বিষ্ণু দে, তিরিশি কবিদের অন্যতম। কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ’য়ে দেখা দেয়। কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে, যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে। কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা। পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব-মহিমায়। যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক’রে অন্যেদেরকেও। ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে’কে নয়, বরং নতুনতর হ’য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা। বিষ্ণু দে’র ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু’বার।


‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে (১৯২৮-১৯৩৩) সময়ের মধ্যে, এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ, ১৯৩৩-এ। কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু’বছর পূর্বে অর্থাৎ, ১৯২৬-এ। যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন। ১৯৩৩-এ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়, কিন্তু লেখার পর্বটি শেষ হয় এর এক বছর পূর্বে অর্থাৎ, ১৯৩২-এ। তাহলে ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর রচনা কালের ব্যাপ্তি দাঁড়ায় (১৯২৬-১৯৩২) সময়ের মধ্যে। এই সাত বছরে বিষ্ণু দে ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এ অন্তর্ভূক্ত করেন পঁচিশটি কবিতা। সতের থেকে বত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ রচনা ক’রে বাঙলা কবিতায় নিজের স্থানটি করে নেন। পরবর্তীতে  চলে ওই স্থানটির মজবুত করন। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর পঁচিশটি কবিতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবিতায় উঠে আসে ছয়টি কবিতা। যদিও ওই কাব্য গ্রন্থের আরো কিছু কবিতা শ্রেষ্ঠ হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু পঁচিশটি কবিতা থেকে ছয়টি শ্রেষ্ঠ হওয়াতে বা ততোধিক না হওয়ার ব্যাপারটি ওই পঁচিশটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো হলো: ‘পলায়ন, ‘প্রত্যক্ষ’, ‘অভীপ্সা’, ‘উর্বশী’, ‘সন্ধ্যা’ এবং ‘সোহবিভেওস্মাদেকাকী বিভেতি’। কিন্তু ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর প্রত্যেকটি কবিতার নিচে রচনা কাল দেওয়া রয়েছে। এই রচনাকাল দেওয়া হয় বৈশাখ ১৩৬৭-তে (১৯৬০)-এ সিগনেট সংস্করণে। তাহ’লে ১৯৩৩-এ যখন প্রথম প্রকাশিত হয় কবিতাগুলি তখন তিনি রচনাকাল দেননি কেন তা আমার জানা নেই। দ্বিতীয় সংস্করণ-এ এটা উল্লেখ করা হয়। আমি পূর্বেই বলেছি ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর রচনাকাল (১৯২৬-১৯৩২)-এ। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্কারণে ‘১৯২৬-এ’ রচনা কোন কবিতা পাওয়া যাবে না।


আমি ১৯২৬ সালের কথা বলেছি ‘শ্রেষ্ঠ কবিতার’ নির্বাচন এর তথ্যানুযায়ী। তাহলে তিনি কী দ্বিতীয় সংস্করণে ওই কবিতার কোনো পরিমার্জন করেন? ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এ ১৯২৮-এর সময় কালের রচিত কবিতা পাওয়া যাবে চারটি। আবার বলেছি ১৯৩২-এ ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর রচনাকাল শেষ হয়, কিন্তু এ গ্রন্থেই পাওয়া যাবে ১৯৩৩-এ রচিত দু’টি কবিতা। সেই তথ্যমতে বলতে হয় রচনাকাল শেষ হয় ১৯৩৩-এ। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর ‘অর্ধেক কল্পনা’ কবিতাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের রচিত কবিতার কথা। যদিও তিনি সম্পূর্ণটি গ্রহণ করেননি, গ্রহণ করেছেন আংশিক।


