আধুনিক বাঙলা কবিতা হঠাৎ কোনো প্রবাহিত ধারা নয়। এ কবিতা দেখা দেয়নি সকাল আর সন্ধ্যার মতো; যা আবর্তিত হয় সময়ে, বা আসেনি কোন উজ্জ্বল শিখার মতো। তাকে নিতে হয়েছে সময়ের পর সময় ; শতকের চেয়ে বেশি সময়। বিশশতকের রচিত সাহিত্যের মধ্যে মেধা ও মননে বাঙালির উৎকৃষ্ট প্রতিভার চিহ্ন রয়েছে আধুনিক বাঙলা কবিতায়। যা এ শতকে রচিত অন্য কোনো সাহিত্যেয় দেখা যায় না। আধুনিক বাঙলা কবিতা আমাদের দেখিয়ে দিলো কবিতা কি রকম হ’তে পারে। কতো  উৎকৃষ্ট আর অপার সৌন্দর্য মিশে থাকতে পারে এ কবিতায়। যা আমরা কল্পনা করতে পারিনি পূর্বে রচিত কবিতায়। এ কবিতা আমাদের চোখকে করলো  প্রসারিত আর কানে প্রবেশ করালো এক অজানা সুরমূর্ছনা। যার ধ্বনি আজো আমরা কান পেতে শুনতে পারি। আধুনিক কবিতা শুধু তার জড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের সামনে আসেনি, বরং এ কবিতা আমাদের দেখিয়ে দেয় কবিতা আসলে কি ? কবিতা কি রকম হ’তে পারে, বা কবিতা কতো রকম ভাবে রচিত হ’তে পারে। এ কবিতা রচিত হওয়ার পর আমরা চিনে নিতে পারি কবিতা আর অকবিতাকে। যা আমরা পারতাম না পূর্বে রচিত কবিতার মাঝে। বিশশতকে সাহিত্যের উজ্জ্বলতম সৃষ্টি  আধুনিক বাঙলা কবিতা,  যা এ শতকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আধুনিক বাঙলা কবিতা শুধু তার নিজের মহিমায় অক্ষয় হ’য়ে থাকেনি, বরং তার রচিত ধারাকে পরিবর্তন ক’রে নিয়ে আসে সম্পূর্ণরূপে। এ কবিতা ব্যতিক্রম, পূর্বের সমস্ত কবিতা থেকে। এ কবিতার চরিত্র তার নিজের তৈরি; অন্যর থেকে ধার করা নয়। এ কবিতার ভাব, ভাষা, ছন্দ, রূপক, সৌন্দর্য তার নিজের একান্ত অনুভূতির ব্যাপার। যে অনুভূতির প্রসারিত ঢেউ আমরা দেখতে পাই তার আপন কণ্ঠস্বর থেকে। এ কবিতায় আমরা দেখতে পাই সৌন্দর্যের বিরামহীন বিস্তার। ইন্দ্রিয়ের এক গভীর ঢেউ। তাঁরা সংগীতজ্ঞ নন, কিন্তু তু’লে  নিয়েছেন এক অপার সুর, যে সুর বেজে উ’ঠে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে। বিচিত্র বর্ণনায় ভ’রে তোলেননি তাঁদের কবিতা, বরং ভাব আর সৌন্দর্যের ব্যাপক–বিস্তার ব্যবহার ক’রে নিয়েছেন আপন ভূমিতে। এ কবিতার আবেগধারা স্বল্পস্থায়ী নয়; বরং তার মায়াময় নিটোল সৌন্দর্য আমাদের নিয়ে যায় অরণ্যের এক দিকচিহ্নহীন পথে। আমরা এক বার নয়, বরং বার বার সম্মুখীন হয়েছি সেই কবিতার সামনে; মুগ্ধ হয়েছি তার কল্পনা আর অভিজ্ঞ প্রাজ্ঞতার সামনে। বড়ো অদ্ভুত সেই কবিতা, যা শিহরণ জাগায় ক্ষণে ক্ষণে। দ্রুত নিয়ে যায় এক জীর্ণ পরিবেশ থেকে বিরতিহীন গন্তব্যেয়। তার শব্দ, মর্মর শব্দ, কণ্ঠের সুর স্পষ্টভাবে গুনগুন ক’রে আলোকহীন পরিবেশ থেকে আমাদের নিয়ে যায় এক নীরব অনুভুতিময় পরিবেশে। যেখানে আমরা জেগে ছিলাম শতাব্দী থেকে শতাব্দী পরস্পরায়। এ কবিতা আদিম অন্ধকার নয়, তা উদ্ভাসিত আলোকময়। আমরা বধীর হ’য়ে উঠি তার সৌন্দর্যে, ভাষায়, প্রতীক আর রূপকে, শব্দ আর ছন্দে। তার চিত্তকল্পনা আমাদের নিয়ে যায়  বিংশ শতাব্দীর এক উজ্জ্বল শিখার সামনে, যেখানে আমরা পাই অমল সৌন্দর্য। আধুনিক বাঙলা কবিতা পরিশুদ্ধ  কবিতার এক নতুন ধারা । যে কবিতা অবস্থান ক’রে সকল প্রকার তর্ক থেকে বহু দূরে। তার সময়ে সে যে সৌন্দর্যের বিস্তার ঘটিয়েছিল তার প্রবাহিত ধারা বিরাজমান রয়েছে বর্তমান সময় পর্যন্ত। এ ধারা একক কোনো প্রবাহিত ধারা নয়।  