পারিবারিক বন্ধন যেমন মানুষকে কাছে টানে; তেমনি অনেক সময় তা দূরেও সরিয়ে দেয়। এ-দিকটির চিত্র আমরা দেখতে পাই মৃণালিনী দেবীর জীবনে। সন্তানরা বড়ো হওয়ার পর সবাই যে; সব সময় তার কাছে ছিল, এটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তাই বিভিন্ন সময়, তাঁরা থেকেছে জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতনে-ও। এই বিভিন্নমুখী স্থান পরিবর্তনের জন্য পারিবারিক সম্পর্কে অনেক সময় দেখা দিয়েছে মা থেকে তাঁরা থেকেছে অন্যত্র। বিশেষ করে, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে যা চোখে পড়ে অনেক বেশি। পারিবারিক চিঠিতে দেখা যায়; যে-যেখানে থাকুক না কেন; মৃণালিনী দেবী সন্তানদের সাথে সর্বদা রক্ষা করেছেন যোগাযোগের দিকটি। সন্তানদের খোঁজ নিতে তাঁদের লিখেছেন চিঠি; তদ্রূপ তাঁরাও চিঠির মাধ্যমে রক্ষা করেছেন পারিবারিক যোগাযোগের আসনটি। মা, মৃণালিনী দেবীকে লিখিত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠিতে তিনি বলেন , ‘মা, তোমার চিঠি কাল পেলুম। নিতুদাদার কাছে প্রায়ই যাই। বোলপুর থেকে তেল, কদমা, খেলনা কিনে এনেছি। ওল পেলুম না। আজ সার্কাস দেখতে যাব। কাল বিসর্জন হবে। কাল দেখতে যাব বলে আজ সেটা পড়ে রাখলুম। শুক্রবারে সব জিনিষ কিনতে যাব। শনিবারে বিবিদিদির জন্মদিন। বেলা যদি কিছু দেয় ও শীঘ্র পাঠিয়ে দিক। নীদ্দার কাল রাত্তিরে ঘাম হয়ে জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল। আজ সকালে ১০০। অন্যদিন ১০১ হয়। প্রতাপবাবুই দেখছেন। আজ সুহৃদকে দিয়ে examine করবার কথা ছিল। তিনি এখন আসেননি। সাহেব কাল যাবে। সুশী বৌঠান চিঠি লেখেন না কেন ? তাঁর উকুন হয়েছে বলে বোধ হয় খুব ব্যস্ত থাকেন তাই লেখা হয় না। আমরা সব ভাল। তোমরা কেমন আছ লিখ ? ইতি রথী।’


পারিবারিক এই চিঠিটির প্রতি যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, ক্ষুদ্র হলেও চিঠিটিতে উঠে এসেছে অনেক দিক। কোন কিছুই যেন বাদ দিতে চান না রথী। মনে যা এসেছে তার সব কিছুই যেন জেনে নিয়েছেন মার কাছ থেকে। এই বন্ধন বা সম্পর্ক এক দিনে তৈরি হয়নি, ঠাকুরবাড়ির অভ্যন্তরে। এটি তৈরি হয়েছে আস্তে-আস্তে। মার সাথে তাঁদের বন্ধন ছিল অনেক দৃঢ়। বাবা ক্ষেত্রে; যা অনেকটা ম্লান। তাই মার কাছ থেকেই পেয়েছেন পারিবারিক সম্পর্কের উত্তর প্রদানের দিকটি। যা সন্তানরা রক্ষা করেছেন মৃণালিনী দেবীর জীবনকালে। Monteagle Villa, ১৮ই নভেম্বর ১৮৯৬ সালে রথীন্দ্রনাথ লেখেন আরও একটি চিঠি। তিনি বলেন, ‘মা, ভাই ফোঁটা পেয়েছি। বেলা তার সঙ্গে একটা চিঠি