জীবনানন্দ দাশ  হ’তে  চেয়েছেন কবি। রচনা করেছেন কবিতার পর কবিতা। লেখেছেন আরো  অনেক কিছু।  সুখ পাননি ওই সব সৃষ্টিতে । অন্য লেখাগুলো জীবনানন্দ দাশকে ভাবনার বিশ্বে  টিকে রাখে না, যদি না তিনি লিখতেন কবিতাগুলো। সুখ পেয়েছেন কবিতায় ? জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থকারে যতো সংখ্যক কবিতা রয়েছে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে অ-গ্রন্থকারে। সকল কবিতাগুলো রয়েছে একত্রভাবে। যেখানে হাত দিলে পাওয়া যাবে কবিতার পর কবিতা। রবীন্দ্রনাথ-উত্তর     তিরিশি বাঙলা কবিদের মধ্য; তাঁর মতো এতো সংখ্যক  কবিতা অন্য কেউ লেখেননি। কবিতাই যেনো হ‘য়ে উঠে দিবা- রাত্রির এক মাত্র স্বপ্ন। “ধূসর পাণ্ডুলিপি” [১৩৪৩ : ১৯৩৬]... গ্রন্থটি প্রকাশ করেন কবি নিজে, যদিও প্রকাশক হিশেবে রয়েছে অন্য কারো নাম। পয়ার ছন্দে রচিত গ্রন্থটিতে সর্বমোট কবিতার সংখ্যা সতেরটি। উৎসর্গ করেন বাঙলা কবিতার আরেক উজ্জ্বল কবি “বুদ্ধদেব বসুকে”। জীবনানন্দ দাশ “ধূসর পাণ্ডুলিপির” ভূমিকায় বলেনঃ


“আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৪ সালে। কিন্তু সে বইখানা অনেকদিন আমার  নিজের চোখের  আড়ালে হারিয়ে গেছে। আমার মনে হয় সে তাঁর প্রাপ্য মূল্যই পেয়েছে। ১৩৩৬ সালে আর এক খানা কবিতার বই বার করবার আকাঙ্ক্ষা হয়েছিল। কিন্তু নিজ মনে কবিতা লিখে এবং কয়েকটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত ক’রে সে ইচ্ছাকে আমি শিশুর মতো ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। শিশুকে অসময়ে এবং বারবার ঘুম পাড়িয়ে রাখতে জননীর যেরকম কষ্ট হয়, সেই রকম কেমন একটা উদ্বেগ- খুব স্পষ্ট ও নয়, খুব নিরুত্তেজ ও নয়- এই ক’ বছর ধ’রে  বোধ ক’রে  এসেছি আমি। আজ ন’বছর পরে আমার দ্বিতীয় কবিতার বই বার হল। এর নাম “ধূসর পাণ্ডুলিপি” এর পরিচয় দিচ্ছে। এই বইয়ের সব কবিতাই ১৩৩২ থেকে ১৩৩৬ সালের মধ্য  রচিত হয়েছে । ১৩৩২ সালে লেখা কবিতা, ১৩৩৬ সালে লেখা কবিতা- প্রায় এগারো বছর আগের প্রায়  সাত বছর আগের রচনা সব আজ ১৩৪৩ সালে এই বইয়ের ভিতর ধরা দিল। আজ যে- সব মাসিক পত্রিকা আর নেই- প্রগতি, ধূপছায়া, কল্লোল- এই বইয়ের প্রায় সমস্ত  কবিতাই সেইসব মাসিকে প্রকাশিত হয়েছিল একদিন। সেই সময়কার অনেক অপ্রকাশিত কবিতাও আমার কাছে রয়েছে- যদিও “ধূসর পাণ্ডুলিপির” অনেক কবিতার চেয়েই তাঁদের দাবি একটুকুও কম নয়- তবুও সম্প্রতি আমার কাছে তাঁরা ধূসরতর  হয়ে বেঁচে রইল।