প্রবাহিত হ’তে থাকে  সময়ের এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর হিশেবে। আধুনিক বাঙলা কবিতার গাঁথুনি বেশ শক্তিশালী, তাই তা সহজে তা ভেঙে পড়বে না। তা যেমন ভেঙে প’ড়ে নি গত পাঁচ দশকে। এ কবিতা ব্যক্তির গভীরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারের মধ্যে জাগ্রত ক’রে এক বিরাজিত উজ্জ্বল শিখা। যা চেতনায় গেঁথে রয় আপন আলোয়।


হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ (১৯৯৪)- এর ভূমিকাতে বলেনঃ ‘বিশশতকের বাঙালির প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি আধুনিক বাঙলা কবিতা। শুধু বিশশতকের নয়, হাজার বছরের বাঙলা কবিতা মূল্যায়ন করলেও বোধ করি যে আধুনিক বাঙলা কবিতার থেকে অভিনব ও উৎকৃষ্ট কবিতা লেখা হয়নি আর কোনো শতকে। মাত্র সাড়ে ছ- দশকে আধুনিক কবিতার যে উৎপাদন ঘটে উৎকর্ষে ও পরিমাণে তার তুলনা দুর্লভ। আধুনিক বাঙলা কবিতা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার আধুনিক কবিতার মতোই অভিনব ও বিস্ময়কর, এবং বিপর্যয়করও; তবে বিস্ময়ের মাত্রা বাঙলায় অনেক বেশি।  আধুনিক বাঙলা কবিতার সাথে জড়িত একটি বিস্ময় হচ্ছে একই দশকে পাঁচজন মহৎ কবির আবির্ভাব, আগে যা কখনও ঘটেনি। আধুনিক বাঙলা কবিতায়ই প্রথম বাঙলা কবিতা হয়ে উঠে প্রাপ্ত বয়স্কতার কবিতা। এ কবিতা বিশশতকের কবিতা, এ কবিতায়ই প্রকাশ পেয়েছে বিশশতকের সংবেদনশীলতা, এতেই পাই বিশশতকের আপন শিল্পকলা। আধুনিক বাঙলা কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের বঙ্গীয়রূপ, ওই প্রপঞ্চের নাম আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদ, যার উদ্ভব ঘটে পশ্চিমে, এবং ছড়িয়ে পড়ে সাড়া পৃথিবীতে। আমাদের ভাগ্য যে বাঙলা কবিতা ওই প্রপঞ্চের বাইরে থাকেনি, বরং থেকেছে অত্যন্ত ভিতরে, এবং সুফল ফলিয়েছে কবিতার। রোম্যান্টিক আন্দোলনের পর সবচেয়ে ব্যাপক ও সফল সাহিত্যশিল্পান্দোলন  আধুনিক বা আধুনিকতাবাদ, যা গ্রহ জুড়ে সৃষ্টি করেছে অভিনব অসামান্য সাহিত্য ও শিল্পকলা; তার অবসান ঘটে গেছে  দু-তিন দশক আগে, তবে রোম্যান্টিকতাকে যেমন আমরা সম্পূর্ণ  মুছে ফেলতে পারিনি, তেমনি এখনো আমরা বাস করছি আধুনিক সাহিেত্যর মধ্যেই। আধুনিকতাবাদ এক বহুমাত্রিক শিল্পা সাহিত্যন্দোলন, যার বিকাশ ঘটেছে নানা রূপে, নানা রীতিতে। ইংরেজি ‘মডার্ন’ আর বাঙলা ‘আধুনিক’ শব্দ দুটি আর্থ গতিশীল, তা বিশেষ কোনো স্থির কাল নির্দেশ না করে ক’রে  যে কালই আসে, নির্দেশ করে তাকেই; ‘অধুনা’ থেকে গঠিত ‘আধুনিক’ বোঝায় ‘এখনকার’ সাম্প্রতিক, তবে ‘আধুনিকতাবাদ’ প্রত্যেক সাম্প্রতিক কালের বৈশিষ্ট্য নয়, বিশ শতকের বিশেষ সময়ে যে প্রপঞ্চ দেখা দিয়েছিলও, তাই ‘আধুনিক’ বা ‘আধুনিকতাবাদ’। অন্যান্য কালের স্বভাব রীতির এককতা, আর আধুনিকতার স্বভাব রীতির বিচিত্তরও; তার কারণ আধুনিকতাবাদ একক আন্দোলন নয়, একরাশ আন্দোলনের ইম্প্রেশনিজম, অভিব্যক্তিবাদ, কিউবিজম, ভবিষ্যদ্বাদ, প্রতীকবাদ, চিত্রকল্পবাদ, ভরটিসিজম, দাদাবাদ, পরাবাস্তবতাবাদ ও আরো নানা শিল্পকলাবাদের সমষ্টি।  এ সব বাদের মধ্যে মিল রয়েছে এখানে যে প্রতিটি আন্দোলনই  বাস্তবতাবাদ ও রোম্যান্টিকতাবিরোধী, ও বিমূর্ততামুখি; এ ছাড়া এগুলোর মধ্যে মিলের থেকে অমিল বেশি, এবং অনেকগুলো পরস্পর বিরোধী।’  


