বিয়ের পূর্ব নাম ভবতারিণী। বিয়ের পর, রবীন্দ্রনাথ নাম রাখেন মৃণালিনী দেবী। মৃণালিনীর জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার দক্ষিণডিহির ‘ফুলতলা’ গ্রামে, ১৮৭৪ সালের মার্চ মাসে, বাবা বেণীমাধব রায়চৌধুরী আর মাতা দাক্ষায়ণী দেবী। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মৃণালিনী দেবী শিরোনামের লেখাতে মৃণালিনী সম্পর্কে বলেন, ‘খুলনা জিলার দক্ষিণডিহি গ্রামের শুকদেবের বংশধর, বেণীমাধব রায়চৌধুরীর প্রথমসন্তান ভবতারিণী। তাহার জন্ম বাংলা ১২৮০ সালে। খেলাঘরে ঘরকণ্ণার সময় মৃণালিনীর স্বভাবের একটি বিশেষত্ব সকলেই লক্ষ করিতেন, ইহা সঙ্গিনীদের উপর তাঁহার কর্তিতের সখীসুলভ অধিকার, ইহাতে কর্তিতের সহজাত তাপ-চাপ ছিল না, সখী সুলভ প্রণয় প্রবণতায় ইহা সুস্নিগ্ধ কোমল সহনীয়; সঙ্গিনীরা তাই সখীর নির্দেশ মানিত, খেলা ও চলিত সখী ভাবে অবিরোধে। দক্ষিণডিহি গ্রামে এমন কি গ্রামের চতুর্দিকে ক্রোশের মধ্যেও উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয় ছিল না।  গ্রামে একটি প্রাইমারি পাঠশালা ছিল, এই পাঠশালায় মৃণালিনীর বিদ্যাশিক্ষার সূত্রপাত হয়। প্রথম বর্গ পর্যন্ত  অবাধে পড়াশুনা চলিয়াছিল। কিন্তু সমাজে নিন্দার ভয়ে সুদূর পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হইয়া পরীক্ষা দেওয়া তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইয়া উঠে নাই; কাজেই বাংলা লেখাপড়ার সাধ ইচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হইয়াই তাঁহাকে এই খানেই মিটাইতে হইয়াছিল।’ মৃণালিনীর বিয়ে হয় ৯ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে, দশ বছর বয়সে। আর রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন বাইশ। মৈত্রেয়ী দেবীর রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে গ্রন্থেও পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চিত্র। ‘২২ অগ্রহায়ণ ১২৯০ সালে ৯ই ডিসেম্বর ১৮৮৩ তারিখে রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর ৭ মাস বয়সে, বেনীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। বেনীমাধব রায়চৌধুরী ঠাকুর বাড়ির জমিদারীর সেরেস্তায় কাজ করতেন সামান্য মাইনেয়। তাঁর কন্যার বয়স এগার বছর মাত্র। শোনা যায় তাঁর কথায় যশোর জেলার টান খুব বেশি ছিল বলে বিবাহের পর কিছুদিন পর্যন্ত কথাবার্তা বলেননি। এ দিকে রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলার তরুণ কবি, তাঁর যশ ও প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছে দেশের গুণী সমাজে। তাঁর মন কবিত্বের প্রেরণায় উদ্দীপিত। এই অসম অবস্থার বিবাহ তাঁর পক্ষে রুচিকর হওয়া অসম্ভাব এই রকম অনুমান কেউ কেউ করেছেন।


কলকাতার অভিজাত, একান্নবর্তী পরিবারের আদরের ছোটো ছেলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যিনি ব্যক্তিত্বে সুদর্শন এবং শিল্প ও সাহিত্যেয় প্রতিভাবান পুরুষ। তোরজোড় হচ্ছিল তাঁর বিয়ের জন্য; একই সাথে চলছিল উপযুক্ত কনে দেখার পর্বটিও। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তাঁর স্মৃতি কথায় লেখেন, বিয়ের ব্যাপারে একরকম চাপে পড়েই শেষ পর্যন্ত রাজী হতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের জন্য কনে নির্বাচনের বিষয়টি খুব সহজ হ’য়ে দেখা দিচ্ছে না ঠাকুর পরিবারে। অনেক খোঁজা-খুঁজি ক’রে তাঁরা বার-বার ব্যর্থ হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী, বেণী মাধবের কন্যা ভবতারিণীর সাথেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়। এর জন্য রবীন্দ্রনাথকে বরবেশে দক্ষিণডিহির ‘ফুলতলা’ গ্রামে আসতে হয়নি। বিয়ের পর্বটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে সম্পূর্ণ হয়। রবীন্দ্রনাথের কনে দেখার পর্বে ছিলেন দুই বৌঠান। মেজবৌদি জ্ঞানদানন্দিনী (১৮৫০-১৯৪১) এবং কাদম্বরী দেবী (১৮৫৯-১৮৮৪), ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং আরও অনন্যা ব্যক্তিবর্গ। রবীন্দ্রনাথ, কনে দেখার পর্বে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানামত। নরেন্দ্রপুর গ্রামে, জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে এই দল রবীন্দ্রনাথের জন্য একজন সুন্দরী পাত্রী খুঁজছিলেন। ইন্দিরা দেবীর লেখা ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে  তিনি বলেন, ‘পারিবারিক স্মৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমেই পরিবার পত্তন বা বিয়ের কথা তুলতে হয়। যশোর জেলা সেকালে ছিল ঠাকুরবংশের ভবিষাৎ গৃহিণীদের প্রধান আকর। কারণ সে দেশে ছিল পিরালী সম্প্রদায়ের কেন্দ্রস্থল। শুনেছি সেখানকার মেয়েদের রূপের সুখ্যাতি ছিল, যদিও পুরনো দাসী পাঠিয়ে তাদের পছন্দে নির্বাচন করে আনা হত। পূর্ব প্রথানুসারে রবিকাকার কনে খুঁজতেও তাঁর বৌঠাকুরানীরা, তার মানে মা আর নতুন কাকিমা, জ্যোতিকাকামশায় আর রবিকাকাকে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যশোর যাত্রা করলেন। বলা বাহুল্য, আমরা  দুই ভাইবোনেও সে যাত্রায় বাদ পড়ি নি। যশোরে নরেন্দ্রপুর গ্রামে ছিল আমার মামা বাড়ি। সেখানেই আমরা সদলবলে আশ্রয় নিলুম।’
কিন্তু তিনি প্রিয় বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে স্বয়ং বিবাহের যে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন তা পড়লে মনে হয় না যে তখন কোনো ক্ষোভের, বা দুঃখের ঘটনা ঘটেছে বা অনভিপ্রেত কোনো কাজ তাকে করতে হচ্ছে। চিঠিখানিতে তাঁর স্বভাব সম্মত কৌতুকের ছোঁয়া রয়েছে।
প্রিয় বাবু,
আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক আপন তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকি। বিবাহাদি সম্পন্ন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়গণকে বাধিত করবেন।
ইতি
অনুগত
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’  


রবীন্দ্রনাথের এই বিয়ের ইতিহাস আরো স্পষ্টভাবে জানা যায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে। তিনি লেখেন, ‘১২৯০ সালে চব্বিশে অগ্রহায়ণ রবিবারে রবীন্দ্রনাথের সহিত মৃণালিনী দেবীর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ চতুর্বিংশতিবর্ষীয় যুবক, মৃণালিনী দেবীর বয়স একাদশবর্ষ। বিবাহে ঘটকালি  করিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথের মাতুল ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। প্রচলিত প্রথানুসারে কন্যার পিতা তাঁহার বাড়িতে বর লইয়া বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব করিলে মহর্ষি তাঁহাকে জানাইয়াছিলেন, কলিকাতায় আদি ব্রাহ্ম সমাজের নিয়মানুসারে ব্রাহ্মমতে বিবাহ হইবে। এই প্রস্তাব স্বীকৃত হইলে মহর্ষি দক্ষিণডিহির বাড়িতে নানাবিধ খেলনা বসনভূষণাদি কর্মচারী সনানন্দ মজুমদারের সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন। সনানন্দ মহর্ষি কথানুসারে গ্রামে নানা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাইয়া কন্যার ও প্রতিবেশীর বাড়িতে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহা বোধ হয় ‘কন্যার আশীর্বাদ’ বা ‘পাকা দেখা’র সামাজিক বিধি। বিবাহে মহর্ষি যে বংশ গোত্রের বিবেচনা ছিল, এ বিবাহে তাহার ব্যভিচার হয় নাই। সমৃদ্ধি ও বিদ্যাবত্তায় রায়চৌধুরী বংশ ঠাকুরপরিবারের সমতুল্য না হইলে এই বৈবাহিক সম্বদ্ধে মহর্ষিদেবের মতদ্বৈধ ছিল না। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ব্রহ্মোৎসব দালানে কূল প্রথানুসারে পরিণয়ৎসব শুভ সম্পন্ন হয়। নিমন্ত্রিত আত্মীয় কুটুম্বগণের সহিত মহর্ষি সমাজেতে কনিষ্ঠ পুত্রের শেষ  সামাজিক কার্য নিষ্পন্ন করেন। পিতৃগৃহে কন্যার নাম ছিল ‘ভবতারিণী’, রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে সংগতি রক্ষা না হওয়ায় বিবাহের পরে পরিবর্তিত নাম হইল ‘মৃণালিনী’ রবি-মৃণালিনীর প্রণয়-সম্বদ্ধ কবিকল্পিত, চিরপ্রসিদ্ধ; তাই মনে হয়, এই নাম কবিকৃত কবিকল্পনাজাত। মতান্তরে, কবির প্রিয় ‘নলিনী’ নামের ইহা প্রতিশব্দ। যাহাই হউক, ‘ভবতারিণী’ বধূজীবনে ‘মৃণালিনী’ নামেই পরিচিত হইয়াছিলেন। ‘বৈষ্ণব কবিতায়’ কবি যে ‘ধরার সঙ্গিনী’র চিত্র বর্ণনার নানা বর্ণে রঞ্জিত করিয়া অঙ্কিত  করিয়াছেন তাহা তাঁহার কল্পনামাত্র নহে, ইহা বাস্তবিকের অনুভূতি অনুস্রুত পরিণাম, কবির সেই চিত্রগত বর্ণ কবিপত্নীর সাংসারিক জীবনে নানা বিষয়িনী শক্তিতে মূর্ত ও সার্থক হইয়া ফুটিয়া উঠিয়া ইহা সপ্রমাণ করিয়াছেন।’

গ্রামের পাঠশালাতেই মৃণালিনী দেবীর পড়ালেখার পর্ব শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) আদেশে ১৮৮৪-১৮৮৫ সালের দিকে লরেটো হাউসে  ইংরেজি শিক্ষার জন্য গমন করেন। পরবর্তী সময়ে, রবীন্দ্রনাথের একান্ত ইচ্ছায় (১৮৮৫-১৮৮৬) সালের দিকে পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের নিকট সংস্কৃতি শিক্ষালাভ শুরু। পিতৃগৃহে মৃণালিনী দেবীর বিদ্যাশিক্ষার যে ক্ষুদ্রতম পরিধি তাহা ঠাকুর পরিবারের বধূগণের ও কন্যাদিকের বিদ্যার তুলনায় নিতান্ত নগণ্য। প্রতিভাবান সুশিক্ষিত কবির অনুরূপ স্ত্রীরত্ন লাভ বিরল হইলেও একান্ত বিরল বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু সৌভাগ্যমূলক ভবিতব্যতা সর্বত্র অবাধ; তাই মহর্ষির এই পরিণয়ে অসম্মতির কোনো কারণ ছিল না। কবিও পিতৃদেবের মর্যাদা লঙ্ঘন করেন নাই। কিন্তু সহধর্মিণীকে উপযুক্ত সহধর্মিণী করিবার নিমিত্তে কবি নববধূর ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করিলেন, এমন কি বালিকা বধূকে  লরেটো হাউজে পড়িবার অনুমতি দিলেন। এই সময়ে নগেন্দ্রনাথ দিদির কাছে আসিয়া একটি ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়িতেন। অবসরক্রমে দিদি পড়া বলিয়া দিয়া তাঁহার সাহায্য করিতেন। কখনো কখনো নগেন্দ্রনাথ  দুই একটি ইংরেজি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করিতেন; দিদি অর্থ বলিয়া দিয়া পাঠ বুঝাইয়া দিতেন। পত্নীর ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়াই কবি নিরস্ত হইতে পারেন নাই। রামায়ণাদির সংস্কৃত সহজ শ্লোকের  অর্থগ্রহণ যাহাতে অনায়াসে হয় তিনি সেই উদ্দেশ্যই পত্নীকে মোটামুটিভাবে কিছু সংস্কৃত শিখাইবার নিমিত্তে উদ্যোগী হইলেন এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়কে সংস্কৃত শিক্ষার্থ  নিযুক্ত করিলেন। কবির নির্দেশানুসারে বিদ্যারত্ন রামায়ণের গল্পাংশের শ্লোকের বাংলায় ব্যাখ্যা করিতেন, ছাত্রী সেই ব্যাখ্যা শুনিয়া তাহার বাংলায় অনুবাদ লিপিবদ্ধ করিতেন। এইরূপে রামায়ণের গল্পাংশের অনুবাদ সমাপ্ত হইয়াছিল।  