ধূসর পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো : “নির্জন স্বাক্ষর”; “মাঠের গল্প”; “সহজ”; “কয়েকটি লাইন”; “অনেক আকাশ”; “পরস্পর”;“বোধ”; “অবসরের গান”; “ক্যাম্পে” ; “জীবন”; “১৩৩৩”; “প্রেম”; “পিপাসার গান”; “পাখিরা”; “শকুন”; “মৃত্যুর আগে
এবং “স্বপ্নের হাতে”। ধূসর পাণ্ডুলিপির  সবচে আলোচিত বা কালের পরিবেশ গত কারনে বিখ্যাত দু’টি কবিতা  হল:“বোধ”এবং “ক্যাম্পে”। কবিতা বিশ্লেষণে বা ভাবগত ধারণার দিক দিয়ে এ দু’টো কবিতাকে জীবনানন্দ দাশের সমস্তকবিতার  মূলসুর  বলা যেতে পারে। দু’টো কবিতা-ই কিংবদন্তী  হ’য়ে রয় জীবনানন্দ দাশের নিকট। অনেক সুর যেনো বেজে যায় কম্পিত কণ্ঠে, যার বহিঃ প্রকাশ রয়েছে কবিতা দু’টোতে। “নির্জন স্বাক্ষর”-এ গ্রন্থের প্রথম কবিতা। কবিতার নামটি পরিবর্তিত হ’য়ে আসে; যার পূর্ব নাম ছিল “পুরোহিত”। কবিতাটি একটু পড়ে নিয়ে যাক :


"তুমি  তা জান না কিছু, না জানিলে,_
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝরে,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে?  
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সে দিন তোমার !  
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল ?
আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে
যে শিশিরের জল,  
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই !-
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে ! –
আমি ঝ’রে  যাব, তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে  ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ‘ পরে,-
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে ! “


তেহাত্তুর পংক্তি বিশিষ্ট কবিতাটির  কয়েকটি পঙতি এখানে উল্লেখ করা হল।  কবিতাটি যেন বার বার রবীন্দ্রনাথের কথা   মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সতেরো বছর বয়সের  প্রেম নির্ভর প্রধান একটি কবিতা “রাহুর প্রেম” [ছবি ও গান : ১৮৮৪]। ক্ষনে ক্ষনে আলো ছায়ার মতো খেলা ক’রে যায় কয়েকটি পংক্তি:


“এ পাষাণ প্রাণ চিরশৃঙ্খল চরণ জড়ায়ে ধ’রে  
একবার তোরে দেখেছি যখন কেমনে
এড়াবি মোরে ? চাও নাহি  চাও, ডাকো
নাই ডাকো,কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব  সাথে সাথে, রব পায় পায়, রব গায় গায় মিশি-
এ বিষাদ ঘোর, এ আঁধার মুখ, এ অস্রুজল,এই ভাঙা বুক, ভাঙা বাদ্যর মতন বাজিবে সাথে সাথে দিবানিশি।“  


বা, একই কবিতায় আবার দেখতে পাইঃ


“অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর কিছু না রহিবে মনে। গভীর নিশীথে জাগিয়া উঠিয়া সহসা দেখিবি কাছে, আড়ষ্ট কঠিন মৃত দেহ মোর তোর পাশে শুয়ে আছে। ঘুমাবি যখন  স্বপন দেখিবি, কেবল দেখিবি মোরে- এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি চাহিয়া দেখিছি তোরে।“  


২.
                    
