প্রেমে অনন্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হাত বাড়িয়েছেন নিজের মত করে; যাদের ভালোবেসেছেন মন প্রাণ দিয়ে। কখনো তাঁদেরকে নিয়েছেন মনের গভীরে। একইভাবে, তাঁরাও রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছেন মন উজার করে। ব্যথিত হৃদয় যেনো কোনো এক অজানাতে প্রবাহিত হতে থাকে মনের অভ্যন্তরে নিবিড় ভালোবাসায়। রবীন্দ্রনাথের এই বহু বিচিত্র জীবনে কে আগে বা প্রথম এসে সম্পূর্ণ ভাবে দখল করেছে তাঁকে তা আজ অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। তবুও, কারো কারো মতে, আজ এসে শোনা যায় কাদম্বরী দেবীর কথা। যিনি প্রথম নাড়া দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তিনি কি রবীন্দ্রনাথকে ভেঙ্গে ছিলেন ? না, গ’ড়ে ছিলেন নিজের মতো করে ! রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়- এ সম্পর্কে তাঁর রচিত ‘রবীন্দ্রজীবনীর’ প্রথম খণ্ডে বলেনঃ ‘দেশে ফিরিবার পর সব থেকে আদর-আপ্যায়ন পাইলেন তাঁহার নূতন বৌঠাকুরানীর কাছ হইতে। কাদম্বরী দেবীর বয়স এখন প্রায় একুশ বৎসর; তিনি নিঃসন্তান। তাঁহার নিরুদ্ধ নারীহৃদয়ের সমস্ত স্নেহ প্রেম প্রীতি ছিল রবিকে ঘিরিয়া। নয় বৎসর বয়সে বালিকাবধূ-রূপে তিনি যখন এই গৃহে প্রবেশ করেন, তখন সাত বৎসরের বালক রবি ছিল তাঁহার খেলার সাথী, গল্পের সঙ্গী; চৌদ্দ বৎসর তাঁহাকে নিরন্তর পাইয়াছিলেন। স্বভাব-কোমল নারী হৃদয়ের সকল আকাঙ্ক্ষা রবিকে ঘিরিয়া সার্থক হইয়াছিল।তিনি তাঁহার নিঃসঙ্গ স্নেহাতুর জীবনের মধ্যে রবিকে পুনরায় ফিরিয়া পাইয়া যে নিরতিশয় আনন্দিত হইয়াছিলেন, তাহা আমরা কল্পনা করিতে পারি। রবীন্দ্রনাথও যে সুখী হইলেন তাহা বলা নিষ্প্রয়োজন; বিলাতে থাকিতে তাহাঁরই কথা সব থেকে বেশি করিয়া মনে পরিত। তাহাঁরই স্নেহময় আঁখি ধ্রবতারকার ন্যায় সর্বদা তাঁহার সম্মুখে বিরাজ করিত। বিলাত হইতে দেশে যখন ফিরিলেন,বাড়িতে তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও অক্ষয় চৌধুরী দেশী ও বিলাতি সুরের সাহায্যে সঙ্গীতের নানারূপ পরীক্ষায় রত, বাংলা গানে নূতন নূতন রূপসৃষ্টির সাধনায় উভয়েই তন্ময়। এই ঘটনাই সামান্য হইলেও বাংলার সঙ্গীতচর্চার ও বিশেষ করিয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতরচনার ইহিহাস স্মরণীয়। দেশী ও বিলাতি সুরের সংকরমিশ্রণ এমনকি দেশী সুরের রাগরাগিণীর মিশ্রণেও প্রাচীনপন্থীদের ঘোর আপত্তি। কিন্তু যাঁহারা গানের বিশুদ্ধতা নষ্ট হইল বলিয়া বিলাপ করেন, তাঁহারা ভুলিয়া যান যে চিরদিনই দেশী ও বিদেশী সুরের মিশ্রণে নবতর সুরের সৃষ্টি হইয়াছে; আজ আমরা যাহাকে মার্গসঙ্গীত বলি তাহা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লিষ্ট হইলে শেখা যাইবে যে তাহার অনেকখানি সংকার; বিশুদ্ধ সঙ্গীত আদিম জাতির মধ্যে ছাড়া আর কোথাও থাকিতে পারে না।


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখ তরুণের দল যে-দুঃসাহসিকতার পথ উন্মোচন করিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই পথ বিস্তারিত করিয়া দিলেন; বিচিত্র সুরের সঙ্গে অনির্বচনীয় ভাবরাজি ও অনিন্দনীয় ভাষার উদবাহ সম্পন্ন করিয়া বাংলাসাহিত্যে বাঙালির সাংস্কৃতিক  জীবনে যুগান্তর সাধন করিলেন। বিলাত হইতে ফিরিয়া রবীন্দ্রনাথ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই সঙ্গীতগোষ্ঠীভুক্ত হইলেন। এতদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরসৃষ্টিতে ভাষা দান করিতেন অক্ষয় চৌধুরী, এবার তাহাতে যোগদান করিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইতিপূর্বে এই দেশী ও বিদেশী সুরের ঘাত-প্রতিঘাতে সৃষ্টি হইয়াছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘মানময়ী’ নামে গীতনাট্য। রবীন্দ্রনাথ বিলাত হইতে আসিয়া দেখিলেন যে নাটকখানি প্রায় সম্পূর্ণ হইয়াছে, তিনি শেষ দিকে একটি গান যোজনা করিয়া দিলেন-‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি’ ইত্যাদি। নাটক রচনা করিয়া তাহার অভিনয়মূর্তি না দেখিতে পাইলে যথার্থ আর্টিস্ট লেখকরা সুখী  হইতে পারেন না; মানময়ীর অভিনয় হইলো। ইহাতে রবীন্দ্রনাথ মদনের, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইন্দ্রের ও তাঁহার পত্নী কাদম্বরী দেবী উর্বশীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বলিয়া শুনিয়াছি। এই মানময়ীকে বাংলা সাহিত্যের গীতনাট্য রচনার প্রথম প্রচেষ্টা বলা যাইতে পারে- কারণ ইহাতে গান ছাড়া গদ্যে কথাবার্তা ছিল। ইহার এক বৎসর পরে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ রচিত ও অভিনীত হয়; সেটি খাঁটি গীতনাট্য, কারণ তাহাতে সকল কথাবার্তাই গানের দ্বারা সম্পন্ন হয়।’                                    
      
রবীন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর সখ্যতা কতটা প্রবল ছিল তার অনেকটা প্রকাশ পায় এই স্থানে। একই সাথে বেড়ে উঠে দু’জন মানুষ। সাত বছরের কিশোর রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর এক মাত্র খেলার সাথী। একই আবর্তে ঘেরা থাকে দু’জনের জীবন। বেড়ে উঠেন ঠাকুর বাড়িতেই। কাদম্বরী, কখনো এসেছেন রবীন্দ্রনাথের খুবই কাছাকাছি; আবার কখনো থেকেছেন ছায়ার মতো ঘিরে। কোনো এক অপার্থিব সৌন্দর্য যেন ঘিরে রাখে এই ভালবাসার মানুষ দু’জনকে। তাঁরা যেন বাধা পরে থাকেন আত্মার এক গভীর বন্ধনে। যে বন্ধন কখনো পৃথক করতে পারে না  তাঁদের ভালোবাসাকে। কাদম্বরীর ভূমিকা কতোটা প্রভাব ফেলেছিল রবীন্দ্র সাহিত্যেয় ? রবীন্দ্রনাথের গভীরে কি আঘাত করেননি কাদম্বরী দেবী ! কোনো এক কথা প্রসঙ্গে কাদম্বরী, রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন ‘তুমি বিহারীলাল থেকে বড় কবি হতে পারবে না ? এই ধরনের কথাকে কি বলা যেতে পারে তা আর আমাদের মাথায় ঢুকে না। সেদিনের সেই ছোটো প্রশ্নের মর্মে কি লুকিয়ে ছিল; যা অনেক তাৎপর্যময় হ’য়ে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের জীবনে।  সে দিনের সেই ছোটো একটি কথা হয়তো অনেক পথ এগিয়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে। কতোটা সত্য হ’য়ে দেখা দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর মাঝে এ সম্পর্কটি।


এ সম্পর্কের নানা দিক দিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গ্রন্থ; আজও রচিত হচ্ছে। সম্পর্কের অনেক অংশ নানাভাবে লুপ্ত ছিল; তা প্রকাশ পায়নি বিস্তারিতভাবে। কয়েকজন লেখক এটি নিয়ে লিখেছেন দীর্ঘ গ্রন্থ। তাঁদের মধ্যে বাদ জাননি রবীন্দ্রজীবনী কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও। টেনে এনেছেন ঠাকুরবাড়ীর অভ্যন্তরীন ঘটনা। সেখান থেকে বাদ জাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাদম্বরী দেবীও।


চিত্রা দেব, তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল’ গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর সম্পর্কের নানা দিকগুলো। তুলে এনেছেন এ-সম্পর্কের বিভিন্ন উপাত্ত। এ গ্রন্থে তিনি বলেনঃ ‘কোন কিছুই কারুর জন্য থেমে থাকে না। বিশাল ঠাকুরবাড়ীর এক কোণে যখন প্রফুল্লময়ীর জীবনে দুর্ভাগ্যর কালোছায়া নেমে আসছে ঠিক তখনই বাড়ীর আরেক প্রান্তে বেজে উঠছে খুশির সানাই বারোয়াঁ সুরে। চতুর্দোলায় চড়ে আর একটি ছোটো মেয়ে ‘গোধূলি লগ্নের সিঁদুর রঙে’-রাঙ্গা চেলি পরে প্রবেশ করলেন ঠাকুরবাড়িতে। তাঁর কাঁচা শামলা হাতে সরু সোনার চুরি, ‘গলায় মোতির মালা সোনার চরণচক্র পায়ে।’ বাড়ীর ছোটো ছেলেটির হঠাৎ মনে হল এতদিন যে রাজার বাড়ী খুঁজে খুঁজে সে হয়রাণ হয়েছে, খুঁজে পায়নি, সেই বাড়িটিরই বুঝে খবর নিয়ে এলো এই রূপকথার
রাজকন্যে, তাঁর নতুন বৌঠান। কল্পনার দৌড় গেল বেড়ে।