বলেন্দ্রনাথ সংস্কৃতে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি সংস্কৃতে কাব্য নাটকাদির শ্লোক গদ্যাংশ কখনো কখনো ব্যাখ্যা ও সরল বাংলায় অনুবাদ করিয়া কাকিমাকে বুঝাইয়া দিতেন। এই প্রকারে অনুবাদের সাহায্য ও বলেন্দ্রনাথের  ব্যাখ্যায়, শ্লোকের আবৃত্তি শ্রবণে মৃণালিনী দেবীর সংস্কৃত অর্থবোধে বেশ কিছু পারদর্শিতা জন্মিয়াছিল। রথীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রভবনে মায়ের স্বহস্তে পেন্সিলে লিখিত একখানি খাতা দিয়াছেন। তাঁহার বিশ্বাস ছিল, খাতাখানি মায়ের লিখিত রামায়ণের সেই অনুবাদের পাণ্ডুলিপি। খাতা খুলিয়া দেখিলাম ইহা রামায়ণের অনুবাদ পাণ্ডুলিপি নহে, মহাভারত মনুসংহিতা ঈশোপনিষৎ কঠোপনিষৎ প্রভৃতির অনুবাদ ইহাতে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। কবি এখন সম্পূর্ণ গৃহস্থ  না হইলেও গৃহী হইয়াছেন বলা যায়। বিবাহের পর তিনি পৈতৃক প্রাসাদে নির্ধারিত প্রকোষ্ঠে কিছুকাল অবস্থান করিয়াছিলেন; তখন ঠাকুরপরিবারে সুবিপুল মহর্ষির পুত্র, পুত্রবধূ, পৌত্র-পৌত্রী, কন্যা, দৌহিত্র-দৌহিত্রী, আত্মীয়-কুটুম্ব প্রভৃতির স্থান সুবিশাল ত্রিতল অট্টালিকায়ও যথেষ্ট হইত না।
কাব্যময় জীবন উপভোগ করায় কবির পক্ষে কোনো বাধা ছিল না। একবার তিনি ইচ্ছা করিলেন, গাজিপুরে কোনো নিভৃতে নিবাসে বাস করিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্ভোগে কবিজীবন সফল করিবেন। এই অভিপ্রায়ে ১২৯৪ সালের শেষভাগে তিনি গাজিপুরে যাওয়া স্থির করিলেন। এই সিদ্ধান্তের অজুহাতে তিনি লিখিয়াছেন-
‘বাল্যকাল থেকে পশ্চিম ভারত আমার কাছে রোম্যান্টিক কল্পনার বিষয় ছিল।....শুনেছিলুম, গাজিপুরে আছে গোলাপের ক্ষেত।....তারি মোহ আমাকে প্রবলভাবে টেনেছিল।’  


এখন রবীন্দ্রনাথের পরিবার ক্ষুদ্র। পত্নী মৃণালিনী দেবী, শিশুকন্যা বেলা। এই সংসার লইয়া কবি গাজিপুরে উপস্থিত হইলেন। এইখানে তাঁহার দুর-সম্পর্কীয় আত্মীয় আফিম- বিভাগের একজন প্রধান কর্মচারী গগনচন্দ্র রায় বাস করিতেন। তাঁহার সাহায্য কবির সুখস্বচ্ছন্দে বাসোপযোগী ব্যবস্থা সমস্তই সহজেই সম্পন্ন হইয়াছিল।
সপরিবারে গাজিপুরে বাস সাংসারিক কবি জীবনের প্রথম ও প্রধান পর্ব।  আপনার সংসারে স্বামীকে আপনার মতো করিয়া পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা স্ত্রীমাত্রের পক্ষে স্বাভাবিক। বৃহৎ ঠাকুরপরিবারের মধ্যেবাসে কবিপত্নীর
সে অভিলাষ এ পর্যন্ত অপূর্ণই ছিল। গাজিপুরে বাসে পৃথক সাংসারিক জীবনের সূত্রপাতে তাহা এই প্রথম কার্যে পরিণত হইল; পক্ষান্তরে যৌবনের পরিপূর্ণতায় কবিও এখন প্রথম পাইলেন পত্নীকে ধরার সঙ্গিনীরূপে; প্রণয়িনীরূপে ‘আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানস প্রতিম।’


মৃণালিনী দেবী যখন শিলাইদহে কুঠিরবাড়িতে বাস করিতেন, সেই সময়ে ‘মুলা সিং’ নামে একজন পাঞ্জাবী তাঁহার নিকট আসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে নিজ দুরবস্থা নিবেদন করিয়া কাতরভাবে প্রার্থনা করিল- ‘মাইজী, একটি চাকরি দিয়া আমাকে রক্ষা করুণ, নতুবা আমি সপরিবারে মারা পড়িব।’ দরিদ্রের করুণ প্রার্থনায় মাইজীর কোমল হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে  ছিলেন না, পক্ষান্তরে অপেক্ষা করাও তখন সম্ভাব হইল না। কুঠিবাড়ির দারোয়ান কার্যে মাসিক ১৫ টাকা বেতনে তিনি মুলা সিংকে নিযুক্ত করিলেন। দরিদ্রের দুঃখের কিঞ্চিত অবসান হইল। মুলা সিং- এর দেহ যেমন দীর্ঘ, তেমনই পরিপুষ্ট সুগঠিত। দেহের অনুপাতে দুবেলায় চার সের আটা সে খাইতে পারিত। একমাস চাকরির পড়ে সে দেখিল, তাহার স্বল্প বেতন ভূরিভোজনে নিঃশেষ হইয়াছে। বাড়িতে কিছুই পাঠাইতে পারিল না, বড়োই বিষণ্ণ হইল, ক্রমে ক্রমে ইহা মৃণালিনী দেবীর কর্ণগোচর  হইলে তিনি মুলা সিং’কে ডাকিয়া