লিখেছে, আর তাতে লিখেছে যে যেদিন আমি কাপড় পাব তার পরের দিন খাবার পাঠাবে কিন্তু আমি ত পাইনি। তোমার চিঠি অনেকদিন পরেও পেলুম না। আমাদের কলকাতায় যেতে আর বেশি দেরী নেই- এই পাঁচদিন আছে। এখানে আজকাল বরফ পড়ে- ঠিক নুনের মত ছোট গুঁড়ি? আর খুব ঠাণ্ডা। তুমি বলেছিলে যে আমাকে ঘাসের মধ্যে একরকম ফুল পাওয়া যায় সেইগুলো আমি আনতে চেয়েছিলুম ত প্রতিভাদিদি বল্লেন ওগুলো রেলগাড়িতে আনতে গেলে সব ফুলের পাতাগুলো উড়ে যাবে, তাই বলে এক রকম ঘাসের ফুল নিয়ে যাচ্ছি। আমি তবে এই খানেই শেষ করি। ইতি রথী।’ সন্তানের এই চিঠিটি মা, মৃণালিনী দেবীকে বেশ ভাবিত করে তোলে। তিনি সর্বদাই চিন্তা করতেন কে, কোথায় কেমন আছে ? কার, কি লাগবে তার ফরমাশ করতেই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন।


সন্তানরা কি খেতে পছন্দ করতেন, তা জানা ছিল মৃণালিনী দেবীর। তাই কোন কিছু না বলা হলেও তিনি তা তৈরি করে দিতেন।  সন্তানরাও নিজের যত আবদার ছিল তা পাঠিয়ে দিতেন মা কাছে। পারিবারিক অনেক কথা ছিল, যা সন্তানরা বাবা থেকেও মার কাছে তুলে ধরতেন সর্বদা। মৃণালিনী দেবীও তার সাধ্যমত; যে কোন মূল্য দিয়ে হলেও তাঁদের সেই দাবি-দাওয়া রক্ষা করে চলেছেন দিনের পর দিন। এই কষ্টের মধ্যেও তিনি এক প্রকার সুখ খুঁজে পেতেন। মৃণালিনী দেবীকে, রথীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠি লেখেন, তার বেশ কিছুদিন পর। রথীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মা, কাল রাত্তিরে এখানে এসে পৌঁছিয়েছি। গাড়ি খালি ছিল নৈহাটি পর্যন্ত তারপরে একটা গোরা জুটেছিল। কিন্তু সে সৌভাগ্যক্রমে সাহেবের বন্ধু ছিল। নীদ্দার কাশী কাল খুব কম ছিল। কর্তাদাদা মহাশয়ের কাছে গিয়েছিলুম। আজ বোলপুর যাচ্ছি। একটু মুস্কিল হবে যে পুল ১টা থেকে ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকবে, ষ্টীমারে পার হতে হবে। ন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ১২টা টাকা যে দিয়েছিলে তার ১০টাকা ১৫আনা রেল ও ষ্টীমার খরচ হয়েছে। ১ টাকা ১ আনা বাকি আছে। বাড়ির সবাই ভাল আছেন। তোমরা কেমন আছ লিখ ? ইতি, রথী।’    
    
রথীন্দ্রনাথ যেভাবে মা মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লিখেছেন, মাও তার সময় মতো উত্তর দিয়েছেন। প্রথম সন্তান বেলা বা মাধুরীলতা (১৮৮৬-১৯১৮), যার সাথে মৃণালিনী দেবীর ছিল মনের গভীর টান। সেও সময় করে চিঠি লিখেছেন মা মৃণালিনী দেবীকে। মৃণালিনী দেবীর বাবা, বেণীমাধন রায়চৌধুরীকে লেখা ১৮৯৩ সালের, মে মাসে কোন এক চিঠিতে মৃণালিনী দেবী