কাদম্বরী যশোরের সেই পরিচিতি রায়বংশের মেয়ে নন, তিনি কলকাতা বাসিনী। তাঁর বাবা শ্যামলাল গাঙ্গুলির সঙ্গে ঠাকুরবাড়ীর যোগাযোগ অনেকদিন ধরেই ছিল। কাদম্বরীর পিতামহ জগন্মোহনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণির। কাজেই এ বিবাহে মহর্ষির আপত্তি ছিল না। বাধা দিয়েছিলেন তাঁর মেঝ ছেলে সত্যেন্দ্র। তিনি তখন বিলেত থেকে ফিরে এসেছেন, চোখে কত রঙ্গিন স্বপ্ন ! ছোটো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রের বধূ রূপে তিনি মনে মনে মনোনীত করে রেখেছেন ডাক্তার সূর্যকুমার গুডিব চক্রবর্তীর মেয়েকে। শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে ভাইয়ের বিয়ে হবে, তার বদলে কিনা বাল্যবিবাহ আট বছরের একটি খুকি ?  এরপরে কি জ্যোতি  বিলেত যাবে ? যদি যায় তো  ফিরে এসে কি এই ছোট্ট মেয়েটিকে জীবনসঙ্গীরূপে গ্রহণ করতে পারবে ? শেষে নষ্ট হয়ে যাবে না টো দুটি অমূল্য জীবন !  কিছুতেই কিছু হল না। ‘একে পিরালী তায় ব্রাহ্ম’ ঠাকুরবাড়ীর অবস্থা তখন ‘একঘরে’ হওয়ার মতো, তাই জ্যোতিরিন্দ্রের জন্য যে মেয়ে পাওয়া গেছে তার সঙ্গেই বিয়ে হল। সত্যেন্দ্রের সমস্ত আশংকা মিথ্যে করে দিয়ে কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ীর যোগ্যতমা বধূ হয়ে উঠলেন। তিনি এ বাড়িতে এসে তিনতলার ছাদের ওপর গড়ে তুললেন ‘নন্দন কানন’। বসানো হল পিলের ওপর সারি সারি লম্বা পাম গাছ, আশেপাশে চামেলি, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা। এলো নানা রকম পাখি।  দেখতে দেখতে বাড়িটির চেহারা যেন বদলে গেলো। গৃহসজ্জার  দিকে নববধূর প্রথম থেকেই সতর্ক দৃষ্টি ছিল। কিশোর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধকে সবচেয়ে উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন এই কাদম্বরী, সেই বাঁধন কোনদিন শিথিল হয়নি।


ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের যা কিছু দান, তার সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কাদম্বরী। অথচ, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, নিজে তিনি কোন কিছুতেই অংশগ্রহণ করতেন না। শুধু অপরের প্রাণে প্রেরণার প্রদীপটিকে উজ্জীবিত করে তোলাই ছিল তার জীবনের ব্রত। আসলে আমরা যাকে বলি রোমান্টিক সৌন্দর্যবোধ, কাদম্বরীর সেটি পুরোমাত্রায় ছিল। ঠাকুরবাড়ীতে এসে অনুকূল পরিবেশ হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছিল কিন্তু এই চেতনা ছিল তাঁর মানস গভীরে। তাই বাইরে থেকে এসে এ বাড়ীর প্রাণপুরুষকে জাগিয়ে দিতে তিনি যতখানি সফল হয়েছেন আর কেউ তা পারেননি।


কাদম্বরীকে নিয়ে এত বেশি আলোচনা হয়েছে যে তাঁর সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলতে চেষ্টা করা বাহুল্যমাত্র। অবশ্য এই আলোচনা- সমালোচনার কারণ রবীন্দ্রনাথ। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনোগঠনে কাদম্বরীর দান অসামান্য। তাঁর অকালমৃত্যু রবীন্দ্রমানসে গভীর ছাপ রেখে যায়। একথা কবি নিজেই অসংখ্য কবিতায় ও গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন।  সুতরাং যারা তাঁদের নিয়ে অনেক কল্পনা এবং কষ্ট-কল্পনা করেন তাঁদের সুযোগ করে দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, একথা বললে খুব ভুল বলা হবে না। কবি নিজেও জানতেন সেকথা। তাই কৌতুক করে শেষ বয়সে বলতেন, ‘ভাগ্যিস নতুন বৌঠান মারা গিয়েছিলেন তাই আজও তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখছি- বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা হত’ !  


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে কিছুটা গোঁড়ামির পরিচয় দিলেও সত্যেন্দ্রে জ্ঞানদানন্দিনীর প্রভাবে নব্যভাবের নেশায় মেতে উঠলেন। সাবেকী সংস্কার ত্যাগ করে তিনি কাদম্বরীকেও  ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিলেন এবং গঙ্গার ধারে নির্জনে শিক্ষাপর্ব শেষ হলে কাদম্বরী প্রতিদিন স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন। তাঁদের দেখে অবাক বিস্ময়ে যারা কানাকানি করত তাদের কথা প্রথমেই বলেছি। কাদম্বরীর অশ্বারোহণ বেশ আলোড়ন জাগিয়েছিল। কাদম্বরী ঠিক কোন সময় ঘোড়ায় চড়তেন সে কথাও জানা যায়নি। কেউই সঠিক সময় নির্দেশ করেননি। তবে এ ব্যাপারে কাদম্বরীকে একমাত্র ‘অশ্বারোহিনী বঙ্গললনা’ বলা চলে না। কারণ আরও কয়েকজনের কথা আমরা শুনেছি। তাঁরা কাদম্বরীর পূর্ববর্তিনী হয়তো নন কিন্তু সমসাময়িক বা অল্প পরবর্তী যে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। য়ুরোপীয় শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে আধুনিকেরা ঘোড়ায় চড়া শিখতেন। কাদম্বরী শুধু ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেই বেরিয়েছিলেন তা নয়, সাধারণী নারীদের চোখে একে দিয়েছিলেন এক দুঃসহ স্পর্ধার মায়াঞ্জন, অনেকের বুকে তিনি জাগিয়েছিলেন দুঃসাহস। মেয়েরা দেখল হাল্কা হাওয়ায় উড়ে আশা বুদ্বুদের ফেনার মতো পশ্চিমীধারায় মানুষ হওয়া মেয়ে নয়, পথে  ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন তাদেরই মতো এক গৃহবধূ।  বাস্তবিকই মেয়েলি কাজে কাদম্বরীর সুতীব্র আগ্রহ ছিল। সুপুরি কাটতেন নিয়মিতও। প্রতিদিনের তরকারি কাতার আসরে তিনি যেমন উপস্থিত থাকতেন তেমনি দেখাশুনা করতেন বাড়ীর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের। কারুর জ্বর হলে আর রক্ষে নেই, কাদম্বরী গিয়ে বসতেন তাঁর শিয়রে। সদ্য মাতৃহারা বালক দেবরটিকেও তিনি পরম স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন অথচ কতই বা বয়স তাঁর ?


কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারণ সাহিত্য প্রেমিকা ছিলেন। বাংলা বই তিনি পড়তেন শুধু সময় কাটাবার জন্য নয়, সত্যিই উপভোগ করতেন। পড়তেন দিজেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ , বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’। দুপুর বেলায় রবীন্দ্রনাথও পড়ে শোনাতেন তাঁকে। হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী, কারণ আপন মনে পড়ার চেয়ে শুনতেনই বেশি ভালো লাগত তাঁর। ‘ভারতী’ পত্রিকা  নিয়েও তাঁর ভাবনা ছিল। ‘ভারতীর’ ছাপার হরফে তাঁর নাম নেই সত্যি কিন্তু তিনিই ছিলেন ঐ পত্রিকার প্রাণ। সে কথা বোঝা গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে। পূর্বোক্ত ‘নন্দন কাননে’ সন্ধ্যাবেলা বসত গান ও সাহিত্যপাঠের  আসর।  আসরে যোগ দিতেন বাড়ীর অনেকে, বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী ‘লাহোরিনী’, জানকীনাথ ও থাকতেন সেখানে, আর মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী ছিলেন এ সভার স্থায়ী সভ্য। কাদম্বরী, বিহারীলালের  কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসতেন ও মাঝে মাঝে তাঁকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। শুধু তাই নয়, নিজের হাতে একটা আসন বুনে উপহার দিয়েছিলেন। আসনের ওপর, প্রশ্নচ্ছলে কার্পেটের অক্ষরে লেখা ছিল ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের কয়েকটা লাইন। কবি সে উত্তর দেবার জন্য আর একটা কাব্য যখন রচনা করেন, তপখন কাদম্বরী ইহলোকে নেই। বিহারীলাল তাঁর উপহারকে স্মরণ করে কাব্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সাধের আসন’। ‘তোমার সে আসনখানি/আদরে আদরে আনি,/রেখেছি যতন করে চিরদিন রাখিবও;/এ জীবনে আমি আর/তোমার সে সদাচার,/সেই স্নেহমাখা মুখ পাশরিতে নারিব’। ছাদের বাগানে সন্ধেবেলা বসত পরিপাটি গানের আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রুপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলফুলের গোড়ের মালা, এক গ্লাস বরফজল, বাটা ভরতি ছাঁচি পান সাজানো থাকতো। কাদম্বরী গা  ধুয়ে বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন সেখানে, জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্র ধরতেন চড়া সুরের গান, সে গান সূর্য ডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভরে। কিশোর রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিক সৌন্দর্য চেতনাকে জাগাবার জন্য এই পরিবেশ এই সৌন্দর্যদৃষ্টি ও কল্পনার একান্ত প্রয়োজন ছিল।


পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরীকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। মাঝে মাঝে অনুচিত সন্ধেহ এসে যে কাতা বেধায়নি তাও নয়। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের বিবাহের কয়েকমাসের মধ্যে কাদম্বরীর মৃত্যুর সংশয় সৃষ্টি করেছিলো। রবীন্দ্রমানস গঠনে এই অসামান্য নারীর দান চিরস্মরণীয়। তাঁর কবি হয়ে ওঠার কথা পড়ে মনে হয় তাঁর আন্তরিক চেষ্টার মূলে ছিলেন কাদম্বরী। বৌদিদির চোখে নিজেকে যত দামি করে তোলার চেষ্টা চলছিলো, কাদম্বরী মুখ টিপে হেসে ততই অগ্রাহ্য করে গেছেন দেবরটিকেঃ ‘রবি সবচেয়ে কালো, দেখতে একেবারেই ভালো নয়, গলা যেন কি রকম ও কোনোদিন গাইতে পারবে না, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়’। বলতেনঃ ‘কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারবে না’।