জীবনানন্দ দাশ এবং রবীন্দ্রনাথের এ কবিতা দু’টো আশ্রিত চরমভাবে প্রেমের বোধ দ্বারা। যেখানে আবেগ আসে প্রেমেরই সৌন্দর্যময় রূপান্তর হ’য়ে। “নির্জন স্বাক্ষর” কবিতাটিতে দেখা যায় কিছু শব্দ, যে শব্দগুলো ৈতরি ক’রে এক প্রকারনিস্তব্ধতা। “হেমন্ত”, “ঘুম”, “শিশির”, “নীল আকাশ”, “নক্ষত্র”, “হৃদয়”, “গভীর”, “দেবতা”, “বোবা”, “বুক”, “শীত”, “মৃত্যু”, “উষ্ণ”, “রাত”, “শান্তি” এবং “গান”। যদিও জীবনানান্দের কবিতায় এ শব্দগুলো ফিরে আসে বার বার এবং বহুবার। এ সকল শব্দের সীমাবদ্ধতা শুধু “নির্জন স্বাক্ষরই” নয়; রয়েছে তাঁর ব্যাপক-বিস্তৃত ব্যবহার সমস্ত কবিতা জুড়ে। “মাঠের গল্প”কবিতার অন্তভুক্ত রয়েছে চারটি কবিতা (মেঠো চাঁদ, পেঁচা, পঁচিশ বছর পরে এবং কার্ত্তিক মাঠের চাঁদ)। এ কবিতায় আমরা পাই নিঃসঙ্গ এক কবিকে, যিনি নিমগ্ন আছেন মৃত্যুযন্ত্রনা বোধের মধ্য। এবং করুন স্বরে যখন বলেনঃ        


“সময় আসিয়া গেছে, - চ’লে গেছে কবে !
শস্য  ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে
রয়েছে দাঁড়ায়ে....”


“পেঁচা” কবিতায় কবি আবার ফিরে আসেন এক বাথিত হৃদয় নিয়ে। যে হৃদয় আজ আর স্থির নয়, ক্লান্ত শরীর যেন আর এগোতে চায় না। যেন বসে আসেন কোনো এক অপেক্ষায়; যেখানে আর কোনো শিশির নেই, নেই ঘরে ফেরার কোনো তাড়া।
তাই বলেনঃ    


“মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে
জেগেছিল অঘ্রানের রাতে
এই পাখি !
নদীটির শ্বাসে
সে- রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশ- পাতা- মরা ঘাস- আকাশের তারা,
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে  ফোয়ারা !  
ধানক্ষেত-মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে    
ধারালো কুয়াশা !  
ঘরে গেছে চাষা ;
ঝিমায়েছে এ পৃথিবী
তবু আমি পেয়েছি যে টের
কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের  
কোনো সাধ!"


দু’চোখের ঘুম যেনো আর ফিরে আসে না। ক্লান্ত শরীর যেন সাধ- আহ্লাদ হীন হ’য়ে পরে; কোনো আহ্বান কবিকে যেনো আর আবেদন জাগায় না। নিজের ক্লান্ত শরীররের সাথে পৃথিবী ও যেনো ঝিমিয়ে প’ড়ে।“পেঁচা” নামের কবিতা  জীবনানন্দে  এই প্রথম নয়; এ নামে কবির পাওয়া যাবে আরও অনেক কবিতা। পরের কবিতাটি “পঁচিশ বছর পড়ে”।  
যে কবিতাটিতে অধরা থেকে যায় ভালোবাসার মানুষটি। তাকে আমরা আর সামনে পাই নে, কিন্তু অপেক্ষায় কেটে যায় আরও পঁচিশ বছর। কবি প্রকাশ করেনঃ “শেষ বার তাঁর সাথে যখন হয়েছে দেখা মাঠের উপরে/ বলিলামঃ