হুমায়ুন আজাদ একই ভূমিকাতে তু’লে ধরেন  বাঙলার মহৎ বা প্রধান কবিদের একটি ধারাবাহিক স্তর। স্তরটি এরকমঃ বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডিদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞান দাস, গোবিন্দ দাস- পদাবলির পাঁচজন; মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, ভারতচন্দ্র রায়- মঙ্গল কাব্যের তিনজন; মাইকেল মধুসূদন দত্ত– মহাকাব্যের একজন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- রোম্যান্টিক কবিতার একজন; এবং জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে- আধুনিক কবিতার পাঁচজন।                                  
            
বাঙলা কবিতায় প্রতীকবাদ বা প্রতীকবাদী স্থান ক’রে  নেয় তার মতো করে। প্রতীকবাদ হ’য়ে উঠে  ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কবিতার এক বিশেষ আন্দোলনের নাম। পাশ্চাত্য  সাহিত্যের  বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে তার ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবহার। প্রতীকবাদী কবিরা  হ’য়ে উঠেছিলেন সূক্ষ্ম বাঞ্জনায় বিশ্বাসী একদল কবি; যারা স্পষ্টতার পক্ষে ছিলেন না। তাঁরা কবিতাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সংগীতের কাছাকাছি। যে প্রতীক বাদী কবিতার ব্যবহার আমরা দেখতে পাই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপ ও আমেরিকার সমস্ত সাহিত্য জুড়ে। এ সবের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই ‘অধিবাস্তববাদ’ বা ‘সুররিয়ালিজম’- এর ব্যবহার। দাদাবাদের প্রভাব থেকে বেড়িয়ে তৈরি হয় এই ‘সুররিয়ালিজম’। অধিবাস্তববাদী শিল্পী তৈরি করেন তার নিজের মধ্যে থেকে যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতার  মধ্যে যে সীমানা তৈরি হয়েছে তার ব্যবধান বা দূরত্ব নিবারণ।    


‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’র দু’টি সংকলন সম্পাদনা করেন দু’জন কবি। প্রথম সংকলনটি সম্পাদনা করেন বুদ্ধদেব বসু (ফালগুণ, ১৩৬০: মার্চ, ১৯৫৪); এবং তার চার দশক পরে ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ নামে পরিশুদ্ধ একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন হুমায়ুন আজাদ (ফালগুণ, ১৪০০: ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪)-এ। দু’জন আধুনিক কবির হাতে  দু’টি গ্রন্থ সম্পাদিত হয়। দু’জন-ই বাঙলা সাহিত্যের প্রধান কবি, এবং সর্বোপরি আধুনিক কবি। ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ খ্যাত গ্রন্থ দুটি প্রকাশ পায় দু’স্থান থেকে। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৫৪) গ্রন্থটি প্রকাশ পায় পশ্চিম বাংলা থেকে; এবং স্বাধীনতার অনেক প’রে বাঙলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদ সম্পাদিত ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’(১৯৯৪)- গ্রন্থটি। দু’টি গ্রন্থ দু’স্থান থেকে প্রকাশিত হলেও তাঁরা দাবী রাখে আধুনিক বাঙলা কবিতার সম্ভারে। যে কবিতা শুধুই দেখা দিবে আধুনিক কবিতা হ’য়ে।........... (চলবে)