রবীন্দ্রনাথের তখন শুধুই মনে হত কী  করে এমন হব যে আর কোন দশ তিনি খুঁজে পাবেন না। বুঝবেন না, সেই সাধনাই করছেন কাদম্বরী, যাতে কেউ কোনদিন রবির দোষ খুঁজে না পায়। যখন এ কথাটা বোঝার মতো করে বুঝলেন তখন কাদম্বরী হারিয়ে গেছেন চির অন্ধকারে, প্রতিভার প্রদীপে তেল সলতে যোগাতে সারা, আলো জ্বালার কাজ শেষ। কবির কথায় বার বার এসেছে কাদম্বরীর কথা, খুব ভালবাসতুম তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালো বাসতেন। এই ভালবাসায় নতুন বৌঠান বাঙ্গালী মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার বেঁধে দিয়ে গেছেন। তাই তো সারাজীবন ধরে চলে তাঁর অনুসন্ধানঃ ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই/ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই’। ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহলে কাদম্বরীর আরেকটি ভূমিকাও স্মরণীয়। তিনি ছিলেন সুঅভিনেত্রী এবং সুগায়িকা। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল গুনবতি স্ত্রীকে পেয়ে। বাইরের জোড়াসাঁকো থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি নিজেই লিখতে শুরু করলেন নাটক, প্রহসন,গীতিনাট্য অভিনয়ের ব্যবস্থা হল। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে, বাড়ীর উঠোনে। বাড়ীর মধ্যে অভিনয়ে মেয়েদের যোগ দিতে বাধা কি? কাদম্বরীকে কেউ বাঁধা দিলেন না। তিনি এসে দাঁড়ালেন পাদপ্রদীপের আলোয়। প্রথম অভিনয় স্বর্ণকুমারীর ‘বসন্ত উৎসব’, না কি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’ ? প্রথমে যার নাম ছিল ‘এমন কর্ম আর করব না’। রচনার সময় হিসেবে ‘এমন কর্ম আর করব না’ পূর্ববর্তী। সুতরাং ‘বসন্ত উৎসবে’র  চেয়ে তাঁর দাবী বেশি। যদি ধরে নেওয়া যায় এ প্রহসন লেখার পরই অভিনয়ের ব্যবস্থা হয় এবং রবীন্দ্রনাথ নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে প্রহসনটি অভিনীত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রথম য়ুরোপ যাত্রার আগে এবং এটাই ছিল কাদম্বরীর প্রথম অভিনয়।

আবার ফিরে আসি নাটকের কথায়। এই নাটকের সবচেয়ে দুরূহ ভূমিকাটিই হচ্ছে হেমাঙ্গিনীর। বঙ্কিম উপন্যাস পড়া উনিশ শতকের রোম্যান্টিক নায়িকা ‘এমন কর্ম আর করব না’র হেমাঙ্গিনী। আবেগগর্ভ আদিরসকে পরিহাস তরল হাস্যরসে পরিণত করে আজও সে অমর হয়ে আছে। অনেকেই মনে করেন এই ভুমিকাভিনেত্রী ছিলেন কাদম্বরী।  অথচ ইন্দিরার স্মৃতিতে ‘অলিকবাবুর’ যে অভিনয়টি স্মরণীয় হয়ে আছে সেটিতে হেমাঙ্গিনী সেজেছিলেন অক্ষয় চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও  ইন্দিরাকে অনুসরণ করে শরৎকুমারীকেই হেমাঙ্গিনীর ভূমিকাভিনেত্রী বলেছেন। অপরদিকে সজনীকান্ত দাস সরাসরি কবিকে প্রশ্ন করেছিলেন ,‘হে’ কে ? প্রশ্ন  করার কারণ, ‘কবি’ ‘ভগ্নহৃদয়’ গ্রন্থকারে প্রকাশিত হবার সময় সেটি উৎসর্গ করেন ‘শ্রীমতী হে’কে। কবি সজনীকান্তকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘তোমার কি মনে হয়’ ? সজনীকান্ত বলেছিলেন, ‘হেমাঙ্গিনী’। ‘অলীকবাবু’তে আপনি অলীক ও কাদম্বরী দেবীকে হেমাঙ্গিনী সাজিয়াছিলেন। সেই নামের আড়ালেই সুযোগ আপনি গ্রহণ করিয়াছিলেন’। কবি স্বীকার করেন, ‘ইহাই সত্য অন্য সব অনুমান মিথ্যা।’ এই ‘শ্রীমতী হে’ নিয়েও কম সংশয় নেই। ইন্দিরা মনে করেন ‘হে’র পুরো নাম হেঁকেটি, গ্রীক পুরাণের ত্রিমুণ্ড দেবী, সংক্ষেপে কাদম্বরীর ডাকনাম। তবে ইন্দিরা দেখেননি বলেই যে কাদম্বরী হেমাঙ্গিনীর ভূমিকায় কখনো অভিনয় করেননি তা মনে হয় না; [দ্রঃ চিত্রা দেব, ঠাকুরবাড়ীর অন্দর মহল, আনন্দ পাবলিশার্স]। হেমাঙ্গিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্ধেহ থাকলেও ‘বসন্ত উৎসব’ ও ‘মানময়ী’তে কাদম্বরীর ভূমিকা স্পষ্ট। এ দুটি অভিনয়ে কাদম্বরী শুধু ভাল অভিনয়ই করেননি, ভাল গানও গেয়েছিলেন। অবশ্য সঙ্গীতে কাদম্বরীর অধিকার ছিল। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ জগম্মহন গঙ্গোপাধ্যায়ের  পৌত্রী তিনি, গান তাঁর রক্তে। তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন তোলার ঘরে শুধু পিয়ানো আসেনি, জ্যোতিরিন্দ্র ও রবীন্দ্রের অনুশীলনও শুরু হয়ে গেছে। তাঁর ‘নন্দনকাননে’র সান্ধা-সভাতেও বসত গানের আসর। এসব দেখে ম্পনে হয় অভিনয়, গান, সাহিত্য নিয়ে কাদম্বরী সবাইকে একেবারে মাতিয়ে রেখেছিলেন। ‘ভারতী’ পত্রিকার কথাই ধরা যাক না। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখাশুনা করতেন, রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। কাদম্বরীর কাজ কি ছিল ?  শরৎকুমারীর ভাষায়, তিনি ছিলেন ‘ফুলের তোড়ার বাঁধন’। সবাইকে এক সঙ্গে তিনিই বেঁধে রেখেছিলেন, সবার অলক্ষ্যে। বাঁধন যে দিন ছিঁড়ল সেদিন শুধু সেদিনই বোঝা গেল কাদম্বরী কি ছিলেন। নিজের হাতে জীবনপ্রদীপটি নিবিয়ে দিয়ে অন্তরালে চলে না গেলে তিনি হয়তো ঠাকুরবাড়ীর অন্তঃপুরের রসের উৎসটিকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে সোনালি দিনগুলি শীতের পাখির মতো বিদায় নিতে শুরু করলও। এরপরে ঠাকুরবাড়ীর মেয়েদের সম্মিলিত ভূমিকার চেয়ে একক ভূমিকাই বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন চলে গেলেন কাদম্বরী ? কেন ? কেন ? এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের মাত্র কয়েক মাস পরেই কাদম্বরীর মৃত্যু হয়। ঘটনাটি আকস্মিক। তবে একেবারে অভাবনীয় নয় হয়ত। পূর্বেও তিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এই সুরসিকা, রুচিসম্পন্না, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনেও শান্তির অভাব ছিল। রবীন্দ্রজীবনীকারের ভাষায় কাদম্বরী ছিলেন ‘যেমন অভিমানী, তেমনি সেন্টিমেন্টাল এবং আরও বলিব ইনট্রোভার্ট, স্কিেজাফ্রেনিক’। তাঁর মতের সঙ্গে সবাই একমত না হলেও কাদম্বরীকে অভিমানিনী আরও অনেকেই বলেছেন। তাঁর নিঃসন্তান জীবনের বেদনা অভিমানকে আরও তীব্র করে তুলেছিলও। তাই প্রাণের গভীরে লুকিয়ে থাকা দুঃখের ফল্গুধারা হঠাৎ এক আঘাতে নিজেকে হারিয়ে বাঁধভাঙা বন্যার মতো নেমে এলো দুকূল ছাপিয়ে। কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ীর বৃহৎ সংসারেও তাঁর যথার্থ স্থানটি কোনদিন পাননি। যাই হোক, সব মিলে কাদম্বরীর মনে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। সযত্ন স্বামীসেবা, গৃহ পরিচর্যা, সাহিত্য শিল্প নিয়ে তিনি নিজেকে ভুলিয়ে রাখলেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। সত্যেন্দ্র জ্ঞানদানন্দিনীর কলকাতার প্রত্যাবর্তন ও বিজ্রিতলাও বাস এবং রবীন্দ্রনাথের বিবাহ দুটি ঘটনায় তাঁর নিঃসঙ্গতা প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়। সেই অবস্থায় স্বামীর অবহেলায় কাদম্বরী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ও আত্মহননের পথ বেছে  নেন।  আর পটভূমিতে ইন্দিরা কথিত বা বর্ণকুমারী কথিত যে কোন একটি বা দুটি কাহিনীই থাকতে পারে তবে তৃতীয় কোন অনুমানের অবকাশ বোধহয় নেই।


এই ঘটনার কিছু আগে এবং পরে লেখা কয়েকটি কবিতার প্রতি এজন্যই সমালোচকদের দৃষ্টি পড়েছিল। প্রথম কবিতাটির কবি অক্ষয় চৌধুরী। জগদীশ ভট্টাচার্যের মতে অন্যাসক্ত স্বামীর প্রতি নারীর অভিমানই ‘অভিমানিনী নির্ঝরিণী’ এবং নির্ঝরিণী আর কেউ নন, জ্যোতিরিন্দ্র-পত্নী কাদম্বরী। ‘রাখিতে তাহার মন, প্রতিক্ষণে সযতন/ হাসে  হাসি কাঁদে কাঁদি-মন রেখে যাই,/মরমে মরমে ঢাকি তাহারি সম্মান রাখি,/ নিজের নিজস্ব ভুলে তারেই ধেয়াই,/কিন্তু সে ত আমা পানে ফিরেও না চায়’।

প্রভৃতি অংশ পড়ে অবশ্য সেবাপরায়ণা গুনবতী কাদম্বরীর কথাই মনে পড়ে। অপরদিকে রবীন্দ্রজীবনীকার ‘তারকার আত্মহত্যা’য় দেখেছেন কাদম্বরীর প্রথম আত্মহনন চেষ্টার প্রতিচ্ছবি। কিশোর রবীন্দ্রনাথ জানতেন তাঁর নতুন বৌঠানের মনোবেদনার কথা। ‘যদি কেহ শুধাইত/আমি জানি কী যে সে কহিত/যতদিন বেঁচে ছিল/আমি জানি কী তারে দহিত’। তাই জ্যোতির্ময় জগত থেকে আঁধার জগতে তারকার স্বেচ্ছা নির্বাসন। কাদম্বরীর মৃত্যুর পরেও ‘পুস্পাঞ্জলি’তে কবি লিখেছেন, ‘যাহারা ভাল, যাহারা ভালবাসিতে পারে, যাহাদের হৃদয় আছে, সংসারে তাহাদের কিসের সুখ ! কিছু না। কিছু না। তাহারা যন্ত্রের মতো, বীণার মতো- তাহাদের প্রত্যেক শিরা সংসারের প্রতি আঘাতে বাজিয়া উঠিতেছে। সে গান সকলেই শুনে, শুনিয়া সকলেই মুগ্ধ হয়- তাহাদের বিলাপধ্বনি  রাগিণী হইয়া উঠে, শুনিয়া কেহ নিঃশ্বাস ফেলে না।’বেশ বোঝা যায় এই বীণাটি আর কেউ নন, কাদম্বরী। দুঃখের বিষয় আমরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনোভাবের কথা একেবারেই জানতে পারি না। শোনা যায় কিছুদিনের জন্য মানসিক ভারসাম্য ও হারিয়ে ছিলেন তিনি। ‘আমার জীবনস্মৃতি’ কিংবা শেষ বয়সে লেখা ডায়রি। কোথাও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনের কথা ধরা নেই। কোথাও নেই কাদম্বরীর কথা। ‘জীবনস্মৃতি’তে দু’একটি সংবাদ ছাড়া কাদম্বরী সর্বত্রই আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। অথচ রাঁচিতে তাঁর নিজের বাড়ি শান্তি ধামের যে নিরাভরণ ঘর খানিতে তিনি থাকতেন তার দেয়ালে ছিল একটি মাত্র ছবি, তাঁর নিজের হাতে আঁকা কাদম্বরীর পেন্সিল স্কেচ। সুতরাং এই ‘ভুলে থাকা নয় সে তো  ভোলা’। জ্যোতিরিন্দ্র সেই নির্জন বিষণ্ণ শান্তি ধামের নিরালা অবসরে হয়তো বার বার অনুভব করতে চেয়েছেন সেই অসামান্যকে, যার প্রেরণায় রবীন্দ্রনাথের কবি-মন উজ্জীবিত হয়েছিলো।
                    
জীবন থেমে থাকে না। কাদম্বরী যখন চলে গেলেন ফুলতলির ভবতারিণী তখন নাবালিকা। তাঁকে ‘স্বর্ণমৃণালিনী’ হবার আশীবাদ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। তারপর ভবতারিণী একদিন হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে। যদিও এই পরিবর্তন কোন আলোড়ন আনল না বহির্জগতে। একটুও তরঙ্গ তুলল না প্রগতিশীলদের মনে।  তবু মৃণালিনীকে সামান্য বলতে পাড়া যায় না। মাত্র দশ বছর বয়সে একহাত ঘোমটা টেনে যে ভবতারিণী ঠাকুর বাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন তিনি বুঝতেও পারেননি কোন বাড়িতে তাঁর বিয়ে হচ্ছে, কাকে পেলেন তিনি !


রবীন্দ্রনাথ বলেতেন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই’, বলতেন ‘আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিলো’। কিন্তু প্রথম দিকে তোরজোড় শুরু হয়েছিল বড় মাপে। দাসী, পাঠিয়ে মেয়ে পছন্দ করা পুরনো ব্যাপার তাই আবার কমিটি তৈরি হল-জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁরা সদলবলে মেয়ে খুঁজতে গেলেন যশোরে-সেখান থেকেই ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ বৌ এসেছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ি নরেন্দ্রপুরে গিয়ে উঠলেও দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি আশেপাশের সব গ্রামের বিবাহযোগ্য  মেয়েই দেখা হয়ে গেল কিন্তু বৌঠাকুরাণীদের মনের মতো সুন্দরী মেয়ে পাওয়া গেল না। তাই শেষকালে ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীর সঙ্গেই বিয়ে ঠিক করা হল। অবশ্য দাদাদের মতো রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে যশোরে যাননি, জোড়াসাঁকোতেই বিয়ে হয়েছিল। গুরুজনেরা যে সম্বন্ধ স্থির করেছিলেন,  রবীন্দ্রনাথ বিনা দ্বিধায় তাঁকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।  


বন্ধুদের নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণ লিপি পাঠিয়ে দিলেও এ বিয়েতে ঘটাপটা বিশেষ হয়নি। পারিবারিক বেনারসি ‘দৌড়দার’ জমকালো শাল গায়ে দিয়ে তিনি বিয়ে করতে গেলেন নিজেদের বাড়ির পশ্চিম বারান্দা ঘুরে। বিয়ে করে আনলেন অজ্ঞ বালিকা ভবতারিণীকে। নতুন বৌয়েদের শিক্ষা শুরু হত পান সাজা দিয়ে। তারপর তাঁরা শিখতেন বড়ি দিতে, কাসুন্দি আচার প্রভৃতি তৈরি করতে। ধনী পরিবারের বৌ হলেও এসব শিক্ষায় ত্রুটি ছিল না। বলাবাহুল্য মৃণালিনী এসব কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে একটা কথা মনে রাখতেই হবে, এ সময় দিন বদলাচ্ছে। পালাবদল চলছে বাড়ির বাইরে, বাড়ির ভেতরেও। না বদলালে কি জ্যোতিরিন্দ্র কাদম্বরী তিন তলার ছাদে ‘নন্দন কানন’ তৈরি করতে পারতেন?    


রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর এ ঘটনা শুধু মাত্র চিত্রা দেবের ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহল’ গ্রন্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং রচিত হয়েছে আরও অনেক গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের বেড়ে উঠা জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে কাদম্বরী। যখনই বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কথা; তখনই উপস্থিত হয়েছে কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথের বেড়ে উঠা কৈশোর জীবনের সাথে কাদম্বরী মিলেমিশে ছিলেন একান্তভাবে। পৃথ্বীরাজ সেনের রচিত ‘তিন নায়কের কলঙ্ক’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের ও কাদম্বরী দেবীর সেই ঘটনা। যা পরবর্তীতে পাওয়া যাবে আরও অনেক গ্রন্থে।


এবার আমরা রবীন্দ্র জীবনের সব থেকে রহস্যময় অধ্যায়ের অবস্থান উন্মোচন করতে চলেছি। আমরা জানি, এই সম্পর্কের পরতে পরতে নিষিদ্ধ উত্তেজনার ছাপ আছে। আসলে জীবনে একবারই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত এক শ্রদ্ধেয়া মহিলার জড়িয়ে পড়েছিলেন মন ও শরীরে। ঈশ্বর অথবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সেই তরুণীকে ভালবেসেছিলেন। এই ভালোবাসা এমন প্রগাঢ় হয়ে ওঠে যে, মেয়েটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। তাই নিয়ে সেকালের রক্ষণশীল সমাজে দারুণ আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিলো। ঘটনাটি যদি কোনো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ঘোঁত, তাহলে চারদিকে নিন্দার বাতাস ছুটে যেত, কিন্তু ঠাকুর পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে স্বয়ং কতৃপক্ষকে পর্যন্ত মাথা নোয়াতে হয়।

১৮৮২-একুশ বছরের কবি ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। এসে আবার দেখা হল নতুন বৌঠান কাদম্বরীর সঙ্গে। তিনি কবির দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিদুষী স্ত্রী। যখন কাদম্বরী ঠাকুর বাড়ির বউ হয়ে আসেন,তখন তিনি নেতাত ন’বছরের এক বালিকা। আর দেবর রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীর থেকে বছর দশকের বড়ো। ইতিমধ্যে কেটে গেছে অনেকগুলি দিন। সেই সে দিন, প্রথম বাল্যর সূত্রপাতে দুই সমবয়সী বালক-বালিকার মধ্যে যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, আজ তা যৌবনের জারক রসে সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছে। বিলেত ফেরত রবীন্দ্রকে দেখে সেদিনের তরুণী কাদম্বরী অবাক হয়ে গেলেন। দীর্ঘ দেড় বছর প্রবাসী কবির জন্য কেটে গেছে তাঁর একা থাকার প্রহর। অথচ কারো কাছে মনের এই প্রগাঢ় ভালবাসার কথা উচ্চারণ করতে পারেননি। প্রতি মুহূর্তে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন জুগিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে।    
                                                                                                                          
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সব অর্থে এক আধুনিক পুরুষ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতে ভালোবাসেন। এমন স্বামীর মন জুগিয়ে চলা বড়ো একটা সহজ নয়। তরুণ কবিও  সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন বৌদি কাদম্বরী দেবীর দিকে। ভাবতে ভালো লাগলো, এখন থেকে আর জোড়াসাঁকোর দিনগুলিতে নিঃসঙ্গতার কালো ছায়ার গ্রহণ লাগবে না। জোড়াসাঁকো হয়ে উঠবে বাসযোগ্য আবাসভূমি।


বিলেত থেকে কলকাতা-মনের অবস্থা তখন কেমন কবি লেখেছেন- ‘যৌবনের আরম্ভ সময়ে বাংলাদেশে ফিরে এলেম। সেই ছাদ , সেই চাঁদ, সেই দখিনে বাতাস, সেই নিজের মনের বিজন সপনো, সেই ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে চারিদিক হতে প্রসারিত সহস্র বন্ধন। সেই সুদীর্ঘ অবসর, কর্মহীন কল্পনা, আপন মনে সৌন্দর্যের মরীচিকা রচনা, নিষ্ফলা দুরাশা, অন্তরে নিবিড় বেদনা, আত্মপীড়ক অলস কবিত্ব- এই সমস্ত নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে আছি’। কিন্তু কোথায় যেন সর্বনাশের নেশা ছিল। কে যেন বাজিয়ে ছিল বিপদের সংগীত। হঠাৎ কাদম্বরীকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন কবি। বললেন- শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে/তোমারই সুরটি আমার মুখের ’পরে বুকের ’পরে...। এক অর্থে কাদম্বরী ছিলেন কবির প্রথম এবং শেষ প্রেমিকা। অন্য কোনো নারী তাঁর ওপর এতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। সেই কবে বালক বয়সে কাদম্বরীর সাথে আলাপ হয়েছিল কবির। তাঁর ভাষায়-‘একদিন বাজল সানাই বারোয়াঁ সুরে। বাড়িতে এলো নতুন বউ, কচি শ্যামল হাতে সরু সোনার চুড়ি। পলক ফেলতেই ফাঁক হয়ে গেল বেড়া, দেখা দিল চেনাশোনার বাহির সীমানা থেকে মায়াবী সেদের নতুন মানুষ। দূরে দূরে ঘুরে বেড়াই, সাহস হয় না কাছে আসতে। ও এসে বসেছে আদরের আসনে, আমি যে হেলাফেলার ছেলেমানুষ। হঠাৎ দূরে পাহাড় থেকে বর্ষার জল নেমে  সাবেক বাঁধের তোলা সইয়ে দেয়, এবার তাই ঘটলো। বাড়িতে নতুন আইন চালালেন কক্ত্রি। বউঠাকুরণের জায়গা হল বাড়ির ভেতরে ছাদের লাগাও ঘরে। সেই ছাদে তারই হল পুরো দখল...।’