লেখেন, ’বাবা মহাশয়, আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনাদের যদি আসা মত হয় তাহলে আষাঢ় মাস থেকে এখানে আসবেন-এ মাসটা সেইখানেই থাকবেন। আমরা সব ভাল আছি। আপনারা সকলে কেমন আছেন লিখবেন। বাবামহাশয়ের জন্য কচু আর নেবু যদি পারেন তাহলে পাঠিয়ে দিবেন। দিদিমাকে বলবেন যে রবিবারদিন  অরুর একটি মেয়ে হয়েছে তারা সকলে ভাল আছে। আর তাকে বলবেন যে এখানে আসতে তিনি ওখানে থাকলে সেরে উঠতে পারবেন না। আমার প্রণাম জানিবেন, মৃণালিনী। পুঃ এর মধ্যে যদি কোন লোক আসে তো তার সঙ্গে কচু ও কলম্বনেবু  পাঠিয়ে দেবেন কিংবা ডাকে পাঠিয়ে দেবেন- অনেক দিন থেকে বাবামহাশয় কচুর কথা বলেছেন। দিদিমার জন্যে একটা চিঠি দিলুম তাকে পড়ে শুনিও।’ এ রকম ভাবে মৃণালিনী দেবী চিঠি লিখে সবার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। শুধু যে নির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তিকে লিখেছেন, তা কিন্তু নয়। যখন যাকে মনে টেনেছে; তার কাছেই মৃণালিনী দেবী চিঠি লিখেছেন। বেণীমাধন রায়চৌধুরীকে লেখা ছোট এই চিঠি থেকে জানা যায় আরও অনেক কিছু। চিঠিটি এই রকম, ‘নগেন্দ্রর চিঠি পেয়েছি।


আমাদের এখানে আজ তিন চারদিন থেকে দিনরাত ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আপনাদের ওখানেও কি বৃষ্টি হচ্ছে ? আমরা সকলে ভাল আছি। আপনারা কেমন আছেন লিখবেন। আমার প্রণাম জানিবেন। ইতি মৃণালিনী।’ খুব জটিল না হলেও স্বাভাবিক চিন্তায় ভরপুর চিঠিটি। ছোট-ছোট আবেদন, কথা আর কিছু জানা-অজানা সম্পর্কের সূত্র দিয়ে বাধা রয়েছে চিঠিটি। তাই এ-ধরণের ক্ষুদ্র দিকগুলো মানবিকতায় উঠে আসে ভাবনার সাথে। তার জন্য অন্য ধরণের চিন্তা করতে হয় না। যেমন চিন্তা করতে হয় না এই চিঠির বিষয়বস্তু ভাবতে বা তার নির্মাণে। এ-রকম সম্পর্ক যে, মৃণালিনী দেবীর সাথে সবার ছিল তা বলা যায় এক ভাবনায়। সবদিকই তিনি রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কতটা পেরেছেন তা কেবল সময় বলে দেয় বলে আমরা বিশ্বাস করি। বেণীমাধন রায়চৌধুরীকে লেখা, অপর একটি চিঠিতে মৃণালিনী দেবী বলেন, ‘আপনার চিঠি পেলুম। আদু দিদির অবস্থা শুনে বড় দুঃখিত হলুম- তিনি কেমন আছেন লিখবেন- তিনি মরবার আগে তাঁকে একবার দেখতে পেলুম না-সেইটে ভারি দুঃখের বিসয়-আপনার যতটা সাধ্য তার সেবা করবেন-তিনি আপনাদের অনেক করেছেন-আমরা সব ভাল আছি। আদুদিদিকে আমার প্রণাম জানাবেন। ইতি মৃণালিনী।’  