বিষ্ণু দে’র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “চোরাবালি”- যার রচনাকাল (১৯২৬-১৯৩৬)-এর মধ্যে। গ্রন্থ হ’য়ে প্রকাশ পায় তার পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ১৯৩৭-এ। পূর্বের কাব্যের ন্যায় প্রথম প্রকাশে কাব্যটির রচনা কাল উল্লেখ ছিল না। দ্বিতীয় সংস্করণে এসে তা দেখা দেয়। ১৯২৬-এর রচনাকালনুযায়ী-“চোরাবালি” এর কিছু কবিতা চলে আসার কথা ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এ। কিন্তু পৃথক দু’টি কাব্য হওয়াতে প্রথম কাব্যের কবিতাগুলো পৃথক হ’য়ে যায়। কবিতা রচনার দিক থেকে ১৯৩৩- পর্যন্ত সমস্ত কবিতাগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল ‘উবর্শী ও আর্টেমিস’-এ। এর পরবর্তী  তিন বছরের কবিতা অন্তর্ভূক্ত হবে “চোরাবালিতে”। যেহেতু ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এর কবিতাগুলো চোরাবালির সাথে সংমিশ্রণ না ঘটালে উভয় দু’টি কাব্যের রচনাকালের ব্যবধান হয় তিন বছর। আর এই তিন বছরের কবিতাগুলো সম্পূর্ণরূপে দেখা দিবে ‘চোরাবালি’তে। কিন্তু বিষ্ণু দে’র চিন্তায় বা নির্বাচনে দু’টি কাব্য হওয়াতে কবিতাগুলো ব্যাপক ভাবে পৃথক হ’য়ে যায়। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ যদি প্রথম প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ হ’য়ে থাকে তাহলে, ১৯৩৩ পর্যন্ত যতোসংখ্যক কবিতা এসেছে- ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এ, ততোধিক কবিতা এসেছে ‘চোরাবালি’-তে। ‘চোরাবালি-তে’ কবিতার সংখ্যা বাইশটি এবং শ্রেষ্ঠ কবিতায় উঠে আসে নয়টি কবিতা। ‘চোরাবালি’-তে পাওয়া যাবে “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” নামক একটি কবিতা। যেটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার কথা, ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধার প্রভাত পাখির গান। না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।’ আর সেই একই নামে বিষ্ণু দে বলেছেন, “সে কথা তো জানি তোমাতে আমার মুক্তি নেই, /তবু বারে বারে তোমারই উঠানে যাওয়া আসা।/আত্মীয় নও, সমাজের ইকরার-নামায়/কস্মিনকালে বাঁধা হয়নি কো তাই বাসা।” “চোরাবালিতে” ‘গার্হস্থ্যাশ্রম’ কবিতাটিতে পৃথক কিছু কবিতা নিয়ে স্থান নিয়েছে। ‘গার্হস্থ্যাশ্রম’-এর অন্তর্ভুক্ত শেষ কবিতাটি ‘আত্মজ্ঞান’। এই কবিতাটির শেষেই রয়েছে কবিতার রচনাকাল (১৯২৫-১৯৩০)। এই কবিতা সমূহ স্বাভাবিক ভাবেই আসার কথা ছিল ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’-এ, কিন্তু তা-না হয়ে আসে ‘চোরাবালি’-তে, তাই ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে কতটা স্বতন্ত্র রয়েছে ‘চোরাবালি’।


জীবনানন্দ দাশের ‘সুদর্শনা’, ‘সবিতা’, ‘সুচেতনা’, ‘বলনতা সেন’ এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘কঙ্কাবতীর’ মতো, বিষ্ণু দে’র কবিতায় স্থান পায় এরকম কিছু নাম। যে নামগুলোর উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করতে পারি প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই। ‘উর্বশী ও আর্টেমিস”-এ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা তাকে করে আশীর্বাদ’ নামক কবিতাটিতে প্রথম উপস্থিত হয় ‘লিলি’ নামটি। এই কবিতার দ্বিতীয় অংশে ঃ ‘বলি আমি পল্লবমর্মরে/তোমার নয়নে / লিলি পর্বতের ‘সরোবর/পেয়েছে ব্যঞ্জনা/ শিখর প্রশান্ত, স্থির, স্বচ্ছ ও অতল’। এই একই কবিতায় পরের অংশে আবার দেখতে পাই, মৃদুস্বরে বলি/ তোমার কথা, লিলি, দেয়ালিমক্ষীরা/প্রেমের গুঞ্জন শত হৃদয় আলোর পাশে ঘোরে বর্ষকাল,/ক্ষণিক-তোমার কথা তুমি ভুলে যাও/আমার হৃদয়ে তারা ঘোরে নানা রূপে রূপে নক্ষত্রসভায়’। আবার এর পরবর্তী কবিতায় ঃ ‘বাহুটি জড়িয়ে তাকে বলি,/ তোমার চিত্তের, লিলি চামেলি সৌরভ/যে মায়া ছড়ায় চেতনায়/সে মারায় ফুটেফুটে ওঠে/পৃথিবীর পরম আশ্বাস’। একই কাব্য গ্রন্থের ‘গ্রীষ্ম’ নামক কবিতায় চোখ রাখি। এই কবিতায় প্রথম দিকে যদিও নামটি পাওয়া যাবে না, কিন্তু অন্যরকম কোনো আহ্বান উল্লেখ রয়েছে: ‘ঘন গ্রীষ্মতাপ। / বিশ্বের উত্তপ্ত দাহ আজ বুঝি জমায়েত ভিড়/বেঁধেছে এখানে দানা আমাদের পাশে?/ জমেছে গুমোট। আবার শেষের দিকে: ‘অবসন্ন ব’সে দুইজনে।/ কর্মহীন অবকাশ কর্কশ কঠিন গুমোট/কাটে রৌদ্রতাপে।/আকাশ পৃথিবী: আমবন/অদৃশ্য অস্পৃশ্য হল বর্ণহীন প্রদাহে রোদ্রের/শুধু লিলি, তোমার শরীর/মসৃন, কোমল পান্ডু মর্মর শীতল।’