অতি সহজে প্রিয় দেওরকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন কাদম্বরী, মাতৃহীন রবীন্দ্রনাথ হয়তো নতুন বউয়ের মধ্যে নতুন এক মায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সম্পর্ক হল সহজ সরল। জমে উঠল মান অভিমানের পালা, কবির ভাষায়-‘স্কুল থেকে ফিরে এলেই বউঠাকুরণ ভাত যেদিন মেখে দিতেন অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না। মাঝে মাঝে  যখন আত্মীয় বাড়িতে যেতেন, ঘরের সামনে তাঁর চটি জুতো জোড়া দেখতে পেতুম না। তখন রাগ করে ঘরের থেকে একটা কোনো দামী জিনিস লুকিয়ে রেখে ঝগড়ার পত্তন করতুম। বলতে হত-‘তুমি গেলে, তোমার ঘর সামলাবে কে ? আমি কি চৌকিদার ? তিনি রাগ দেখিয়ে বলতেন-‘তোমাকে আর ঘর সামলাতে হবে না, নিজের হাত সামলিও...।’  


তাই তো সাত  সাগর আর তেরো নদীর দূরে ইংল্যান্ডে বসে বার বার কাদম্বরীর কথাই ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রথম তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ভালোবাসার নারীকে পাশে না পেলে বিরহের মেঘ আচ্ছন্ন করে মনের আকাশ। এই প্রথম তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যাকে আমরা ভালোবাসি, তার সাথে সারাজীবনের প্রতিটি পল অনুপল অতিবাহিত করতে হয়। সেবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে চলে গেলেন কাদম্বরী, বেড়াতে পশ্চিম দেশে, রবীন্দ্রকে সঙ্গে না  নিয়ে। রবীন্দ্র লিখলেন, সেই বালক বয়সে-‘চলে গেল, আর কিছু নাহি কহিবার/চলে গেল, আর কিছু নাহি গাহিবার’...। সত্যিই তো, মনের মানুষ চলে গেলে সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। মনে হয় চারপাশ এত আলোর উৎসব, এর কি প্রয়োজন ?  গ্রহণের চাঁদে বেজে ওঠে বিসর্জনের করুব বাজনা...। তারপর বিলেত থেকে ফিরে আসার পর শুরু হল এক নতুন সম্পর্ক। কাদম্বরী ইতিমধ্যে আরও প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। নিঃসঙ্গতার মধ্যে কাটছে তার একাকীত্বের জীবন। রবীন্দ্র এসে তার হৃদয়ের মর্মস্থলে নিজের স্থান পাতলেন। বৃত্ত রচনা করলেন। এমন এক নিবিড় ব্যূহও, যেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো মানুষের প্রবেশ নিষেধ।


শৈশবের খেলার সাথীকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘুম ভেঙে গেল যৌবনী সত্তার ! কাদম্বরী বুঝতে পারলেন, তাঁর হৃদয়ে এখন থেকে এই কবি মানুষটির ছবি আকা হবে। এতদিন ধরে পথ চেয়ে বসেছিলেন তিনি। এবার বুঝি প্রতীক্ষার প্রহরের হল অবসান। রবীন্দ্রনাথ তখন একেবারে পালটে গেছেন। বসন্তের উম্মাদ হাওয়ার সাথী হয়ে এলেন তিনি ঠাকুর বাড়িতে। গান লিখছেন, সুর দিচ্ছেন, জ্যোতিরিন্দ্র বাজাচ্ছেন পিয়ানো। নতুন বৌঠান কত কিছু বলছেন, কখনো বা আঘাত করছেন অহংকারে-‘ যতই লেখ না কেন, বিহারিলালের মতো লেখা তোমার দ্বারা কখনো সম্ভাব নয়।’ প্রিয়তমার মুখ নিঃসৃত অপমানের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ জ্বলে উঠলেন। বিহারীলালকে অনুকরণ করেও লিখলেন, কিন্তু কাদম্বরীর বাহবা পেলেন কি ? কবিরা ভাষায়-‘বউ ঠা ক রুনের ব্যবহার ছিল উলটো। কোনো কালে আমি যে লিখিয়ে হব, এ তিনি কিছুতেই মানতেন না....।’ তারপর ? কত সে নিঃশব্দ নিস্পন্দ মধ্যে দুপুর। দুটি উম্মুখ শরীর পরস্পরের দিকে ধেয়ে আসছে। মাঝে আত্মীয়তার দুস্তর ব্যবধান। জন্ম-জন্মান্তর বাহিত কিছু নৈতিকতা রচনা করেছে বাধার প্রাচীর। অতচ যৌবন কি মানে লাল নিষেধের প্রাচীর ?


কবি লিখছেন- ‘দুপুরবেলা জ্যোতিদাদা যেতেন নীচের তলার কাছারিতে। বউঠাকুরণ ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন। নিজের হাতে মিষ্টান্নও কিছু কিছু থাকত তাঁর সঙ্গে, এর তাঁর ওপরে ছড়ানো হত গোলাপের পাপড়ি। গ্লাসে থাকত ডাবের জল, কিংবা ফলের রস, কিংবা তালশাঁস, বরফে ঠাণ্ডা করা। সমস্তটার ওপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদী খুনচেতে করে জলখাবার বেলা একটা দুটোর সময় রওনা করে দিতেন কাছারিতে.....।’ এবার কিছুটা সময় একান্ত নিভৃতে নিরালায় কাটাবেন তাঁরা দুজনে। কেউ এই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার দিকে বিষাক্ত নজর দিতে পারবেন না। সম্পর্কে তাঁরা বৌদি ও দেবর- বড়ো সুন্দর স্নেহের সম্পর্ক এটি।


বিকেল বেলা জ্যোতিদাদা ফিরতেন কাছারি বাড়ি থেকে। ইতিমধ্যে কাদম্বরী গা ধুয়ে  চুল বেঁধে তৈরি হয়েছেন। শুরু হবে সান্ধ্যকালীন আড্ডা। রবীন্দ্রনাথ নিত্যনতুন কবিতা লিখে চমকে দিতে চাইছেন নতুন বৌঠানকে। কেমন  ছিল সেইসব অলৌকিক সন্ধ্যার আসর ?  মহাকালের কোথাও কি তাঁর ইতিকথা লেখা আছে এইভাবে-‘ দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর এর তাকিয়া। একটা রুপোর রেকাবিতে বেল ফুলের গোড়ে মালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক গ্লাস বরফ দেওয়া জল, আর বাটিতে সাঁচিপান। বউঠাকুরণ গা ধুয়ে চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা, বেহালাতে লাগাতেন ছড়ি, আমি ধরতুম চড়া সুরের গান.....।’ কিন্তু কবিচিত্ত কেন অজানা আশঙ্কায় থরো থরো কম্পমান ? কেন তিনি আসন্ন অভিঘাতের কথা চিন্তা করছেন ? কেন তিনি ভাবছেন, এই অলৌকিক সন্ধ্যা একদিন স্মৃতির পাতায় বিলীন হয়ে যাবে ?


কাদম্বরীকে তখন মানসলোকের যাত্রিণী করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কাদম্বরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়ে উঠেছে দেহাতীত। কাদম্বরী বিহীন জীবন তিনি কাটাতে পারবেন কি ? কবি প্রশ্ন করছেন নিজেকে-‘ আমি কেবল ভাবছি, এখন তো আরও সতেরো বছর যেতে পারে-কত দিনরাত্রি একে একে আসবে, কিন্তু তাঁরা একেবারেই তিনি-হীন হয়ে আসবে-যদি অনেক দিন পরে সহসা দেখা হয়, তখন তার কাছে আমার অনেকটা অজানা, আমার কাছে তাঁর অনেকটা অপরিচিত.....।’ কবি ভাবছেন, অনেক বছর পর দেখা হলে নতুন বৌঠান কি তাঁর রবীন্দ্রকে আগের মতোই চিনতে পারবেন ? ততদিনে কাদম্বরী কবিচিত্তে সম্পূর্ণ দখল করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীকেই তাঁর সব থেকে বেশি বই উৎসর্গ করেছেন। এইসব অন্তরঙ্গ উচ্চারণ থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি, এতজন নারীর মধ্যে একমাত্র কাদম্বরীই সর্ব অর্থে রবীন্দ্র অনুগামিনী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আসলে কাদম্বরী দেবীর চরিত্রে এক অদ্ভুত রহস্যময়তা লুকিয়ে ছিল। তিন-তিনজন পুরুষ কাদম্বরী দেবীকে অধিকার করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং বিহারীলাল চক্রবর্তী। কাদম্বরীর চোখে জ্যোতিরিন্দ্র স্বর্গের দোসর, রবীন্দ্রনাথ অতলান্ত সমুদ্রের প্রতীক আর বিহারীলাল মর্ত্যলোকের বাসিন্দা। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীকে ‘হেকেটি’ নামে ডাকতেন। কিন্তু কেন এই  ‘হেকেটি’ ? হেকেটি কি কোনো রোমাঞ্চবর্তী মহিলার নাম ? গ্রিকদেবী হে’র চরিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি কেন কাদম্বরীর সাথে ওই দেবীর তুলনা করেছেন কবি। এই রহস্য এবং রোমাঞ্চের প্রতীক। কাদম্বরীও ইহজীবনে ছিলেন ঠিক তেমনটি। কিশোর কবির জন্য ছাদের কোণায় রচনা করেছিলেন দেবী ‘নন্দন কানন’। রবীন্দ্রনাথ বিলেত চলে যাবার পর কাদম্বরীর বিষণ্ণ প্রহর কাটত একা একা। সূর্যাস্তের অস্তরাগে উদ্ভাস টবের গাছগুলির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কখন ক্রন্দসী হয়ে উঠতেন। চোখ বন্ধ করলে হয়তো বা কবির মুখচ্ছবি মনে পড়ত তাঁর। কত দিন আগে দেখা সেই মুখখানি, আহা, কত রাত অনিদ্রিত কেটে গেল, কবি, তুমি এখন কোথা


তারপর...রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন। যৌবন মদমত্তে স্পন্দিত হল মুহূর্তে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখলেন প্রহসন ‘এমন কর্ম আর করব না’- অভিনয়ের সময় নাম হল ‘অলীকবাবু’। ‘হেমাঙ্গিনীর’ চরিত্রে কাদম্বরী আর ‘অলীকবাবু’  রবীন্দ্রনাথ। অলীক- হেমাঙ্গিনীর প্রণয় নিয়ে ভারি মজার গল্পও। দু’জনেই অভিনয় করলেন প্রাণ দিয়ে। কাদম্বরীর স্বকণ্ঠের গান হয়ে উঠল এই নাটকের অন্যতম সম্পদ। তারপর-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কি চোখে দেখলেন এই ঘনিষ্ঠতাকে ? স্থিতধী মানুষ তিনি, বুদ্ধিমান, তিনি নিশ্চয়ই অনুভব করেছিলেন কাদম্বরীর সাথে রবীন্দ্রনাথের এই প্রনয়াসক্ত সম্পর্কের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আবেগের আতিশয্যকে। ময়ূখে হয়তো  কিছু বলেননি, হয়তো বা কষ্ট পেয়েছিলেন, হয়তো নীরবে ঘটে গিয়েছিল কিছু অশ্রুপাত, ‘আমি যে তোমার জানি সে তো কেউ জানে না/তুমি মোর পানে চাও সে তো কেউ মানে না।’ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, হয়তো কাদম্বরীর সাথে তাঁর সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাব্য কলঙ্ক কথাকে মনে রেখে। অনেক দিন বাদে কবি স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে, ‘আমার গঙ্গা তীরের সেই সুন্দর দিনগুলি গঙ্গার জলে উৎসর্গ করা পূর্ণ বিকশিত পদ্মফুলের মতো একটি একটি করে ভেসে যেতে লাগলো। কখনো বা ঘনঘোর বর্ষার দিনে হারমোনিয়াম যন্ত্রযোগে বিদ্যাপতির ‘ভরা ভাদর, মহাভাদর’ পদটিতে মনের মতো সুর বসিয়ে বর্ষার রাগিণী গাইতে গাইতে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন ক্ষ্যাপার মতো কাটিয়ে দিতুম। কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা নিয়ে বের হয়ে পরতাম, জ্যোতিদাদা বেহালা বাজাতেন, আমি গান গাইতাম। পূরবী রাগিণী হতে যখন বেহাগে গিয়ে পৌছোতাম, তখন পশ্চিমতটের আকাশে সোনার খেলনার কারখানা একেবারে নিঃশেষে দেউলে হয়ে গিয়ে পূর্ববনান্তে হতে চাঁদ উঠে আসত...।’


তারপর মোরান সাহেবের বাগান বাড়িতে উন্মুখ দুটি হৃদয়ের মধ্যে রচিত হল কাঙ্কখিত প্রণয় মুহূর্ত। একে অন্যকে আবিষ্কার করলেন নতুন চোখে। টুটে গেল সব বন্ধন। তখন রবীন্দ্র এবং কাদম্বরী শারীরিক আকুলতায় অধীর হয়ে উঠেছেন... দেখা দিচ্ছে ইন্দ্রিয়ঘন রোমান্টিকতা-‘সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে ? সেই নিস্তব্ধতা নিশীথ ? সেই জ্যোৎস্নালোক ? সেই দুজনে মিলে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা ? সেই দুজনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ? সেই প্রভাতের বাতাস ? সেই সন্ধ্যার ছায়া ? একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান ? তারা  সব চলে গেছে। কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাদের ইতিহাস লেখা রইলো। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছুদিনের সুখ-দুঃখ লুকিয়ে রাখলাম। এক-একদিন খুলে, তুমি তাদের স্নেহের  চোখে দেখো, তুমি ছাড়া আর কেউ তাদের দেখতে পাবে না। আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রইলো, এক লেখা তুমি, আমি পড়ব, আর এক লেখা অন্য সকলে পড়বে.........।’  


এমন সাহসী উচ্চারণ আর কে করতে পারেন- রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। কিন্তু অলক্ষে বিধাতাপুরুষ বোধহয় হেসেছিলেন। কোথায় যেন বিরহের প্রেক্ষাপট রচিত হল। ১২৯০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাস- বিবিধ প্রসঙ্গের অন্তিম রচনা ‘সমাপনে’ রবীন্দ্র তাঁর হৃদয়ের সব কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। অবশ্য প্রহেলিকার ওড়না জড়ানো শব্দের সমারোহে। ১২৯০, ২৪ অঘ্রাণ- ১৮৮৩, ৯ ডিসেম্বর- তেইশ বছরের কবি বিয়ে করলেন দশ বছরের এক বালিকাকে- খুলনার ফুলতলির মেয়ে, পোশাকি নাম ভবতারিণী, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামকরণ করলেন মৃণালিনী। বাড়ির ছোটো বউ বলে তাঁর ডাকনাম দেওয়া হল ‘ছুটি’। তারপর কি ঘটল ?  আমরা অনুমান করতে পারি। কাদম্বরী সহসা বুঝতে পারলেন,  রবীন্দ্রের ওপর তাঁর অধিকার আর কায়েম হবে না। রবীন্দ্র এখন সত্যিকারের শয্যাসঙ্গিনীকে পেয়েছেন। এবার কাদম্বরীকে বিদায় নিতে হবে রবীন্দ্রর জীবন-নাটক থেকে। কিন্তু যে পুরুষটিকে তিনি সর্ব অর্থে ভালবেসেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন যার স্বপনচারিণী, সুখ-দুঃখের অনুবর্তিনী, তাকে কেমনভাবে অন্য এক নারীর হাতে নিঃশেষে সমর্পণ করবেন ? কাদম্বরী বুদ্ধিমতী, তিনি জানেন, এই সম্পর্ক অনৈতিক, এই সম্পর্ক কখনো বৈবাহিক বন্ধনে স্থায়িত্ব পাবে না। পরকীয়া প্রেমের কলঙ্ক আঁকা হবে আর পরতে পরতে। তবে অশান্ত হৃদয়কে আমরা কি শান্ত করতে পারি ?  সর্বনাশা সঙ্কেতে তাই হয়তো লেখা হয় ভালোবাসার অভিশাপ। চার মাস বাদে হঠাৎ আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করলেন কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-‘ বাড়ির ছাদে একলা গভীর অন্ধকারে মৃত্যুরাজ্যের কোনো একটি চিহ্ন দেখবার জন্য আমি যেন সমস্ত রাতের ওপর অন্ধের মতো হাত বুলিয়ে ফিরতাম- সে চলে গেছে, তাঁর সেই বিশেষ কণ্ঠস্বর, তাঁর সেই অতি পরিচিত সুমধুর স্নেহের আহ্বান ছাড়া জগতে এ আর কিছুই চেনে না।’ কি হয়েছিল ? রবীন্দ্র অনুরাগী জীবনীকাররা সঙ্গত কারনেই নিশ্চুপ থেকেছেন এ ব্যাপারে।  আমরা জানি, কাদম্বরীর আত্মহত্যাজনিত রহস্য অনুসন্ধানে কতৃপক্ষ তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুদেহ মর্গে পাঠান হয়নি। ঠাকুর পরিবারের অনুরোধে  জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই করোনার কোর্ট বসেছিলও। তাঁর পর... নিমতলা শ্মশানে আগুনের বিষণ্ণ উৎসবে  ছাই হয়ে গেলেন কাদম্বরী। সব কিছু কি হারিয়ে গেল চিরদিনের মতো ? না, রবীন্দ্রজীবনে শোক এল , এই প্রথম, এমনই অভিঘাত তার, মৃত্যুর প্রাক-মুহূর্তেও চোখ বন্ধ করে  প্রিয়তমা নতুন বৌঠানকে খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেজন্য মৃণালিনীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল অনেকটা। ভাবতে খারাপ লাগে, এক তরুণী থেকে অন্য তরুণীর কাছে ভ্রমণ করতে করতে শেষ অব্দি কবি এক নিঃসঙ্গ পুরুষ হয়ে গেলেন। নিঃশেষিত হয়ে গেল তার প্রাণশক্তি। হলেন তিনি নিঃস্ব, রিক্ত এক পথের ভিখারি। .....১৯২৯ সালের ২৯ নভেম্বর, শুধু একবার চোখের দেখা দেখার জন্য প্লানচেটে বসলেন কবি। কি ঘটেছিল সেই প্রেতবৈঠকে ?
-তুমি নাম বলবে ?
-না।
-আমি তোমার কথা শান্তিনিকতনে অনেকবার ভেবেছিলুম। আমার শরীর ভালো ছিল না। কখন তোমায় ভেবেছি, তুমি জানতে ?
-জানি। আমি আসতে পারিনি। শেষরাত্রে  শিরশিরে হাওয়ায় তুমি যখন গায়ে কাপড়টা টেনে নিলে, আমি এসেছিলাম তখন।
.....তুমি আমায় দেখলে ঠিক চিনবে, আমার ছায়াটা আজও আছে, প্রাণ আছে, দেহ নেই শুধু.......।
কাদম্বরীর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর ‘লিপিকা’য়  কবি স্বীকার করলেন, তাঁর জীবনের প্রথম শোকের ছায়াচ্ছন্ন  অনুভূতির কথা, ঠিক এইভাবে- ‘বনের ছায়াতে যে পথটি ছিল, সে আজ ঘাসে ঢাকা। ‘সেই নির্জনে হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘আমাকে চিনতে পারো না ?’ আমি ফিরে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। বললেন, ‘মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক নাম করতে পারছিনে।’ সে বললে, ‘আমি তোমাকে অনেক কালের সেই পঁচিশ বছর বয়সের শোক।’ বললেম, ‘সেদিন তোমাকে শ্রাবণের মেঘের মতো কালো দেখেছি। আজকে দেখছি আশ্বিনের সোনার প্রতিমা।’