মৃণালিনী দেবীর ভাল লাগার জায়গা যে কোন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ছিল তা কিন্তু নয়। এ-সম্পর্ক জোড়াসাঁকো থেকে তৈরি হলেও থেমে থাকেনি একক কোন স্থানের মধ্যে। তাই চিঠিতে পাওয়া যায় এ- সম্পর্কের গভীর বিস্তৃতি। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নানা জনের নিকট তিনি লিখেছেন চিঠি। তাই চিঠিই হয়ে উঠেছে চেনা-অচেনার এক মিলবন্ধন। অমলা দাশ, কয়েকটি চিঠি লেখেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে। সেই চিঠির কোনেও লুকিয়ে আছে মৃণালিনী দেবীর কথা। অমলা দাশ বলেন, ‘ভাই বিবি, আজ মামা এখানে এসেছিলেন, তাঁর কাছে শুনলুম তুমি লিখেছ কাকীমার অবস্থা খুব খারাপ। এতদূর থেকে খুঁটিনাটি ভাল খবরে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া বড় শক্ত। মনটা আজ এত খারাপ হয়েছে কি আর বলব। আমার চিঠি তোমার হাতে পৌঁছোবার আগে কি হয়েছে ভগবান জানেন। আমি কাছে থেকে ২ দিনও কিছু করতে পারলুম না এ দুঃখ রাখবার স্থান নাই। সংসারে আমার বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম। কাকীমার মত বন্ধু আমার আর নাই, আর হবার সম্ভাবনাও নাই। কোন রকমে মনে কষ্ট হ’লে, কোন অশান্তি হ’লে দৌড়ে যাবার স্থান আর দ্বিতীয় নাই। তুমি যান না বিবি, বাপ মায়ের সঙ্গে রাগ করে কতবার কতদিন কাকীমার কাছে গিয়ে থেকেছি। এমন সম্পূর্ণ শান্তিতে ও নির্বিবাদে আর কারু সঙ্গে কখনোও কাটাইনি। কাকীমার উপর যে আমার কতটা আব্দার ও জুলুম চলত কি আর বলব। হতে পারে আমি মিথ্যা অমঙ্গল চিন্তা করছি, ভগবান করুন তাই যেন হয়। দিন রাত বড় ব্যস্ত হ’য়ে থাকি। বেলা রাণীর কাছে চিঠি লিখতে সাহস হয় না, তাই  তোমার কাছে লিখছি, যদি বিশেষ অসুবিধা না হয় ২লাইন করে তুমি যদি  লিখে দাও বড়ই উপকার হয়। আর বিশেষ কি লিখব আমরা সকলকে একরকম ভালই আছি। চিঠির উত্তর শিগগির দিয়ো। আজ তবে আসি। ইতি অমলা।’ পারিবারিক সম্পর্কের এক বন্ধন যেন আপন হ’য়ে ধরা পড়ে এই চিঠিতে। সব দিক দিয়েই তিনি যেন আপন মানুষ হ’য়ে উঠেন অন্যর কাছেও। তাই মৃণালিনী দেবীর ভালবাসার বন্ধন থেকে তিনি যেন মুক্ত হতে পারেন না। এ বন্ধন যেন আমৃত্যু সম্পর্কের হ’য়ে তাঁদের সামনে উপস্থিত হয়। যেখানে সবাই সবার হ’য়ে ধরা দেয়, আপন ভালবাসায়।


এর কিছু দিন পরে, ২৬ নভেম্বর, ১৯০২ সালে মধুপুর থেকে আরেকটি চিঠি লেখেন অমলা। তিনি বলেন, ‘ভাই বিবি, তোমার চিঠি কাল পেয়েছি। যদিও যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলুম তবু প্রথম ৩ লাইন পড়ে থমকে রইলুম। যে দিন শেষ এলুম সে দিনই আমার অন্তরাত্মা ডেকে বলেছিল জ্ঞান আর ফিরবে না, তোমাদেরও সে কথা অনেকবার বলেছি। সকলেই দেখত আমিও  দেখতুম, আমার কেন খারাপ লাগত জানিনে। যাক, যা আশঙ্কা করে বুক কেঁপে উঠত সেটা হ’য়ে  গেছে। কাল তোমার চিঠি পাবার পর থেকে কিভাবে দিন রাত কাটাচ্ছি ভগবান জানেন। আমার এ বেদনা বুঝবার লোক কেউ নেই; যদি স্বার্থগত আত্মার আমাদের সঙ্গে কোন সংস্রব থাকে, যদি বোঝাবার ক্ষমতা থাকে তাহলে তিনি বুঝবেন। শমী আমার বড় আদরের-কাকীমা বলতেন, ‘শমীর উপর তোমার অনেক দাবী আছে-বড় হ’লে তাকে বুঝিয়ে দেব। ইচ্ছে করছে দৌড়ে বেলা শমীদের কাছে যাই। ওদের সঙ্গে তাঁর অনেক স্নেহ ভালবাসা ভোগ করেছি, চোখের জলটাও ওদের সঙ্গে ফেলতে পারলে অনেক আরাম করত। বহুদিন তাঁর সঙ্গ ছেড়েছি, কত দূরে দূরে থেকেছি তবু মনে করতুম আমার একটা আশ্রয় আছে, নির্ভর করবার লোক আছে। কথাটা বড় অস্বাভাবিক শোনায়, আমি তাঁর কে?- কিন্তু তবু কি আশ্রয় ছিল কেমন করে বুঝিয়ে বলব ! এবারে বোলপুরে গিয়ে আমাকে লিখেছিলেন, ‘অমলা, আমার আশ্রয় একবার দেখে যেও।’ আমি বলেছিলুম, ‘দেখব বইকি, আপনার আশ্রমে আমার জন্য একটু স্থান রাখবেন কি ? যদি কোন দিন অন্য কোনখানে স্থান না পাই, আপনার কাছে যাব।’ তিনি লিখেছিলেন, ‘তুমি কখনো বিশ্বাস কর আমার কাছে তোমার স্থান হবে না ?’ চিরকাল ভাবতুম বাপ মায়ের অভাবে যদি অন্য কোথাও আশ্রয় না পাই, আপনা ভাইও যদি স্থান না দেয়, একমাত্র আশ্রয় আমার আছে সেখানে গেলে ফিরব না। এমনই নির্ভর বিবি, আমার সে মহা আশ্রয় ভেঙে গেছে। কোন কারণে কোন অশান্তি মনে এলে, কোন কষ্ট পেলে, দৌড়ে কাকীমার কাছে যেতে ইচ্ছে করত,  যে সময় তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি সে সব্দিনের কথা মনে হ’ত। তাঁর কাছে যাওয়া দূরে থাক-একখানা চিঠি লিখে কত সান্ত্বনা পেতুম। এখন আর কারু কাছে যাবার নেই। জোড়াসাঁকোর সঙ্গে সম্বন্ধ ঘুচল। আমার গাড়ির শব্দ শুনে কে আর সিঁড়ির কাছে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়াবেন। তিনি এসেছেন খবর পেয়ে সেই দিনই না গেলে কি অভিমানই  করতেন, আমি যে এবার তাকে কি অস্থায় ফেলে এলুম জানতে পারলে কত অভিমান করতেন। মাঘ মাস আসছে, ১১ মাঘের সব আমোদ-আহ্লদ শেষ খুবই ব্যাকুল ছিল। রবিকাকার চিঠি একখানা পেয়েছি।


খুব সংক্ষেপে ঘটনাটা আমাকে জানিয়েছেন ও লিখেছেন ছেলেদের মুখের দিকে চেয়ে অনেকবার আমাকে মনে করেছিলেন। ছেলেদের কথা বিশেষ কিছুই লেখেন নি। আমাকে মনে করে যে চিঠি লিখেছেন সেইটেই যথেষ্ট মনে করি। চিঠিখানা পড়ে তাঁর মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারলুম। যে আংটির কথা লিখেছ সেটা বেশ মনে আছে। শমী হবার একবৎসর আগে শিলাইদহ ওদের সঙ্গে যেবার ছিলুম একদিন রাত্তিরে বোটের জানলার ধারে বসে আমার হাত থেকে খুলে কাকীমাকে পরিয়ে দিয়েছিলুম। ওই আংটির সঙ্গে আমার অনেক কথা গাঁথা আছে। যখনি অনেকদিন পড়ে দেখা হ’ত আমাকে আংটি দেখিয়ে বলতেন ‘এই দেখো তোমার আংটি একদিনও হাত থেকে খুলিনি।’ শেষ পর্যন্ত হাতে আংটি ছিল। কাকীমার  সঙ্গে যে কি সম্বন্ধ ছিল কোনদিন ভাল করে বুঝতে পারিনি। এক হিসাবে বন্ধু ছিলেন- তেমন বন্ধু আর কখনো হয়নি হবেও না, অন্যদিকে মায়ের মত ভক্তি করতুম। বয়সে ছোট ছিলেন বোটে কিন্তু একদিনের জন্য তা মনে হয়নি। তাঁকে যে ভালবাসতুম, তিনি বেঁচে থাকতে কোনদিন বুঝতে পারিনি-এখন সেটা শতগুণে বেড়ে উঠেছে। প্রতিদিন তিল তিল করে তাঁর স্নেহ যত্ন যা কিছু পেয়েছি সব একসঙ্গে বুকের উপর চেপে ধরছে। খেতে হয় খাচ্ছি-কতকগুলি কর্তব্য আছে করছি। যত বেশী কাজকর্মে ব্যস্ত থাকি তত ভাল মনে করে- সারাদিন কোন না কোন একটা কাজ নিয়ে আছি, অবসরের সময়টা বড়ই পীড়ন করে। এমন Lonely লাগে কি আর বলব। ছেলেদের দেখবার জন্য মনটা খুবই ছটফট করে। এখান থেকে ফিরে যেতে যেতে তারা কলকাতায় থাকবে কি না, থাকলেই বা জোড়াসাঁকো কি করে যাব। দুদিন দেরী হ’লে খবর পাঠিয়ে ডেকে নেবার লোক আর নেই। রাণীর জন্য আমার ভারি ভাবনা হয়েছে। একে তো ওর শরীর অত্যন্ত খারাপ তারপরে এই শোকটা  সবচেয়ে ওরই বেশী লাগবে। ও মেয়ে, ভারি সহজে কাতর হ’য়ে পড়ে। একবার একটা পাখী পুষেছিল সে পাখীটা মারা গেলে যে কাতর হয়েছিল। কাউকে কিছু বলত না গুমরে গুমরে কেঁদে অস্থির হ’ত, ওর স্বভাব ভারি চাপা। বেলার ঘর-সংসার হয়েছে, স্বামী ও তাঁর আত্মীয়দের জন্য একটা টান হয়েছে, শাশুড়ি আছে মায়ের অভাব কিছুটা পূরণ করবে। মীরা ও শমী ছোট, অভাব অনুভব করবার ক্ষমতা তাদের এখনও ভাল করে হয়নি। রথী হাজার হলেও ছেলে- লেখাপড়া নিয়ে নানা কথায় নানা কাজে ভুলে থাকবার অবসর আছে। আমার বোধ হয়  রাণীর সবচেয়ে কষ্ট হবে। বালিগঞ্জে থাকাতে আদৎ ঘটনাটা ভাল করে বুঝতে পারছে না। জোড়াসাঁকো গেলেও ওর বেশী কষ্ট হবে। রবিকাকা একবার বলেছিলেন, আমরা বোলপুর যদি যেতুম তা হ’লে মীরাকে ও শমীকে আমার সঙ্গে দিতেন। আমি অবিশ্যি কিছু বলতে পারি নে, আমার নিজের বাড়ী হ’লে রানীকে জোর করে নিয়ে আসতুম। এখানে যে রকম খোলা মাঠের হাওয়া আমার নিশ্চয় বিশ্বাস এ রকম কোন জায়গায় এলে খুব অল্প সময়ে ওর শরীর শুধুরে যায়। কথাটা অসঙ্গত মনে হ’লে তুমি কিছু বোলো না।


একবার মীরাকে  দেবার কথা বলেছিলেন বলেই সাহস করে তোমার কাছে লিখলুম। বেলাদের বড় বোন থাকলে তাঁর যে কর্তব্য হ’ত আমি সেই কর্তব্যগুলি আমার মনে করি। কিন্তু মনে করলে কি হবে , আমি স্বাধীন নই ক্ষমতা কিছুই নেই, যদি সামান্য কাজেও আসি সেটা খুবই সুখের মনে করব। কাকীমার কাছে অনেক কারণে ঋণী ছিলুম সে সব ঋণ ইহজীবনে শোধ করতে পারব না। বিবি, তোমাকে কি লিখব বলো, সারাদিন যত কথা মনে হয় সব লিখতে গেলে পাগল মনে করবে। কাকীমার সব রকম চেহারা মনে দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে- শেষ যে চেহারা দেখে এসেছি মনে হচ্ছে ফিরে গিয়ে ঠিক তেমনি দেখব, সেই জন্যই যেন মনটা ফিরে যাবার জন্য ছটফট করছে। তার পরে রবিকাকার একটা বিষণ্ণ মুখের সঙ্গে সঙ্গে যা মনে পড়ে সেটা অসহ্য। আর কখনোও দেখতে পাব না এটা কিছুতেই সহ্য হয় না। একদিন তো আর একসঙ্গে  থাকতুম না ? রোজ একখানা করে চিঠিও লিখতুম না, তবু একটা ভরসা থাকত কোন দিন আসবেন কলকাতায় দেখা হবে। যাক, ওসব কথা ভেবে কোন ফল নেই, তবু মন মানে না তাই থেকে থেকে বলি। সকলেরই জন্ম হ’লেই মৃত্যু আছে; আপসোস এই যাদের গেলে কোন হানি নেই তারাই পড়ে থাকে। এবারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে মৃত্যুই আমাদের শেষ নয় আরও উচ্চতর স্থান আছে, সে স্থানের উপযুক্ত না হলে লোক এ সংসার থেকে বিদায় নিয়ে পারে না। সেই জন্য বেছে বেছে লোক যায়। তা নইলে কাকীমার জীবনের শেষ হবার সময় তো হয়নি? এই শীগগির তাঁর শেষ হবার কি কারণ?  আমার মনে হয় এ সংসারের সম্পূর্ণতা পেলে সেই অদৃশ্য লোকের উপযুক্ত হয়- সেই সম্পূর্ণতা তিনি খুব অল্প সময়ে পেয়েছেন- নতুন জীবন নিয়ে উচ্চতর লোকে চলে গেছেন।


আমাদের সঙ্গে কোন সংস্রব আছে কি না জানি না, কিন্তু আমার সর্বদাই মনে হয় যারা আগে গেছেন তারা আমাকে এবং আমার সব কার্য সর্বদাই দেখছেন, আমাদের দেখবার কোন উপায় নেই। আমার মৃত্যুর পরে তাদের দেখা পাব কি না জানি না কারণ কে জানে কোথায় কি পাপ করেছি, তাদের কাছে যাবার উপযুক্ত হ’তে পারব কিনা। তোমাকে হয়ত অনেক কথা বলে বিরক্ত করছি। কাছে থাকলে কথায় যে আলোচনা হ’তে পারত, চিঠিতে সেইতে চালাচ্ছি। কি বকছি নিজেও জানিনে। আজকাল মাথায় এত কথা এক সঙ্গে আসে মাঝে মাঝে মাথাটা ভয়ানক শ্রান্ত মনে হয়। কাকীমার  জন্য কিন্তু দুঃখ করতে ইচ্ছা হয় না। কারণ তিনি যেখানেই থাকুন সম্পূর্ণ শান্তিতে আছেন এই বিশ্বাস, কষ্ট শুধু যারা আছেন তাঁদের জন্য, রবিকাকার এমন সুখের এমন শান্তির ঘর ভেঙেছে এই দুঃখ, এ দুঃখ রাখবার স্থান নেই। তুমি লিখতে বলেছ তাই যা মনে আসছে তাই লিখছি তা নইলে দ্বিতীয় লোক নাই যাকে ধরে দুটো কথা বলি। কেউ জিজ্ঞাসাও করে না। আজ তবে আসি। রাণী কি রকম থাকে লিখো। মহারাণী খোকা খুকি ভালই আছে। আশা করি তোমরা ভাল আছ। ইতি, অমলা।’