“চোরাবালি” কাব্যগ্রন্থের ‘ওফেলিয়া’ একটি চমৎকার কবিতা। যে কবিতাটির জন্য কাব্যগ্রন্থটি অনেকটা উজ্জ্বল হ’য়ে ওঠে। বিষ্ণু দে’র কবিতায় ‘ওফেলিয়া’ আসে কবিতা হয়ে ওফেলিয়ার প্রতি কবির ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন ভাবে। যাঁর হৃদয়ে ভালোবাসা ভর করার পর অনেকটা পথ এগিয়ে যায় কবি। শুধু ভালোবাসা বা বাহ্যিক সৌন্দর্য্যরে মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে তার প্রকাশ ঘটান বাহিরেও। কবি সৌন্দর্যের আহ্বান করতে থাকেন এভাবে: ‘তুমি যেন এক পরদায় ঢাকা বাড়ি/আমি অঘ্রাণ-শিশিরে সিক্ত হাওয়া/ বিনিদ্র তাই দিনরাত ঘুরি ফিরি।’


‘লিলি’ ব্যতীত ‘ওফেলিয়া’ কবিতায় ভালোবাসার স্তব কোন অংশ কম মনে হয়নি। সমস্ত কিছু ছেঁড়ে কবি দুঃসাহসিক কাজে লিপ্ত হতে পারেন এভাবে। ওফেলিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ পায় দুঃসাহসিকভাবে। ‘ওফেলিয়া’ কবিতা থেকে আবার যখন আমরা অগ্রসর হবো ‘গার্হস্থ্যাশ্রম’ কবিতার দিকে তখন আবার ফিরে পাবো ‘লিলিকে’ ‘গার্হস্থ্যাশ্রম’-এর অর্ন্তগত ‘আর্ধিদেবিক প্রত্যাদেশ’ কবিতায় কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়ার পর অগ্রসর হলে ‘সেই কথা ভাবলুম বসে বসে লেকে/ তোমার রঙেরও লিলি হবে খড় রং’, এবং শেষের দুপঙ্ক্তিতে এসে আবার পাবো : ‘তোমার পাশের তো তাই ঘেঁষে এসে মিলি/ সিগারেট না খেয়েই-হাসছ যে লিলি।’ পরের কবিতাটির দিকে চোখ রাখলেই প্রথম দিকেই পাওয়া যাবে ‘মাঘের মাঝারে ফাল্গুনী হাওয়া বয়?/আজ লিলি শুধু স্বপ্ন দেখার পালা’। ঘন গ্রীষ্মতাপ থেকে কবি ফিরে এসে আবার যখন ফাল্গুনী হাওয়ার স্পর্শ গায়ে লাগান, এবং স্বপ্ন দেখার পর্ব শুরু করেন নীল শাড়ি পরিহিত কোনো নারীর জন্যে, তখন কবি কতটা স্থির থাকেন নিজের জন্য? লিলিকে উদ্দেশ্য করে আবার যখন প্রকাশ করেন : ‘উদাস উর্দু ঘুর মৃদুমিঠে স্বরে/গুঞ্জন করো, স্বপ্নের জাল টানো/আজ লিলি আর থাকা যায় নাকো ঘরে/ উদাস উর্দু সুর মৃদুমিঠে স্বরে/শহুরে ছাতেও অকাল দখিনা করে/উতলা-উদাস’-সে কথা তো লিলি জানো। তাহলে স্বপ্নের জাল টানার পর কবি ‘লিলিকে’ বাইরে নিয়ে আসতে চান, এবং মৃদুস্বরে আরো কিছু সুর ধ্বনি সৃষ্টি করতে বলেন। উতলা উদাসের কথা যেমন জ্ঞাত থাকে লিলির।


কবি বার বার এবং বহুবার ফিরে এসেছেন লিলির কাছে, এবং প্রেমের স্তব গেয়ে একাত্বতা প্রকাশ করেছেন তাঁর সাথে। ‘গাহস্থ্যাশ্রম’-এর ‘কনডিশনড রিফ্লেকস’-এ কবি প্রকাশ করেছেন ‘লিলির’ কাছে ফিরে আসার কারণটি:


অভ্যাস শুধু অভ্যাস, লিলি, তাই তো আসি
তোমার উষ্ণ প্রেমের হাস্যচপল নীড়ে।
অভ্যাস, শুধু অভ্যাস, ভালো তাই তো বাসি,
সহজের পেশা, আরামের নেশা, তাই তো আসি
তোমার শাড়ির ছটায়, কথায় কথায় হাসি-
না হলে ঝঞ্ঝা ফেলত সে সারা জীবন ঘিরে।


তাহ’লে শুধু অভ্যাসের জন্যে লিলির কাছে আসা, এবং এই অভ্যাসের জন্যেই তাঁকে ভালোবাসা, এ ছাঁড়া অন্য কোনো কারণ নেই? ভালোবাসার ব্যাপারটিকেও তিনি অন্য সব ব্যাপারের মত নিয়েছেন। তাহলে অন্য কাউকে ভালোবেসে তিনি লিলির নিকট এসে এটিকে অভ্যাসে পরিণত করতে চেয়েছেন।


‘আত্মজ্ঞান’ কবিতায় আবার পাওয়া যাবে লিলিকে। স্বদেশ বা মাতৃভূমি ছেঁড়ে কবি বহু দূরদেশে জন্মগ্রহণে করলে কিভাবে চিনে নিতেন তাঁকে তা প্রকাশ করেন। কতটা তাঁর কথা মনে পড়তো কবির, যাঁর নিকট শুধু অভ্যাসের কারণে ফিরে আসা হয়। কবি তখন অষ্পষ্ট ভাবে চিনে নিতে পারেন লিলিকে। তাই বলেন, ‘সুযোগ পেয়ে তো তবে পাশাপাশি মিলি?’/ আমাদের ভালোবাসা প্রাকৃতিক, লিলি।’ ‘জ্যোকন্দা’ কবিতায় কবি মলিন আলোয় আসার জন্য আহ্বান করেন ‘মোনালিসা’ ও ‘সাইনারাকে’। যদিও বাস্তবিকভাবে তাঁরা নারী নয়। একজন বিখ্যাত শিল্পীর অঙ্কিত চিত্র এবং অপরটি কবিতায় সৃষ্টি হাওয়া চরিত্র। কবির অনুরাগ দেখে মনে হতে থাকে, তিনি যেন বাস্তবিক ভাবে পেতে চান দু’জনকে। দু’জনকেই তিনি আহ্বান করেন একই সঙ্গে। ওই সৌন্দর্যময় চিত্রটিও কবির কাছে ধরা দেয় বিদেশিনী হয়ে; যা তিরিশি কবিদের অভ্যাসে পরিণত হয়। যাঁদেরকে পাওয়ার জন্যে যেন ম্লান হ’য়ে যায় লিলি। বিষ্ণু দে’র প্রথম দু’টি কাব্যেয় হাত রাখলে এটা ষ্পষ্ট যে, তাঁর অনুরাগ বা ভালোবাসা একক কোনো নারীর প্রতি নয় বা স্বদেশি কোনো গ্রাম বাঙলার নারীর জন্যেও নয়। গ্রীক বা বিদেশী যে কোনো বিখ্যাত শিল্পী বা নাট্যকারের ঐতিহাসিক চরিত্র বা পুরাণের বিখ্যাত নারীচরিত্র-গুলো স্থান করে নেয় কবিতায়। এটা কী কবির স্বভাব না স্বতন্ত্র সৃষ্টির কোনো পথ?


“চোরাবালি”-কাব্যগ্রন্থের ‘মন দেয়ানেয়া’-কবিতায় ‘লিলি’, ‘ডলু’ বা ‘মৈত্রেয়ী ঘোষ’ যা-ই বলিনা কেন, যাঁর দেহের খোঁজ অনেকটা স্বেচ্ছায় তিনি দিয়েছেন কবিকে। যাঁর শরীরের আঁচিলটার খবর পর্যন্ত কবি নিয়েছেন। যাঁর সাথে কবির সম্পর্ক গ’ড়ে ওঠে, এবং ওই শরীর থেকে কবি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারছেন না বলে দুঃখবোধ করতে থাকেন। কবিকে এখানে ক্লান্ত মনে হচ্ছে, নতুন কী করবেন তার জন্য চিন্তিত। এ দু’টি কাব্য গ্রন্থে ‘ডনুই-শারীরিক ভাবে ধরা দেন কবিকে, এবং কবিও বিচরণ করতে থাকেন বাঁক থেকে বাঁকে। শারীরিক সম্পর্কের কাছে প্রেম কতটা তাচ্ছিল্য হ’য়ে দেখা দিতে পার তা এই কবিতাটি না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়। দু’টি কাব্য জুঁড়ে যখন তিনি প্রেমের স্তরের পর স্তর গাঁথতে থাকেন আর এই কবিতায় এসে বলেন ঃ ‘প্রেম-ফ্রেম বাজে, আসলে-আমরা নতুন খুঁজি।’ এই প্রেমে বাঁচাটাই আশ্চর্য হ’য়ে দেখা দেয় তাঁর কাছে। কবিতাটির শেষের দিকে কবি ক্লান্ত হ’য়ে পড়েন। কবি এখন আর স্বাদ নিতে পারছেন না। তাই তাঁকে নতুন পথের সন্ধান সৃষ্টি করতে হচ্ছে।