভিশাপ!