অমিয় চক্রবর্তী, গভীর চিন্তা, সূক্ষ্ম দৃষ্টি এবং বিস্ময়কর সংবেদনশীলতা নিয়ে রচনা করেছেন কবিতা। অমিয় চক্রবর্তী, নিজস্ব কোনো স্বতন্ত্র জগৎ নিয়ে কবিতা রচনা করেননি, প্রচলিত অর্থে তাঁর কবিতায় রয়েছে আধ্যাত্বিকতর ভাবধারা। যে ভাবধারা মাধ্যমে অমিয়-কে পৃথক করে তিরিশি কবিদের অন্যে চারজন থেকে। সুধীন্দ্রনাথের মতো, অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় প্রকাশ পায় না জটিল শব্দের বিচ্ছিন্ন ব্যবহার। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় শারীরিক রক্ত মাংসের ব্যবহার নেই। তিনি দূরে অবস্থান করেছেন বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে এবং একজন নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশ থেকে। কিন্তু রয়েছে বাঙলা কবিতার মর্মমূলে, বেঁছে নিয়েছেন কবিতা রচনার নিজস্ব কাঠামো এবং প্রয়োজনীয় শব্দভাণ্ডার। যে সকল শব্দ নিয়ে এগিয়েছেন তিনি।


‘খসড়া, অমিয়’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ যা বুদ্ধদেব বসুর কাছে দেখা দেয় বিস্ময়কর বই হিশেবে। ‘কবিতা’ পত্রিকায় এ-সম্পর্কে মন্তব্য করেন- ‘একেবারেই আধুনিক; একবারেই অভিনব’। বিস্মিত মন সানন্দে স্বীকার ক’রে যে এখানে প্রকৃত কবিত্ব শক্তির সাক্ষাৎ পেলুম। কলাকৌশলের দিক থেকে তাঁর কাব্য দুঃসাহসিক। কিন্তু দুঃসাহসিক হবার অধিকারও তাঁর আছে। তিনি অভিনব, কিন্তু অভিনব হবার শক্তিও আত্ম প্রত্যয় নিয়ে তিনি আসরে এসেছেন। তাঁর ছন্দের বিচিত্র তির্যক গতি, অদ্ভুদ শব্দযোজনা দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্ব সমস্তই নিবিড় মনন শক্তির ফল। তাঁর কাব্যের সমস্ত উপমা ও রূপক আধুনিক মানুষের জীবনের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট, তাঁর কল্পনার পরিভাষা বিশেষ ভাবেই এ যুগের। মনে হয় ‘খসড়া’ প্রকাশের পরে অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য আধুনিক বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়।’


বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী’র প্রায় কাব্য গ্রন্থে-ই নাতিদীর্ঘ মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। নাতিদীর্ঘ মন্তব্য থেকে বাদ যাননি রবীন্দ্রনাথ-ও। অমিয়’র স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যেয় মুগ্ধ হোন রবীন্দ্রনাথ। বুদ্ধদেব বার বার উপস্থিত হোন অমিয়র কোন না কোন কাব্যের মন্তব্যেয়। ‘কবিতা’ পত্রিকায় (চৈত্র: ১৩৪৬, একমুঠো) বুদ্ধদেব বলেন ঃ ‘ছন্দে তিনি দক্ষ, তবু ছন্দকে পরিহার করে তিনি ভাষা ও রূপকল্প নিয়ে যে পরীক্ষায় লিপ্ত আছেন তার ক্রমবিকাশ সাধারণ পাঠক না হোক, অন্তত অন্যান্য কবিরা গভীর কৌতুহল নিয়ে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করবেন।’ তার অনুভূতির ব্যাপ্তি আন্তর্দেশিক এমনকি আন্তর্জাগতিক। অমিয় চক্রবর্তী, নিজের কবিতায়, নিজেকে ক’রে তুলেছেন এক দক্ষ শব্দ কারিগর হিশেবে। যাঁর ব্যুৎপত্তি ঘটিয়েছেন নিজের কবিতায়, বাঙলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট কবিতায়। কখন একজন কবি হ’য়ে উঠেন কবিদের কবি? তাঁর গভীর ব্যাপক চিন্তা, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি আর বিস্ময়কর সংবেদনশীলতার জন্য। তবে রবীন্দ্রনাথ বা সুধীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ অন্যান্য আধুনিক কবিরা কি কবিদের কবি নন? বুদ্ধদেব বসুর কাছে অমিয় শুধু কবিদের কবি নন, সমকালীন, আধুনিক কবিতার সবচেয়ে অপার্থিব কবি। যাঁর কবিতায় প্রসারিত হয়েছে লৌকিক থেকে অলৌকিক চিন্তা চেতনা।


‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থের ‘সংগতি’ তার সমস্ত কাব্যগ্রন্থের মূলসুর হ’য়ে দেখা দেয়। কবিতাটি আমি উল্লেখ করলাম ঃ মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/পোড়ো বাড়িটার/ ঐ ভাঙা দরজাটা/মেলাবেন/ পাগল ঝাপটে দেবে না গায়োত কাঁটা।/আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা./মারী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,-/বন্যার জল, তবু ঝরে জল,/প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল-/ মেলাবেন।/তোমার আমার নানা সংগ্রাম,/দেশের দশের সাধনা, সুনাম,/ক্ষুধা ও ক্ষুধার যত পরিনাম/মেলাবেন।/জীবন, জীবন-মোহ/ভাষাহারা বুকে স্বপ্নের বিদ্রোহ-/ মেলাবেন, তিনি মেলাবেন।/ দুপুর ছায়ায় ঢাকা,। সঙ্গীহারানো পাখি উড়িয়েছে পাখা,/পাখায় কেন যে নানা রং তার আঁকা।/ প্রাণ নেই, তবু জীবনেতে বেঁচে থাকা/-মেলাবেন।/ তোমার সৃষ্টি, আমার সৃষ্টি, তাঁর সৃষ্টির মাঝে/যত কিছু সুর, যা- কিছু বেসুর বাজে/মেলাবেন।/ মোটর গাড়ির চাকায় ওড়ায় ধূলো,/ যারা স’রে যায় তারা শুধু লোকগুলো;/কঠিন, কাতর,-উদ্ধত অসহায়,/ যারা পায়, যারা পেয়েও তবু না পায়,/কেন কিছু আছে বোঝোনো, বোঝা না যায়-/ মেলানে/দেবতা তবুও ধরেছে মলিন ঝাঁটা,/ স্পর্শ বাঁচিয়ে পুণ্যের পথে হাঁটা,/সমাজ ধর্মে আছি বমের্তে আঁটা,/ ঝোড়ো হাওয়া আর ঐ পোড়ো দরজাটা-/মেলাবেন, তিনি মেলাবেন।


অমিয় চক্রবর্তীর সমস্ত কবিতাগুলা থেকে ভালোলাগা কবিতাগুলো বা প্রধান কবিতাগুলো নির্বাচন করলে স্থান পাবে কবিতাটি তা বাস্তবিক ভাবে সত্য। অমিয় চক্রবর্তী’র কবিতার সর্বদিক দৃষ্টিপাত করলে একদিকে তাঁর ব্যতিক্রম দেখতে পাই। প্রেম বিষয়ক কবিতা যা অমিয়’র কাব্যেয় বিরল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, প্রেম নির্ভর কবিতা ব্যতীত যে কোনো কবিও হ’য়ে উঠতে পারে প্রধান সারির কবি। ‘পুষ্পিত ইমেজ’,-কাব্য গ্রন্থে লিরিক এবং আধুনিক প্রত্যক্ষ-প্রতীক সংমিশ্রন ঘটিয়ে রচনা করেন কিছু প্রেম গাঁথা কবিতা। সংখ্যায় মাত্র বারোটি, যেখানে রয়েছে দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ কবিতা। এবং এই কাব্যটি অমিয়’র ‘প্রেমের কবিতার কাব্য’ বলে চিহ্নিত হয়। অমিয় চক্রবর্তীর প্রেমের কবিতায় পাওয়া যাবে না রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথের মতো কোন বাস্তব কল্পনা মিশ্রিত নারীকে বা তার শরীর কাঠামোর কোন স্তব। শুধু তাই নয়, বুদ্ধদেবের মতেঃ ‘অমিয় চক্রবর্তী’র কবিতা দৈহিক-সংসর্গ থেকে দুর্বার ভাবে পরাক্সমুখ, এবং বাঙালি কবিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র কবি, যার রচনায় নারী তাঁর শরীর নিয়ে কখনোই প্রবেশ করেননি।’


অমিয় চক্রবর্তী’র বারোটি কাব্য গ্রন্থে এমন কোন নারীকে পাবো না, যে নারী তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে কবিতায়। অমিয় চক্রবর্তী, কোন নারীর শরীর সত্তাকে সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করে দেন আর রাখেন শুধু তাঁর মনোগত ভাব বিশ্লেষণটি। যা দিয়ে তিনি রচনা করেন শরীরহীন কবিতা। বাঙলা ভাষায় ব্যাপক সংখ্যক প্রেমের কবিতা রচনা না করেও অমিয় পান ওই প্রেমের কবিতার নির্দিষ্ট একটি স্থান। যে স্থানটি অমিয় ব্যতীত যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের রচনা করতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ প্রেমের কবিতা। এখানে আমি রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর নাম উল্লেখ করতে চাই। বুদ্ধদেব বসু, যাঁর ‘কঙ্কাবতী’ সম্পূর্ণ রূপেই প্রেমের কাব্য।


বাস্তবিক ভাবে, বাঙলা কবিতায় প্রেমের কবিতার স্থানটি পেতে হলে বিপুল পরিমাণ প্রেমের কবিতা রচনা করতে হবে এমনটি নয়। কবিতা যদি সে রকম হয় তাহ’লে তা স্বল্পসংখ্যই যথেষ্ট, যেমনটি হয়েছে অমিয় চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে। আর রবীন্দ্রনাথ, যাঁর বিপুল সৃষ্টির মাঝে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত রয়েছে প্রেমের কবিতা। যে কবিতায় শুধু রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয় সমস্ত বাঙালির মনোগত ভাব বিশ্লেষণ প্রেম হ’য়ে দেখা দেয়।


অমিয় চক্রবর্তী’র মতো প্রেমের কবিতার প্রাপ্য স্থানটি অতো সহজে অর্জন করতে পারেননি অন্য কেউ।একদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে হয় অন্যদের থেকে অমিয় চক্রবর্তী বেশ সৌভাগ্যবান। প্রেমের কবিতায় নিজের প্রাপ্য স্থানটির জন্য। সম্ভবত অমিয় চক্রবর্তী ব্যতীত অন্যে কোন কবি এতো কম সংখ্যক প্রেমের কবিতা লিখে বাঙলা ভাষায় প্রেমের কবিতায় একটি বিশিষ্ট স্থান অর্জন করতে পেরেছে কিনা আমি জানি না।