....কোনো কথাটি না বলে সে একটু হাসলে। বুঝলেম, সব কিছু রয়ে গেছে হাসিতে। বর্ষার মেঘ শরতের শিউলি ফুলের হাসি শিখে নিয়েছে। দেখলেম সেদিনকার বসন্তের মালার একটি পাপড়িও খসেনি। আমি বললেম, ‘আমার তো সব জীর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু তোমার গলায় আমার সেই পঁচিশ বছরের যৌবন আজও তো ম্লান হয়নি।’
......আস্তে আস্তে সেই মালাটি নিয়ে সে আমার গলায় পরিয়ে দিলে। বললে, ‘মনে আছে ?  সেদিন বলেছিলে, তুমি সান্ত্বনা চাও না, তুমি শোককেই চাও......।’ এই সেই চন্দননগর, এই সেই মোরান  সাহেবের বাংলো। রবীন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করলেন। সব কিছু মনে পড়ে গেল তাঁর। মনে হল, মৃত্যু মিছে কথা। আত্মহত্যা, এক অলীক কল্পনা। ওই তো  আমার নতুন বৌঠান, ওই খানে বসে আছেন। সদ্য গা ধোয়া এক তরুণী, ডুরে শাড়ি, কুমকুমের টিপ, ঘাড়ের পাশে সিক্ত চুলের আকর্ষণ-‘ মনে ছবি আসে ঝিকিমিক বেলা হল/ বাগানের ঘাটে পা ধুয়েছে তারাতারি/কচি মুখখানি বয়স তখন ষেলো/তনু দেহখানি ঘেরিয়াছে ডুরে শাড়ি....।’ মনে হল, ওই বোধহয় জ্যোতি দাদা বেহালা বাজাচ্ছেন। উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরেছেন কবি। সহসা আকাশ থেকে ছুটে এল এলোমেলো  মাতাল বাতাস। গঙ্গা হল উত্তাল। চোখের সামনে ঘটে গেল বিস্ফোরণ। তারপর কবি চোখ খুললেন, ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ একা। জ্যোতি দাদা নেই, কাদম্বরী দেবী ছায়াতে আলোতে মিশে গেছেন... কবি বুঝতে পারলেন, এ সবই তাঁর ব্যথার্ত  মনের অনুসন্ধান। আর কোনো দিন কাদম্বরী হাসি-কান্নার এই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না...। কোনো একদিন কাদম্বরীর ছবি খানি দেখে কবি লিখেছিলেন, ‘তুমি কি কেবলই ছবি..শুধু পটে আঁকা ?/ ওই যে সুদূর নীহারিকা, যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড় ওই যারা দিনরাত্রি/ আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি/তুমি কি তাদের মতো নও/হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি/নয়নের মাঝখানে নিয়েছিলে থাই-আজ তাই/ শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমার নীল/ আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের নীল/ নাহি জানে, কেহ নাহি জানে-/ তব সুর বাজে মোর গানে,/ কবির অন্তরে তুমি কবি- নও ছবি,/ নও ছবি, নও শুধু ছবি। এভাবেই নতুন বৌঠান মিশে গেলেন অনন্তে। তাঁর নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হয়ে গেল। পঞ্চভূতে মিলিয়ে গেল শরীর।


১৮৮৭-দাম্পত্য জীবনের বয়স হয়েছে চার বছর। চার বছর আগে কাদম্বরী দেবী চিরদিনের মতো ছেড়ে গেছেন এই জগত। পৃথিবীটা বড়ো শূন্য লাগে কবির কাছে। তবু লিখতে হয়। কারণ লেখাই তাঁর এই জীবনের একমাত্র প্রেমিকা। যখন আকাশ জুনে শোকাচ্ছন্ন মেঘের ঘনঘটা, যখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুই ব্যথার্ত বৃষ্টির অনুরণন, তখন কবিচিত্তে উদ্বেল হয়ে ওঠে। হৃদয়ের অনেক না বলা কথারা স্পন্দিত হতে চায়। অনেক ব্যথা ছুঁয়ে যায় মন। তখন কবি কলম নিয়ে বসেন। সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলির ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেন। স্রোতস্বিনীর স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যায়। সোনার কলম এগিয়ে চলে সৃষ্টির সুখের উল্লাসে। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এক শ্মশান বলে মনে হয় কবির কাছে। সেখানে গেলে সর্বত্র নতুন বৌঠানের স্মৃতি। এই সেই অলিন্দও, এখানে দাঁড়িয়ে দুটি তরুণ হৃদয় অনায়াসে বিনিময় করেছে হৃদয়ের তাপ-উত্তাপ। এই সেই উঠোন- এখানে কতদিন সহসা স্পর্শসুখের আনন্দে মেতে উঠেছেন তরুণ কবি। আর এই ছাদে এলে তো চোখের জল আর বাধা  মানতে চায় না। এখানেই তো প্রতি সন্ধ্যায় সান্ধ্য আসরে বাতাস হত স্পন্দিত। অনিমিখ নয়নে কবি তাকিয়ে থাকতেন তাঁর প্রিয় নতুন বৌঠানের নিষ্পাপ মুখখানির দিকে।


অতএব এখন শিলাইদহের বোটেই কাটে দিনরাত্রি। সব সময় অন্বেষক চোখে তাকিয়ে থাকেন কবি। তাকিয়ে থাকেন দূর আকাশের পানে। তাকিয়ে থাকেন দিগন্ত বিস্তৃত ওই স্তব্ধ মৌনমুখর প্রকৃতির রাজ্যে, আর ভাবেন কোন ষে রমণী এসে নতুন বৌঠানের শূন্যস্থান পূর্ণ করবে। কবি এক স্থিতধী পুরুষ। তিনি জানেন এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই বেশিদিন শূন্য অবস্থায় থাকতে পারে না। [দ্রঃ তিন নায়কের কলঙ্ক : পৃথ্বীরাজ সেন, (প্রথম প্রকাশ ১৪১৮: দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১২); প্রিয়াবুক হাউস, কোলকাতা]  


কাদম্বরী দেবী আর রবীন্দ্রনাথের এই সম্পর্ক নিয়ে দুবাংলাতেই রচিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ। কোথাও আলাদা করে দেখা হয়নি রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীকে। আমি পূর্বেই বলেছি, যেখানেই টেনে আনা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কথা, সেখানে বার বার ফিরে এসেছে কাদম্বরীর কথা। যারাই বলেছেন রবীন্দ্রনাথের অনুক্ত বাণী, আবার পরক্ষনেই তারা-ই আগ্রহ নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছেন কাদম্বরীকে নিয়ে। জ্যোতিন্দ্রনাথের স্ত্রী হিশেবে কাদম্বরী যতোটা না আলোচনায় এসেছেন, তার চেয়ে অধিক সমালোচিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বৌঠান হিশেবে। কখনো সেটা হয়েছে ঠাকুরবাড়ির অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিশেবে, আবার কখনো হয়েছে রবীন্দ্র-কাদম্বরী অন্তমুখি সম্পর্কের জন্য। প্রেমেও অসাধারণ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম যৌবনে নিবেদিত তরুণীর প্রেম উপলব্ধ হয় কবির শেষ জীবনে এবং তার প্রতি নিজের আকর্ষণও আবিষ্কৃত হয় বিগত যৌবনে। আবদুশ শাকুর তাঁর রচিত রবীন্দ্র জীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চল গ্রন্থে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেমিকা ’ শিরোনামের লেখাটিতে আবারও নিয়ে আসেন কাদম্বরীকে। কাদম্বরী দেবীর পাশাপাশি তিনি নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথের সাথে সম্পর্কিত একাধিক নারীকে; যারা কোনো না কোনো সময় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে। আবদুশ শাকুর একে একে উপস্থাপন করেন তাঁদের সকলকে। তিনি নিদিষ্ট ক’রে কোথাও বলেননি কে প্রথম হ’য়ে  দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের জীবনে। কে বা ভালোবাসার বন্ধনে মিশে প্রথম হাতটি বাড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। তাই একে একে জানতে থাকি রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বা ভালোলাগার মানুষগুলোকে। যারা সব সময় রবীন্দ্রনাথের পাশে ছিলেন। যেমন তাঁরা প্রচুর ভালবেসেছেন রবীন্দ্রনাথকে একই ভাবে নিজের ভালোবাসাটাও আদায় করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। কাদম্বরী সম্পর্কে এ গ্রন্থে বলা হয়ঃ ‘বউঠাকরুন কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের সুপুরি কাটা  হাতের গুন ছাড়া অন্য কিছুরই প্রশংসা করতেন না, এমন- কি চেহারার খুত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন। কিন্তু এই তরুণীর মুখেই তিনি প্রথম শুনেছিলেন তাঁর চেহারার প্রশংসা। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষ জীবনের দিকে আন্না–র প্রেমকে সর্বশ্রেষ্ঠ  স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ সম্পর্কে এই গ্রন্থে বলেনঃ


‘জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন- মানুষের দূতি, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড়ো করে দিয়ে যায়। না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায় না। চলে যেতে যেতে বেঁচে থাকার চাদরটার উপরে ফুলকাটা কাজের পাড় বসিয়ে দেয়, বরাবরের মতো দিনরাত্রির দাম দিয়ে যায় বাড়িয়ে।’ কাদম্বরী দেবী ছাড়াও রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়  মনে করেন রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসার অপর আর একজনের নাম ‘নলিনী’। এটি তাঁর একটি অত্যন্ত প্রিয় নাম, প্রথম জীবনে রচিত বহু কাব্য কবিতায় ও নাটকে নামটি ব্যবহিত হয়েছে। কাব্য নাটকে ‘নলিনী’ চরিত্রটি প্রায়শই একটি চপল স্বভাব আপাত নিষ্ঠুরা, অথচ প্রেমময়ী নারী। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, শৈশব সংগীত  কাব্যগ্রন্থের ‘ফুলের ধ্যান’ ও ‘অপ্সরা-প্রেম’ কবিতা দুটিতে এই তরুণীর মর্মবেদনা কবির ভাষায় রূপ পেয়েছে এবং ‘আমি স্বপনে রয়েছি ভোর’, সখী, আমারে জাগায়ে না’ গানটির মধ্যে দস্তানা চুরির কৌতুককর কাহিনীর স্মৃতি জড়িত আছে। মালতীপুঁথি-তে পাওয়া না  গেলেও রবিজীবনীকারের ধারণা ভগ্নহৃদয় কাব্যের  চতুর্থ সর্গে কবির অষ্টম গানটি- ‘শুনেছি শুনেছি কি নাম তাহার/শুনেছি শুনেছি তাহা !/নলিনী-নলিনী-নলিনী-/কেমন মধুর আহা!’ ইত্যাদি। রবিজীবনীকারের ধারণা আন্না-কে উপলক্ষ্য করেই তিনি এ গান রচনা করেছেন
।[দ্রঃ রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চলঃ আবদুশ শাকুর, অন্য প্রকাশ, বাংলা বাজার, ঢাকা]                                                                    
                                