‘একদিনএমন সময়/আবার আসিও তুমি- আসিবার ইচ্ছা যদি হয় !/ পঁচিশ বছর পরে”। কবি আহ্বান করেছেন তাকে আবার ফিরে আসার জন্য;  কিন্তু সেই সাথে আরোপ করেন না কোনো বাধ্যবাধকতা। বলেন অকুণ্ঠস্বরে ‘আসিবার ইচ্ছা যদি হয়’। তেত্রিশ পংক্তি বিশিষ্ট কবিতাটিতে পাওয়া যাবে না কোনো প্রেমিকের নাম; যে দাঁড়িয়ে আছে কবির  সামনে। কবিতাটির শুরুই হয় এক প্রকার অনুক্তভাব দ্বারা, যেখানে পাই না শরীরী কোনো ব্যক্তিকে। আলো-আধারের এ সংমিশ্রণ থাকে সম্পূর্ণ কবিতাটি জু’ড়ে।‘শেষ বার তাঁর সাথে যখন হয়েছে দেখা’...কার সাথে, কখন, কিভাবে দেখা হয় আমরা তা আর জানতে পারিনা। আমরা জানতে পারি না ‘তাঁর’ সম্পকিত ব্যক্তিটি কোন সম্পর্কে আবদ্ধ কবির সাথে? জীবনানন্দের অন্য কাব্যগ্রন্থ গুলোতে  যেমন আমরা পাই অনেক নারীর নাম। তারা শরীরী  না  অ-শরীরী তা আমাদের  নিকট গৌণ হ’য়ে দেখা দেয় না। বরং দেখা দেয় কতগুলো নাম হ’য়ে।‘‘বনলতা সেন’’ ,’’অরুণিমা’’, ‘’সান্যাল’’, “সুদর্শনা’’, ‘‘শ্যামলী’’, ‘‘শঙ্খমালা’’, ‘‘সুরঞ্জনা’’, ‘‘সবিতা’’, ‘‘সুচেতনা’’  ইত্যাদি নামগুলো ফি’রে ফি’রে আসে  জীবনানন্দের কবিতায়। এই ‘তাঁর’ তাদের মধ্যে হয়তো একজন হ’য়ে রয়। পঁচিশ বছরের আহ্বান শেষ হ’য়ে যায় কিন্তু হিম আকাশের গায়ে কবি তাঁর আর দেখা পান না। তাই ব্যথিত চিত্তে কবি বলেনঃ “পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে”! পরের কবিতাটি  “কার্ত্তিক মাঠের চাঁদ” যার প্রথম পংক্তি ‘‘জেগে উঠে হৃদয়ে আবেগ”। কবির সুপ্ত হৃদয় আজ যেন আবেগ-আপ্লুত, ব্যথিত হৃদয়ে আবেগ সব সময় জাগ্রত ছিল। কবি কখনও সেটা বুঝতে পেরেছেন আবার কখন তা পারেননি। কবিতাটির প্রথম পঙতি আমাদের ম’নে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের “নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ”[প্রভাত সঙ্গীতঃ ১৮৮৩] কবিতাটির সেই পঙতি “না জানি কেন রে এতদিন  পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ”। খুব বেশি বৈসাদৃশ্য  থাকে না  উভয় পংক্তির মধ্য।


কবি আবার যখন বলেনঃ
                                        
“মৃত সে পৃথিবী  এক আজ রাতে  ছেড়ে দিল যারে !
ছেঁড়া- ছেঁড়া  শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে”  

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় থাকে চিত্ত-কল্পের এক অভূতপূর্ব  সমন্বয়। যেখানে খেলা ক’রে এক গভীর সৌন্দর্যবোধ। ব্যক্তির ‘মৃত’ বোধটিকে কবি সাদৃশ্য ক’রে তোলেন পৃথিবীর সাথে এবং ভাবনা ও চিন্তার কল্পনা রাজ্যয় সে আর টিকে থাকে না, অবস্থান নেয় এক কল্পিত জগতে। ‘ছেঁড়া-ছেঁড়া  শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চ’লে’... কে, কখন বা কেন চ’লে গেল তা আমরা  আর জানতে পারি না। কিন্তু, এতটুকু বলতে পারি তার  অবস্থান আর আমাদের মাঝে নেই। পরক্ষনে আবার যখন বলেন...”পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়, একদিন হয়েছে যা”। তিনি যেনো এক পরিশুদ্ধ পৃথিবী দেখতে পাচ্ছেন; যেখানে আর পূর্বের ন্যায় কোনো কিছু ঘটা সম্ভাব নয়।“সহজ” কবিতায় কবি আবার ফিরে আসেন একজন তীব্র বিরহীপ্রেমিক হ’য়ে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যখন আমরা দেখতে পাই একজন ব্যথিতচিত্তের প্রেমিকের হা-হা কার বা শূন্যতাবোধ বা তার গভীর হৃদয় ভাঙার শব্দ। যে আর কখন  ফিরে আসে না এই পৃথিবীতে। কখনও  সে মিশে যায় শাদা মেঘে, শঙ্খচিল, সমুদ্রের ঢেউ, কার্ত্তিক নবান্নের দেশে এক লক্ষ্মী পেঁচা হ’য়ে। কিন্তু এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে সে আবার ফিরে আসবে এই দেশে। সেই প্রেমিক আবার কণ্ঠভ’রে তু’লে নেন গান, যে গান তার নিজের প্রতিচ্ছবি হ’য়ে সাড়া দিতে চায় অন্য কাউকে। যে কণ্ঠস্বরে দোলা জাগাবে এবং অন্ধকারে খুঁজে নিবে তাকে। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির’ “সহজ”  কবিতাটি একটু পড়া যাকঃ        
                              
“আমার এ গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে,-
আজ রাত্রে আমার আহ্বান ভেসে যাবে পথের বাতাসে,
তবুও হৃদয় গান আসে !  
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি,-
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে !
পৃথিবীর  কানে নক্ষত্রের কানে
তবু গাই গান !
কোননোদিন শুনিবে না তুমি তাহা,- জানি আমি,
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,
তবুও হৃদয়ে গান আসে!"


কবি আহ্বান করেন তার চিত্রেদোলা লাগানো সেই প্রেমিকার নিকট; যার জন্য তিনি গানে সুর তু’লে আনেন আপন মনে। করুন কণ্ঠে তু’লে আনেন সেই গান, যে গান তার-ই কণ্ঠে সু-মধুর হ’য়ে উঠে। কবি জানেন এ গান কোনোদিন   তিনি শুনবেন না, তার পর ও সান্তনা খোঁজেন আপনমনে। সব কিছুর পরও কবি গানকে ধারন করেন হৃদয়ের অভ্যন্তরে, যেখান থেকে বার বার-ই ভেসে আসে অন্য কোনো বাতাস। যে বাতাসের মাঝে কবি খুঁজে পান গানের  সুরমূর্ছনা। পূর্বের কবিতায় যে হৃদয় আবেগ-আপ্লুত হ’য়ে রয়, আবার ক্ষণিক প’রে সেই হৃদয়ে সুর ভেসে উঠে। সব কিছুর পরও কবি হৃদয়ে স্থান ক’রে নিতে চান তার অনুক্ত বানীগুলো। রাতের আহ্বান কবির নিকট মিছে ঢেউ ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। ব্যথিত হ’য়ে কবি প্রকাশ করেন “তুমি জল, তুমি ঢেউ, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন”। যার কোনো সীমা পরিসীমা নির্ধারিত নেই। কবিতাটির শেষের অংশে এক আদিম রাতের ঘ্রাণ এবং নিঃসঙ্গ বুকের সাথে একাকার ক’রে যে নিশীথের বাতাস গাঁয়ে লাগে তার স্বাদ নিয়ে কবি “একরাত্রি”র মাঝে বেঁচে থাকতে চান। যে রাত হ’য়ে উ’ঠে  স্বপ্ন-কল্পবাস্তবতার এক অভূত মিশ্রণ। “কয়েকটি লাইন”  ক্ষুদ্র কবিতা নয়। একশো আটাত্তুর পংক্তি নিয়ে রচিত হয় কবিতাটি। যদিও কবিতাটির নাম “কয়েকটি লাইন”। জীবনানন্দ এখানে দেখাতে চান অনুক্ত সে বাণীর কথা, যে বাণী এখনো পৌঁছেনি  অন্যর নিকট; যা তিনি ধারন ক’রে আছেন। পূর্বের কবিতায় আমরা গানের কথা শুনেছি; আবার এখানে এসে আমরা পাবো সুরের এক মৃদু মুর্ছুনার কথা। ‘একদিন শুনেছ যে সুর’... এ সুর আর নতুন ম’নে হয় না, আমদের নিকট। যেহেতু তা শুনা হয়ে গেছে  পূর্বেই। ঢেউ এর কম্পিত বাতাস এখানেও লেগে থাকে। জীবনানন্দ দাশ “কয়েকটি লাইন” কবিতায় এক ব্যথিতো-স্বপ্নভঙ্গ  হৃদয়ের কথা আমাদের শুনাতে চান। তিনি তা  দ্রুত বলতে চান না, সেই সব কণ্ঠনিঃসৃত কষ্টের কথাগুলো; বলতে চান ধীর- স্থির ভাবে। কখনও আবার তা থেমে থেমে। কখনও তা  ব’লে উঠেন ঢেউ এর মতো, সুর-অন্ধকার বা সব হারানো এক পবিত্রপুরোহিতর কণ্ঠে। ম্লান কণ্ঠে  তিনি যেনো  বলতে চান যা আজও বলা হয়ে উ’ঠে নি; সেই সব শ্রুতিময় বানীগুলো। কবির কণ্ঠে মিল রেখে তিনিও বলেনঃ


“উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,
পড়ি নাকো দুর্দশার গান,
যে কবির প্রাণ
উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে,
সেই কবি- সে- ও যাবে স’রে;
যে কবি পেয়েছে শুধু যন্তনার বিষ
শুধু জেনেছে বিষাদ,
মাতি এর রক্তের কর্কশ স্বাদ,
যে বুঝেছে, প্রলাপের ঘোরে
যে বকেছে, সে- ও যাবে স’রে;
একে- একে সবি
তবু বলিতে কি পারো
যাতনা পাবে না কেউ আরো ?
যেই দিন তুমি যাবে চ’লে
পৃথিবী গাবে কি গান তোমার পাতা খুলে ?
কিংবা যদি গায়, পৃথিবী যাবে  কি তবু ভুলে
একদিন সেই ব্যথা ছিল সত্য তার ?
আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার
সে দিনের  পুরনো আঘাত
ভুলিবে সে ? ব্যথা যারা সয়ে গেছে রাত্রি- দিন
তাহাদের আর্ত ডান হাত
ঘুম ভেঙে জানাবে নিষেধ;
সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ
ভুল মনে হবে।“


জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় তু’লে আনেন এক কবিরা কথা, যে আর থাকবে না তাদের মাঝে। যার রয়েছে শুধু বিষাদ ও যন্ত্রণা। সবাই যেন এক শূন্যতার মাঝে বসবাস করছে। এই শূন্যতা সাময়িক নয়; বরং তা হ’য়ে উঠে সমগ্র জীবনের এক হা-হা কার। কবিতাটি যেন হ’য়ে উঠে বেদনাগাঁথা কোনো এক বিষাদের গল্প। যেখানে  জীবনানন্দ দাশ  তাঁর কবিতায় দেখাতে চান হৃদয়, মন এবং শূন্যতার গান। যে গানে সুর রয়েছে, কিন্তু তা আর হৃদয়-মনে কম্পন জাগাতে পারে না। এ সুর যেনো হ’য়ে উঠে ব্যর্থ সঙ্গীতের প্রলাপ। কবি, এই কবিতায়  শুধু বিষাদের চিত্র-ই অঙ্কিত করেছেন আপন মনে। যা ভর ক’রে  শুধু কবির মনে। পৃথিবীর সব রঙ, রস আর তাঁর গন্ধ যেনো হ’য়ে উঠে বিষাদের এক আবাসভূমি। যেখানে কবি বিচরণ করছেন আপন মনে। একই কবিতায় জীবনানন্দ দাশ আবার বলেনঃ        


“ঘুমাতে চাও কি তুমি ?
অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই ?
ঢেউয়ের গানের শব্দ  
সেখানে ফেনার গন্ধ নাই ?
কেহ নাই, আঙুলের হাতের পরশ"                                           (চলবে...)