বিষাদের কারণও শুনিতে চাহিলেন, সেও অকপটে সমস্ত কথা তাঁহাকে জানাইল; ব্যথিত হইয়া মাইজী সেই দিন অবধি প্রত্যহ সংসারের ভাণ্ডার হইতে চার সের আটা দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। বেতন বৃদ্ধি হইল, কিন্তু আটার ব্যবস্থা পূর্ববৎই রহিল। এই সময়ে মৃণালিনী দেবী কুঠিবাড়িতে একটি শাক সবজির বাগান করিয়াছিলেন। ইহা তাহাঁরই তত্ত্বাবধানে ছিল। অবসরমত সময়ে সময়ে মেয়েদের সঙ্গে লইয়া বাগানের কাজকর্মও তিনি করিতেন। যে সকল এস্টেটের কর্মচারী সপরিবারে বাস করিতেন তাহাদের বাসায় এই বাগানের শাক-সবজি তরকারি তিনি পাঠাইয়া দিতেন। অল্পবেতনভোগী আমলাদিগের জন্য সরকারি ব্যয়ে একটি মেস করিয়া সরকারি তহবিল হইতে ঠাকুরচাকরের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এই মেসেও বাগানের শাক-সবজি তরকারি সপ্তাহে দুইবার পাঠাইতেন।                                              
মৃণালিনী দেবী যেইদিন শিলাইদহ  হইতে চলিয়া আসেন সেদিন ঠাকুর চাকর ও আমলাদের বিষাদের সীমা ছিল না, বিশেষত মাইজীর করুণায় অপার দুঃখের পার পাইয়াছিল !  এ যে তাহার পক্ষে বিজয়াদশমীর দিন। বিষাদমলিন সকলকে কাছে আনিয়া মাইজী স্নিগ্ধ সান্ত্বনাবাক্যে বলিলেন, ‘শান্ত হও, আমি আবার আসব, তোমাদের কি কখনো ভুলতে পারি।’ সস্নেহ প্রবোধবাক্যে সকলে কিছু আশ্বস্ত হইল। স্নেহের ইহাই মোহিনী শক্তি ! মহর্ষির কনিষ্ঠা ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের বিধবা পত্নী ত্রিপুরাসুন্দরী মহর্ষির পুত্রবধূগণের কাকিমা। তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকিতেন না, বিরজিতলায় একটি বাড়িতে যাবজ্জীবন বাস করিয়াছিলেন। মহর্ষিদেব এই বাড়ি তাঁহাকে দিয়েছিলেন। মধ্যে মধ্যে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিতে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিতেন, বউমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ-সালাপ, আমোদ-সামোদ করিয়া চলিয়া যাইতেন, বউমাদের
সনির্বন্ধ চেষ্টায়ও কখনও জলগ্রহণ পর্যন্ত করিতেন না। পরম আত্মীয়গণের  সহিত ঈদৃশ বিসদৃশ ব্যবহার আপাতত বিশেষ বিস্ময়জনক। কিন্তু কার্যমাত্রের কারণ থাকে, ইহারও গূঢ় কারণ ছিল। মহর্ষিদেব ভ্রাতৃবধূর মাসহারা এক হাজার টাকার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; কোনো উপায়ে বধূমাতার প্রাণনাশ করিতে পারিলে মাসহারা দিতে হইবে না, এই অমূলক সন্ধেহ ত্রিপুরাসুন্দরীর মনে দৃঢ়মূল হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে মহর্ষির চরিত্রের এইরূপ  অভাবনীয় সন্ধিগ্ধ মনোবৃত্তি স্ত্রীস্বভাবসুলভ পাত্রাপাত্রের বিচারশক্তির অভাবেই সম্ভব হইয়াছিল। যাহা হউক কাকিমার তাদৃশ আচরণের মূলে এই সন্ধেহ সুদৃঢ়ই ছিল। মহর্ষির সদর খাজাঞ্জি প্রতিমাসে মাসহারা  দিতে যাইবেন; তাঁহার মুখে শুনিয়া ছিলাম, কাকিমা হাজার টাকার একখানি নোটই পছন্দ করিতেন, তাহাও বিশেষ পরীক্ষা করিয়া লইতেন। একবার কাকিমা জোড়াসাঁকোয় আসিলে মৃণালিনী দেবী না ছোড় হইয়া তাঁহাকে ধরিয়া বসিলেন; বলিলেন, ‘কাকিমা, আপনি বারবার আসেন যান, একবারও কিছুই খান না; আমি নিজেই মিষ্টান্ন তৈরি করেছি, তা আজ খেতেই হবে।’ বউমার এই অভাবনীয় সনির্বন্ধ আবদারে কাকিমা বিপন্ন হইয়া পড়িলেন, নানা উপায়ে বউমাকে নিরস্ত করার চেষ্টাও করিলেন; কিন্তু বউমার আবদার এড়াইতে পারিলেন না। কাকিমার নিমরাজ ভাব বুঝিয়া সুচতুর বউমা কালবিলম্ব করিলেন না, তখনই বড়ো পাত্রে ভরা নানাবিধ মিষ্টান্ন আনিয়া কাকিমার হাতে দিলেন; বউমার এইরূপ ক্ষিপ্র আয়োজন কাকিমার আর না-না বলিবার উপায় রহিল না। অনন্যেপায় হইয়া পাত্র লইয়া উপবিষ্ট বধূদিককে মিষ্টান্ন কিছু কিছু পরিবেশন করিয়া অবশিষ্ট কিঞ্চিত ভক্ষণ করিলেন। মিষ্টান্নে যদি কিছু প্রাণ নাশক মিশ্রিত থাকে সকলেরই তাহা অনিষ্টকর হইবে- পরিবেশনে কাকিমার এই সন্ধেহমূলক অভিপ্রায় গূঢ় ছিল, ততক্ষণ বউমারা তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। সংকল্পভঞ্জন হইল, সন্ধেহভঞ্জন হয় নাই। সন্ধেহ দুরতিক্রম্য। বলেন্দ্রনাথের বিবাহে জননী প্রফুল্লময়ী দেবী ছোট জায়ের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া লিখিয়াছিলেন-‘বলুর বিবাহে খুব ঘটা হইয়াছিল...আমার ছোট জা মৃণালিনী দেবীও  সঙ্গে যোগ দিয়া নানারকম ভাবে সাহায্য করেন। তিনি আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতে ভালবাসিতেন। মনটা খুব সরল ছিল। সেই জন্য বাড়ির সকলেই তাকে খুব ভালবাসিত।’ পুত্রকন্যাগণের শিক্ষা গৃহবিদ্যালয়ের পত্তন করিয়া কবি যখন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে সপরিবারে বাস করিয়াছিলেন, সেই সময়ে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া মৃণালিনী দেবী কর্মচারীদিগের জন্য জমিদারি কাছারিতে পাঠাইয়া দিতেন। কখনো কোনো কোনো বিশিষ্ট কর্মচারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া কুঠিবাড়িতে খাওয়াইতেন।


বন্ধুবান্ধব লইয়া খাওয়া-দাওয়ার আমোদ কবির স্বভাবে ছিল বড় কম না। একদিন প্রিয়বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে কবি মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। যে কারনেই হউক তিনি যে কেবল পত্নীকে এ কথা বলিতে ভুলিয়াছিলেন তাহা নয়, মধ্যাহ্নভোজকালে তাঁহারও এ কথা স্মরণ হয় নাই। যথাকালে পরিবারবর্গের সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হইল। ভোজনান্তে  কবি নিজকক্ষে বিশ্রাম করিতেছেন, এমন সময়ে বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে নিমন্ত্রিত প্রিয়নাথ কবির বিশ্রাম ভবনে প্রবেশ করলেন। দেখাবামাত্র আপনার বিষম ভ্রমের কথা কবির মনে হইল। বন্ধুকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইয়া পত্নীকে নিমন্ত্রিত বন্ধুর উপস্থিতি জানাইলেন। স্থিরবুদ্ধি কবি পত্নী বন্ধুর সহিত কথা প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিলেন। রন্ধনকুশল ক্ষিপ্র হস্তে খাদ্য প্রস্তুত করিয়া কিছু মিষ্টান্ন আনাইলেন এবং ভোজনপাত্রে সাজাইয়া বন্ধুকে ভোজনগৃহে  আনিবার জন্য কবিকে সংবাদ দিলেন। বন্ধুর সহিত ভোজনগৃহে আসিয়া কবি দেখিলেন, পাত্র পূর্ণ, ভোজ্যর কোনো অংশেই ত্রুটি হয় নাই, সবই প্রস্তুত। দেখিয়াই কবি মনে মনে ধন্যবাদ দিয়া গৃহিণীপনার সার্থকতা বুঝিতে পারিলেন। বন্ধু ভোজন করিলেন। নিপুণ গৃহিণীর বুদ্ধিমত্তায় গৃহীর নিমন্ত্রণ বিভ্রাট ধরা পড়িল না, গৃহিণীর ইহাই দক্ষতা। কবি বলিয়াচেন-‘সা ভার্যা যা গৃহে দক্ষা।’    


বন্ধুসংখ্যা  অল্প হইলেও কবির গৃহে বন্ধুসমাগম অল্প হইত না। এই রূপ ভ্রান্তিমূলক নিমন্ত্রণ বিভ্রাট কবির এই একবারই মাত্র নহে; কবির ভাব বুঝিয়াই মৃণালিনী দেবী নানা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া রাখিতেন, বন্ধুসমাগমে  আর খাদ্য বিভ্রাট ঘটিত না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কবির প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি প্রায়ই আসিতেন, সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে ‘কাকিমা’ বড় ক্ষিদে পেয়েছে’ এই আবদার করিতে করিতে উপরে উঠিয়া আসিতেন। কাকিমা  অপ্রস্তুত থাকিতেন না, সস্নেহ বাক্যে