হরিশংকর জলদাসের ‘আমি মৃণালিনী নই’ গ্রন্থেও পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর ঘটনা। যে ঘটনা এর পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে বহু গ্রন্থে। অন্যান্য গ্রন্থের থেকে তিনি একটি জিনিস খুব স্পষ্ট ক’রে দেখিয়েছেন, সেটা হল কাদম্বরীর আফিম সংগ্রহের ব্যাপারটি। কাদম্বরী আফিম খেয়েছেন সত্য; কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অভ্যন্তরে কাদম্বরী বৌদি আফিম পেলেন কিভাবে ? এটা যেমন ভাবার বিষয়, ঠিক একইভাবে চিন্তিত ক’রে তোলে আমাদেরকে। তাহ’লে কেউ কি সাহায্য করেছিল কাদম্বরীকে আত্মহত্যার জন্য ? যার সাহায্য বা সহযোগিতার জন্য কাদম্বরী এগিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুর দিকে। ‘আমি মৃণালিনী নই’ গ্রন্থে তিনি বলেনঃ ‘বধূ হিশেবে নতুন বউঠান ঠাকুরবাড়িতে এলে রবিবাবুর জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিলো। তখন নতুন বউঠানের বয়স মাত্র নয় বছর। কিন্তু ওই সময়ে সাত বছর বয়সের রবিবাবুর মনে হয়েছিলো-এই বঁধুটি অন্যান্য বউয়ের তুলনায় অন্যরকম। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে নতুন বউঠানকে অবলোকন করত রবিবাবু। কচি শ্যামল হাতে সরু সোনার চুড়ি। বারে বারে  মাথা থেকে ঘোমটা খসে যাচ্ছে। বর্ণকুমারী ও স্বর্ণকুমারী দিদি ঘোমটা মাথায় তুলে দিচ্ছেন। আবার পড়ে যাচ্ছে ঘোমটা।  সেদিকে খেয়াল নেই নতুন বউঠানের। চারদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকাচ্ছেন। কাজলকালো নিবিড় চোখে ভয়য়, না বিস্ময়য়-ছোট্ট রবিবাবু বুঝে উঠতে পারছেন না।
        
কখনো কখনো নতুন বউঠানের কথা অনর্গল দিনের পর দিন রবিবাবু আমার কাছে বলে যেত। আবার কোনো কোনো সময় এ প্রসঙ্গে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যেত সে। আমি জিজ্ঞেস করলেও চুপচাপ থাকতো। কখনো কখনো বউঠান প্রসঙ্গে সচেতনভাবে এড়িয়ে যেত বলেও আমার মনে হতো। এত দিনে আমি জেনে গেছি রবি বাবুর পছন্দের প্রসঙ্গ কোনটি। তার সকল ভালোবাসা কোন জায়গাটিতে জমাট বেঁধে আছে। তাড়াতাড়ি আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম, ‘তোমার নতুন বৌঠানকে ভুলে গেলে নাকি ?’ চকিতে রবিবাবু আমার দিকে মুখ ফেরাল। দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন?’ ‘না বলছিলাম কি, দীর্ঘদিন তো বৌঠান সম্পর্কে কিছু বলো না, তাই ভাবলাম, বৌঠানের স্মৃতি তোমার মনে ঝাপসা হয়ে এসেছে বোধ হয়।’ আমি বললাম। রবিবাবু ধীরে ধীরে বলল, ‘ বৌঠানের স্মৃতি কি ভোলার ? আমৃত্যু বৌঠানের স্মৃতি মনের গভীরে জ্বলজ্বল করবে।’ রবিবাবুর এ কথা শুনে আমার ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। কি রকম যেন গভীর কালো একটা ছায়া আমার হৃদয়ের সকল আলোকে গ্রাস করে ফেলল নিমেষেই। তাহলে কি রবিবাবুর মনে আমি এখনও ঠাই করে নিতে পারিনি ? রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এ ভাবনা জাগ্রত হয়েছিল তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর। রবীন্দ্রনাথ এখানে যে সুরে কথা বলেছেন বাস্তবিক তা রবীন্দ্রনাথ কখনো মুখ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন কিনা তা একপ্রকার বিবেচ্য বিষয়। যেহেতু হরিশংকর এক প্রকার কাল্পনিক ভাববোধের মাধ্যমে এ উপাখ্যানটি রচনা করেছেন। তাই ব্যক্তি কথনে তিনি নিয়েছেন ভাবের এক প্রকার আশ্রয়। যার মাধ্যমে এগিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর কথোপকথন। সেই ছায়ার মাঝে নীরবে জায়গা ক’রে নিয়েছে কাদম্বরী দেবী।
  
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছে কাপর বেচতে আসত এক কাপড়ওয়ালি। বহু বছর আগে থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এ প্রথা। কাপরচোপর, প্রসাধন সামগ্রী, পাদুকা- এসব জিনিসের নারী বিক্রেতাদের বাছাই করা কয়েকজনের ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশের সুযোগ ছিল। বড়কর্তার অনুমতিক্রমেই এরা নারীমহলে ঢোকার অধিকার পেয়েছিলো। বিশু কাপড়ওয়ালি তাঁদের একজন। বিশুর সঙ্গে কথা বলার ফুরসত নেই অন্যান্য বউ বা ঠাকুরকন্যার। সন্তান-সংসার নিয়ে ব্যস্ততার কারণে ওরা নিজেদের পছন্দ মতন কাপড় বাছাই করে দ্রুত বিদেয় করত বিশুকে। বিশু দুদণ্ড স্বস্তি পেত নতুন বউঠানের ঘরে গিয়ে। দু-চার  কথা জিজ্ঞেস করত সে বিশুকে আর বিশুও তাকে দু-চারটা সুখ দুঃখের কথা বলে মনে স্বস্তি পেত। এভাবে বিশু কাপড়ওয়ালির সঙ্গে নতুন বউঠানের একটা সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। এই সহজ সম্পর্কের সুযোগ নিয়েছিল নতুন বউঠান। বিশুর ডাকে কি রকম চোখে তাকাল বউঠান! অন্যান্য দিনের মতো খলবল করে এগিয়ে এল না। খাটে বসা অবস্থায় বলল, ‘আজ কিছু নেব না রে, বিশু।’
‘কেন বউঠান ? মন খারাপ বুঝি ? আজকে বড় ভালো শাড়ি এনেছিলাম একখান। বালুচরি শাড়ি। সবুজ আর লালে মেশানো।’ বিশু বলেছিল।
ক্লান্ত বিষণ্ণ চোখ তুলে নতুন বউঠান বলেছিলও, ‘নারে বিশু, কাপড় নিতে আজ ইচ্ছে করছে না।’
‘তাহলে যাই বউঠান।’ বলেই ফিরে যাচ্ছিল বিশু।
ওই সময় ব্যগ্রকণ্ঠে নতুন বউঠান বলে উঠেছিলো, ‘তুই আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি, বিশু? আমাকে আফিম এনে দিতে পারবি ?’    
‘আফিম ! তুমি মেয়ে মানুষ, আফিম দিয়ে তুমি কি করবে ?  শুনেছি, পুরুষরাই খায় আফিম। শরীরে তাগদ আনবার জন্য।’ বলেই মুচকি হেসেছিল।
বিশুর কথা শুনে  থতমত খেয়ে গেল বউঠান। তবে তা সামান্য সময়ের জন্য। নিজেকে সামলে নিয়ে বউঠান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘আমার ঘরে কি পুরুষ নেই রে, বিশু?’
বিশু খলখলিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘অ, তাই তো। আমি তো সেদিকে ভাবিনি? আচ্ছা বলো, কতটুকু আনতে হবে।’


নতুন বউঠান কি জানে কোন পদ্ধতিতে আফিম বেচে দোকানদাররা ? শুধু জানে, কবিরাজি দোকানে অন্যান্য মহৌষধীর সঙ্গে আফিমও বিক্রি হয়। বিশুর কথা শুনে বউঠান বলল, ‘আনিস তোর  বুদ্ধিতে যতটুকু কুলোয়।’ তারপর একেবারে নিচু স্বরে বলল, ‘মরবার জন্য যতটুকু দরকার, ততটুকু আনিস ?’
বিশু বউঠানের বিড়বিড়ানি শুনে বলল, ‘কিছু বলছ গা, নতুন বউঠান?’
‘না, তুই এখন যা। আর এই নে টাকা। কালকেই নিয়ে আসিস।’ বলল সে।
‘ঠিক আছে, বউঠান।’  


বিশুর আনা আফিম খেয়েই আত্মহত্যা করেছিল বউঠান। আফিম খাওয়ার পর পরই তার মৃত্যু হয়নি। ঝিম ধরে শয্যায় শুয়ে ছিল সে। কোনো ছটফটানি নেই, নেই কোনো হাহাকার। দেহটিকে বিছানায় শুইয়ে রেখে যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল নতুন সে। কিছুক্ষণ পর পর দেহটি হঠাৎ কেঁপে কেঁপে উঠছে।


মুহূর্তে সংবাদটি চাউর হয়ে গেল গোটা ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চারদিকের আলো যেন হঠাৎ করে নিভে গেল। প্রচণ্ড হাহাকার সমস্ত বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল। তবে এই হাহাকারের কোনো শব্দ নেই, কোনো আকার-আকৃতি নেই, নেই কোনো উদ্বাহু নৃত্য। সমুদ্রের তীব্র অন্তঃস্রোতের মতো সারা ঠাকুর পরিবারে আর্তনাদের নিঃশব্দ স্রোতটি বয়ে যেতে লাগলো শুধু। [দ্রঃ আমি মৃণালিনী নই, হরিশংকর জলদাস; (প্রথম প্রকাশঃ ২০১৪, মাঘ ১৪২০; ফেব্রুয়ারি ২০১৪),প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা]


আমি, রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর এই অসমাপ্ত উপাখ্যানের সত্যতা থেকেও যা দেখাতে চেয়েছি তা হলো ঘটনাটির গভীরতা। কতোটা গভীরে নামতে পেরেছি জানি না; কিন্তু নামতে চেষ্টা করেছি গভীর থেকে আরও গভীরে। এর পরও হয়তো বাদ থেকে যেতে পারে ঘটনাটির অজানা আরও অনেক কিছু; ভবিষ্যতে যা দেখা দিবে অন্য কোনো গ্রন্থে।