পাত্র ভরা খাদ্যে চিত্তরঞ্জনের চিত্তরঞ্জন  করিতেন। এই স্নেহের দৃশ্য  বড়োই মধুর ! কবি ও লোকেন্দ্রনাথ একই সময়ে বিলাতে মর্লি সাহেবের ছাত্র ছিলেন, সহপাঠিত্বে তাই উভয়ের  সৌহৃদ্য বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। কবির সঙ্গে দেখা করিতে লোকেন্দ্রনাথ প্রায়ই আসিতেন, সুহৃদ পত্নী যথোচিত সমাদরে আতিথ্য করিয়া তাঁহাকে আপ্যায়িত করিতেন। উদার স্বভাব পক্ষপাতহীন। বলেন্দ্রনাথ ও নীতীন্দ্রনাথ কাকিমার কাছে থাকিতেই ভালোবাসিতেন; তাঁহাদের প্রতি কাকিমারও পুত্রবৎ স্নেহ ছিল। অকৃত্রিম স্নেহ এমনই মনোমোহন।’ ঠাকুর পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে মৃণালিনী দেবীর বেশি একটা সময় লাগেনি। যার চিত্র আমরা দেখতে পাই; ১৮৮৯-এর দিকে, রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে প্রথম মঞ্চাভিনয়ে ‘নারায়ণীর’ ভূমিকায় অনবদ্ধ তাঁর সার্থক অভিনয়; যা মুগ্ধ ক’রে ঠাকুরবাড়ীর সকলকে। যদিও তিনি পূর্বে কখনো অভিনয় করেননি। অবনীন্দ্রনাথ ‘ঘরোয়া’য় লিখিয়াছেন, ‘থিয়েটারের অভিনেতা, অভিনেত্রীরা পার্কস্ট্রীটের বাড়ির অভিনয় দেখিয়া যায়, এবং কয়েকদিন পরে এমারেলডে যে অভিনয়  হয় তাহাতে  অভিনেত্রীরা ঠাকুরবাড়ির অভনয়ের ঢং আশ্চর্যরূপে অনুকরণ করিয়াছিল। আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় কবির বিশেষ অর্থকষ্ট  ছিল। ঋণগ্রস্ত হয়ে তিনি বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহন করতেন। পুরী স্থিত পাকাবাড়ি এই  সময়ে তিনি আশ্রম রক্ষনার্থ বিক্রয় করেছিলেন। অলংকার বিক্রয় করে মৃণালিনী দেবী বিদ্যালয়ের পরিচালনায় কবির সহায়তা করেন।    


রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১), তাঁর স্মৃতি কথায় মা মৃণালিনী দেবী সম্পর্কে বলেন, ‘মা আত্মীয়স্বজনের স্নেহবন্ধনের মধ্যে একটি বৃহৎ পরিবারের পরিবেশের মধ্যে ছিলেন। তাঁকে সকলেই ভালোবাসত, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তিনিই প্রকৃতপক্ষে কর্ত্রী ছিলেন। সেই জন্য কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে থাকা তাঁর পক্ষে আনন্দকর হয়নি। অস্থায়িভাবে অতিথিশালার কয়েকটা ঘরে বাস করতে হল, সেখানে গুছিয়ে সংসার পাতার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তাঁর নিজের পক্ষে সেটা যতোই কষ্টকর হোক তিনি সব অসুবিধা হাসিমুখে  মেনে নিয়ে ইস্কুলের কাজে বাবাকে প্রফুল্লচিত্তে সহযোগিতা করতে লাগলেন। তাঁর জন্য তাঁকে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে, নিজের অলংকার একে একে বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন ছাড়া তাঁর কোনো গয়না ছিল না।  মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরানো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে সব অন্তর্ধান হল। বাবার নিজের যা কিছু মূল্যবান সম্পত্তি ছিল তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন। যে বিদ্যালয় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটা তাঁর সাময়িক শখের জিনিস ছিল না।’  


সন্তানদের সাথে মৃণালিনীর সম্পর্ক ছিল মধুর। যে যেখানেই থাকুক না কেন সর্বদা তাঁদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ১৮৯৩-এর মে মাসে কন্যা মাধুরীলতাকে কোনো এক চিঠিতে লিখেন, ‘বাবা মহাশয়, আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনাদের যদি আসা মত হয় তা হলে আষাঢ় মাস থেকে এখানে আসবেন-এ মাসটা সেইখানেই থাকবেন। আমরা সব ভাল আছি। আপনারা সকলে কেমন আছেন লিখবেন। বাবা মহাশয়ের জন্য কচু এর নেবু যদি পারেন তাহলে পাঠিয়ে দিবেন। দিদিমাকে বলবেন যে রবিবার দিন অরুর একটি মেয়ে হয়েছে তারা সকলে ভাল আছে। আর তাঁকে বলবেন যে এখানে আসতে তিনি ওখানে থাকলে সেরে উঠতে পারবেন না। আমার প্রণাম জানিবেন।’    


ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করতেন মার সাথে। মৃণালিনী দেবীকে লেখা কোনো এক চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেন, ‘মা, তোমার চিঠি কাল পেলুম। নিতুদাদার কাছে প্রায়ই যাই। বোলপুর থেকে তেল, কদমা, খেলনা কিনে এনেছি। ওল পেলুম না। আজ সার্কাস দেখতে যাব। কাল বিসর্জন হবে। কাল দেখতে যাব বলে আজ সেটা পড়ে রাখলুম। শুক্রবারে সব জিনিস কিনতে যাব। শনিবারে বিবিদিদির জন্মদিন। বেলা যদি কিছু দেয় ও শীঘ্র পাঠিয়ে দিক। নীদ্দার কাল রাত্তিরে ঘাম হয়ে জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল। আজ সকালে ১০০। অন্যদিন ১০১ হয়। প্রতাপবাবুই দেখছেন। আজ সুহৃদকে দিয়ে examine করবার কথা ছিল। তিনি এখন আসেননি। সাহেব কাল যাবে। সুশী বৌঠান চিঠি লেখেননা কেন ? তাঁর উকুন হয়েছে বলে বোধ হয় খুব ব্যস্ত থাকেন তাই লেখা হয় না। আমরা সব ভাল। তোমরা কেমন আছ লিখ ?’        


রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর ৫ সন্তান। প্রথম সন্তান বেলা বা মাধুরীলতা (১৮৮৬-১৯১৮), দ্বিতীয় সন্তান রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১), তৃতীয় সন্তান রানী বা রেণুকা (১৮৯১- ?), চতুর্থ সন্তান মীরা বা অতসীলতা (১৮৯৪-১৯৬৯) সর্বশেষ সন্তান শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৯৪-?)। রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চিঠিতে মৃণালিনী দেবীকে ‘ভাই ছোট বৌ’ , ‘ছোট ভাই গিন্নি’, ‘ভাই ছুটি’, ‘ছুটকি’ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করেছেন। এ পর্যন্ত স্ত্রীকে লেখা ৩৬টি চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়। লিখিত চিঠির মধ্যে ৩১টিতে সম্বোধন করেছেন ‘ভাই ছুটি’ বলে। মৃণালিনী দেবীর ১৬ থেকে ২৭ বছর বয়সের মধ্যে (১৮৯০-১৯০২) সালের রবীন্দ্রনাথ চিঠিগুলো তাকে লেখেন। বাংলাদেশের শিলাইদহ, কুষ্টিয়া, কালিগ্রাম, সাজাদপুর থেকে লেখা হয় ১৯টি চিঠি। কলকাতা থেকে ৩টি, এলাহাবাদ থেকে ১ টি, মজঃফরপুর থেকে ৯টি এবং শান্তিনিকেতন থেকে লেখা হয় ১টি চিঠি। চিঠির বিষয়বস্তু হিশেবে পাওয়া যায় জমিদারী, সমাজ, সুখ-দুঃখ, প্রকৃতি এবং ভ্রমণ। মৃণালিনী দেবীর স্মরণে রবীন্দ্রনাথ লেখেন একটি কবিতাঃ


দেখিলাম খানকায় পুরাতন চিঠি
স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু-চারিটি
স্মৃতির খেলেনা-কটি বহু যত্নেভরে
গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।
যে প্রবল কালস্রোতে প্রলয়ের ধারা
ভাসাইয়া যায় কত রবিচন্দ্রতারা,
তারি কাছ হতে তুমি বহু ভয়ে ভয়ে
এই কটি তুচ্ছ বস্তু চুরি করে লয়ে
লুকায়ে রাখিয়াছিলে; বলেছিলে মনে
‘অধিকার নাই কারো আমার এ ধনে।’
আশ্রয় আজিকে তারা পাবে কার কাছে !
জগতের কারো নয় তবু তারা আছে !
তাদের যেমন তব রেখেছিল স্নেহ
তোমারে তেমনি আজ রাখেনি নি কেহ ?
                                                                                        
২৩নভেম্বর, ১৯০২ সালে জোড়াসাঁকোতে ২৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মৃণালিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথের পিতা  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) তখনও জীবিত আর রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪১ বছর।