রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: চেতনায় ধর্ম বিশ্বাস
“দাও হস্তে তুলি
নিজ হাতে তোমার অমোছা শরতাল,
তোমার অক্ষয় তূর্য। অস্ত্রে দীক্ষা দেহো
রুণতরু। তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ
ধ্বনিরা উঠুক আজি কঠিন আদেশে।
করো মোরে সম্মানিত নব্বীর বেশে,
দুরূহ কর্তব্যভারে দুঃসাহ কঠোর
বেদনায় পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর-
ক্ষতচিহ্ন অলংকার। ধন্য করো দাসে
সফল চেষ্টায় আর নিস্ফল প্রয়াসে।”
(ধর্ম, ৬ মাঘ ১৩১৫: ১৯ জানুয়ারি-১৯০৯)


রবীন্দ্রনাথ, চিন্তা করেছেন সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা, প্রেম, দুঃখ, আনন্দ, হাসি, কান্না এবং বেদনা নিয়ে। মানব মনের এ দিকগুলো তাঁর সৃষ্টিতে এসেছে বার বার। মনের এমন কোনো দিক নেই, যেখানটাতে তিনি বিচরণ করেননি। বিশ্বাস অবিশ্বাস চেতনাসত্তায় স্থান ক’রে নিয়েছেন ধর্মীয় ভাব এবং তাঁর মূল্যবোধকে। মানব জীবনের এ সত্তায় তিনি বেড়িয়েছেন দিক থেকে দিগান্তরে। কতটুকু বিশ্বাস বা আস্থা ছিল তাঁর ধর্মীয় চেতনা বা বিশ্বাসে? তিনি অটল ছিলেন বিশ্বাস, আর অবিশ্বাস নিয়ে? তাঁর ধর্মীয় চেতনার স্থানটিতে ‘ধর্ম’ (৬ মাঘ ১৩১৫: ১৯ জানুয়ারি ১৯০৯) নামক একটি চেতনা সর্বস্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। সত্য, সুন্দর, মিল, প্রেম ইত্যাদি দিকগুলো তু’লে এনেছেন নানা দিক থেকে, বহুভাবে।ধর্মীয় চেতনার সাথে সত্যের একটি অভূর্তপূর্ব মিল তৈরি করেছেন। তিনি বলেন :
‘মিলনের মধ্যে যে সত্য তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে, তাহা আনন্দ, তাহা রসস্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে, তাহা সমগ্র কারণ তাহা কেবল বুদ্ধিকে নহে তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে। যিনি নানাস্থান হইতে আমাদের সকলকে একের দিকে আকর্ষণ করিতেছেন, যাহা সম্মুখে যাঁহার দক্ষিণকর তলছায়ায় আমরা সকলে মুখামুখি করিয়া বসিয়া আছি, তিনি নীরস সত্য নহেন, তিনি প্রেম’। এই প্রেমই উৎসবের দেবতা-মিলনই তাঁহার সজীব সচেতন সন্ধি। সত্য, সুন্দর, দেবতা, মন্দির-এর এক সুন্দর মিলে তৈরি করেছেন ‘প্রেম’ দিয়ে। যে প্রেম কোন জাগতিক প্রেম নয়, পরলৌকিক এবং বিশ্বাস সর্বত্র প্রেমের সাথে উৎসবের এক চমৎকার মিলবন্ধন তৈরি করেছেন। প্রেম একান্ত এবং সেই উৎসব হ’য়ে ওঠে সার্বজনীন। সার্বজনীন উৎসবকে তিনি নিয়ে আসেন বিপরীত মুখী একক সত্তায়। সত্য-সুন্দর এবং প্রেম এর থেকে কোন সময়ই নি®কৃতি পাননি রবীন্দ্রনাথ। তাই আবার বলেন:“সত্যের পরিপূর্ণতাই প্রকাশ, সত্যের পরিপূর্ণতাই প্রেম, আনন্দ। আমরা তা লৌকিক ব্যাপারেই দেখিয়াছি অপূর্ণ সত্য অপরিস্ফুট। এবং ইহাও দেখিয়াছি যে, যে সত্য আমরা যত সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিব, তাহাতেই আমাদের তত আনন্দ, তত প্রেম। উদাসীনের নিকট একটা তৃণে কোনো আনন্দ নাই, তৃণ তাহার নিকট তুচ্ছ তৃণের প্রকাশ তাহার নিকট অত্যন্ত ক্ষীণ। কিন্তু উদ্ভিদ বেত্তার নিকট তৃনের মধ্যে যথেষ্ট আনন্দ আছে, কারণ, তৃণের প্রকাশ তাহার নিকট অত্যন্ত ব্যাপক, উদ্ভিদ পর্যায়ের মধ্যে তৃণের সত্য যে ক্ষুদ্র নহে তাহা সে জানে। যে ব্যক্তি আধ্যত্বিক দৃষ্টিদ্বারা তৃণকে দেখিতে জানে তৃণের মধ্যে তাহার আনন্দ আরো পরিপূর্ণ-তাহার নিকট নিখিলের প্রকাশ এই তৃণের প্রকাশের মধ্যে প্রতিবিম্বিত। তৃণের সত্য তাহার নিকট ক্ষুদ্র অষ্ফুট সত্য নয় বলিয়াই সে তাহার আনন্দ তাহার প্রেম উদবোধিত করে। যে মানুষের প্রকাশ আমার নিকট ক্ষুদ্রে, আমার নিক অষ্ফুট, তাহাতে আমার প্রেম অসম্পূর্ণ। যে মানুষকে আমি এতখানি সত্য বলিয়া জানি যে, তাহার জন্য প্রাণ দিতে পারি, তাহাতে আমার আনন্দ আমার প্রেম। অন্যের স্বার্থ অপেক্ষা নিজের স্বার্থ আমার কাছে এত অধিক সত্য যে, অন্যের স্বার্থসাধনে আমার প্রেম নাই-কিন্তু বুদ্ধদেবের নিকট জীব মাত্রেরই প্রকাশ এত সুপরিষ্ফুট যে তাহাদের মঙ্গল চিন্তায় তিনি রাজ্য ত্যাগ করিয়াছিলেন।”


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যকে দু’টো ভাগে ভাগ ক’রে দেখিয়েছেন। একটি ‘সত্য’ এবং তার অপরটি হলো ‘অপূর্ণ সত্য’। সত্যের সম্পূর্ণটাই যদি সত্য হয় তাহলে তা সত্য। আর অপূর্ণ সত্যের কিছু অংশ যদি সত্য হয়, তাহলে ও তা ‘সত্য’, আর অপূর্ণ সত্যের কিছু অংশ যদি সত্য হয়, তাহলে ও তা ‘সত্য’ এবং অবশিষ্টাংশ ঠিক সত্যের বিপরীতরূপ মিথ্যা। তিনি তাই মিথ্যাটিকে মিথ্যা না ব’লে ওঠেন অপূর্ণ সত্য। যে অপূর্ণ সত্য একক কোন রূপ নয়, তা সত্যর-ই বিপরীতরূপ প্রকাশ করে তোলে। সত্যকে উপলব্ধি করার ব্যাপারটিকে তিনি দেখিয়েছেন সম্পূর্ণরূপ দিয়ে। সেটা কখন অসম্পূর্ণরূপ হ’য়ে উঠে তা আর সত্য হ’য়ে উঠে না, মিথ্যার কথা-ও তিনি বলেননি, বলেছেন অসম্পূর্ণরূপে। সত্যকে সম্পূর্ণরূপে নিলে তা থেকে পাওয়া যাবে আনন্দ এবং প্রেম। আর তার থেকে যদি অসম্পূর্ণরূপ নিই তাহলে কী পাবো, বেদনা আর অপ্রেম না তীব্র ঘৃণা!


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসবের দিনকে ক’রে তুলেছেন সৌন্দর্যের দিন। যে দিনকে নিয়ে তিনি মগ্ন থাকেন চিন্তা-চেতনার সংগীতের সুর দ্বারা। তিনি তাকে আরো গভীর ক’রে তোলেন সুর সংগীতের মধুর কম্পন দ্বারা। তিনি বলেন:‘মিলনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুট মনিস্বরূপ করিয়া তুলি। যিনি আনন্দের প্রাচুর্যে, ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে বিশ্বজগতের মধ্যে অমৃতরূপে প্রকাশমান। উৎসবের দিনে তাঁহারই উপলব্ধি দ্বারা পূর্ণ হইয়া আমাদের মনুষ্যত্ব আপন ক্ষণিক অবস্থাগত সমস্ত দৈন্য দূর করিবে এবং অন্তরাত্মার চিরন্তন ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য প্রেমের আনন্দে অনুভব ও বিকাশ করিতে থাকিবে। এই দিনে যে অনুভব করিবে, সে ক্ষুদ্র নহে, সে বিচ্ছিন্ন নহে, বিশ্বই তাহার নিকেতন সত্যই তাহার আশ্রয়, প্রেম তাহার চরমগতি। সকলেই তাহার আপন-ক্ষমা তাহার পক্ষে স্বাভাবিক ত্যাগ তাহার পক্ষে সহজ, মৃত্যু তাহার পক্ষে নাই।’ (ধর্ম: ১৩৩৫)


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিনের উজ্জ্বল আলোয়-আলোকিত ক’রে তুলেছেন নিজের বিশ্বাস এবং চেতনায় বিস্তার ঘটিয়েছেন ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে। বিশ্বজগত বা পৃথিবী বা ইহলৌকিক যা-ই বলি না কেন, তিনি দেখতে পেয়েছেন অমৃতরূপে তার প্রকাশ। যে প্রকাশ ইহলৌকিক নয়, তা প্রকাশ পায় পারলৌকিক রূপে, চিন্তা ও চেতনার সত্তায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতোপূর্বে যে প্রকাশ ধ্বনি ক’রে তুলেছেন, তাঁর বহিঃপ্রকাশ রূপে প্রকাশ পায় এ স্থানটিতে এসে। যখন তিনি ব’লে উঠেন: ‘হে বিশ্বযজ্ঞ প্রাঙ্গনের উৎসব দেবতা আমি কে?’ তাঁর এই ‘আমি কে’-এর সাথে আমার মনে পড়ে যায়... কিছু কবিতার অংশ।


“পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের সবক’টি পথ রুদ্ধ যার-
যদি জানতাম, আমার সব উচ্চারণ তারই উদ্দেশে
এই লিলিহান শিখা এগোতো না এক পাও নিশ্চল দাঁড়াতো।
কিন্তু যেহেতু এই অন্ধ গহ্বর থেকে জীবিত পালানোর
কোনো পথ নেই, যা শুনছি তা যদি সত্যি হয়
ঈশ্বর নিন্দনে নির্ভর আমি, অবশ্যই জবাব দেবো
তোমার সকল প্রশ্নের।”


এরপর ব্যথিত এবং ব্যাকুল চিত্তে তিনি আবার প্রকাশ করেন: ‘আজ উৎসব দিনে এই আসন গ্রহণ করিবার অধিকার আমার কী আছে? জীবনের নৌকাকে আমি যে প্রতিদিন দাঁড় টানিয়া বাহিয়া চলিয়াছি, সে কি তোমার মহোৎসবের সোনাবাঁধানো ঘাটে আসিয়া আজও পৌঁছিয়াছে? তাহার বাধা কি একটি? তাহার লক্ষ্য কি ঠিক থাকে? প্রতিকূল তরঙ্গে আঘাত সে কি সামলাইতে পারিল? দিনের পর দিন কোথায় সে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? আজ কোথা হইতে সহসা তোমার উৎসবে সকলকে আহ্বানের ভার লইয়া হে অন্তর্যামিন, আমার অন্তরাত্মা তোমার সমক্ষে লজ্জিত হইতেছে। তাহাকে ক্ষমা করিয়া তুমিই আমাকে আহ্বান করো। একদিন নহে, প্রত্যেহ তাহাকে আহ্বান করো।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং আহবান করেন এক অনন্ত অন্তযার্মির। যিনি তার অস্থির চিত্তকে আরো ব্যাকুল না করে ক’রে তুলে সুস্থির। যে সুস্থির ভাবনা বোধ কবিকে ক’রে তোলেন উৎসব তরঙ্গের এক কাঠামো, যেখানে তিনি-ই এক আশ্চর্য সৌন্দর্যময়ী ভাষ্কর্য।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বর ভাবনায় আবার কাতরতা বোধ করেন। এবং নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসর্ম্পন করেন ঈশ্বরের সামনে। যেখানে তিনি এক অনন্তরূপে, নিজেকে তুলে ধরেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘হে বিরাম বিভাবরীর ঈশ্বরী মাতা, হে অন্ধকারের অধিদেবতা, হে সুপ্তির মধ্যে জাগ্রত, হে মৃত্যুর মধ্যে বিরাজমান, তোমার- নক্ষত্রদীপিত অঙ্গনতলে তোমার চরণচ্ছায়ায় লুন্ঠিত হইলাম। আমি এখন আর কোনো ভয় করিব না, কেবল আপন ভার তোমার দ্বারে বিসর্জন দিব, কোনো চিন্তা করিব না, কেবল চিত্তকে তোমার কাছে একান্ত সমর্পণ করিব, কোনো চেষ্টা করিব না, কেবল তোমার ইচ্ছায় আমার ইচ্ছাকে বিলীন করিব; কোনো বিচার করিব না, কেবল তোমার সেই আনন্দে আমার প্রেমকে নিমগ্ন করিয়া দিব যে- রবীন্দ্রনাথ, নিজস্ব ভাবনা চেতনা এবং তাঁর এক সুন্দর সমন্বয় ক’রে তোলেন ঈশ্বর ভাবনার সাথে। যে ভাবনা চেতনাগত এবং তার বহিঃপ্রকাশ সুদীর্ঘ। ধর্মীয় বোধ এবং তার কাতরতা রবীন্দ্রনাথকে ক’রে তোলে এক প্রচণ্ড বিশ্বাসীরূপে। যিনি কাতরতা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করেন এক বহিঃস্থরূপে। আশ্রয়, প্রার্থনা, কাতরতা, বিসর্জন, সম্পূর্ণ-সবই একক রূপ হয়ে উঠে রবীন্দ্রনাথের কাছে। নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি এবং তার বহিঃ প্রকাশ থেকেও তিনি বিরত থাকেন। সংমিশ্রণ ঘটান নিজস্ব ইচ্ছা নামক শক্তিকে, ঈশ্বর ভাবনার ইচ্ছার শক্তির সাথে। আনন্দ, প্রেম এবং তার সাথে ধর্মীয়বোধকে একক ক’রে তোলেন রবীন্দ্রনাথ। ইচ্ছা আর বিচারশক্তির বিচ্যুতির পূর্বেই সম্পূর্ণ করেন, ভাবগত ভাবনার সাথে, এক চেতনাগত ধর্মীয়বোধকে একক করে।


ধর্মীয় কাতরতাবোধ রবীন্দ্রনাথকে ক’রে তোলে চেতনাগত’র বহিঃপ্রকাশ রূপে। যেখানে তিনি আকুলতা ছাড়া আর কিছুই প্রার্থনা করেন না। আকুলতার পর আকুলতা কবিকে ক’রে তোলে এক বিশ্বজনীন বিশ্বাসী রূপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন :‘আমি এখন তোমার নিকট শক্তি প্রার্থনা করি না, আমাকে প্রেম দাও, আমি সংসারে জয়ী হতে চাহি না, তোমার নিকট প্রণত হইতে চাই, আমি সুখ দুঃখকে অবজ্ঞা করিতে চাহি না, সুখ, দুঃখকে তোমার মঙ্গল হস্তের দান বলিয়া বিনয়ে গ্রহণ করিতে চাই।’


ব্যর্থ আর ব্যকুল হৃদয় এক সময় একাকার হ’য়ে উঠে রবীন্দ্রনাথের নিকট মনোভাবনা এবং তার বিনাশ ঘটে যেন খুব কম সময়ে। তিনি হ’য়ে উঠেন এক বহিঃস্থরূপে। ভাবনা আর চেতনাগত দিকগুলো খুব দীর্ঘ হ’য়ে উঠে না, যেভাবে উঠেছিল স্বপ্নগুলো। তিনি বলেন ঃ‘আজ আমি আর কিছুই চাই না, আমি আজ পাইবার প্রার্থনা করিব না, আজ আমি দিতে চাই, দিবার শক্তি চাই, তোমার কাছে আমি আপনাকে পরিপূর্ণরূপে রিক্ত করিব, রিক্ত করিয়া পরিপূর্ণ করিব। তোমার সংসারে কর্মের দ্বারা তোমার যে সেবা করিব, তাহা নিরন্তর হইয়া আমার প্রেমকে জাগ্রত নিষ্ঠাবান করিয়া রাখুক, তোমার অমৃত সমুদ্রের মধ্যে অতলস্পর্শ যে বিশ্রাম তাহাও আমাকে অবসানহীন শান্তি দান করুক। তুমি দিনে দিনে স্তরে স্তরে আমাকে শতদল পদ্মের ন্যায় বিশ্বজগতের মধ্যে বিকশিত করিয়া তোমারই পূজার অর্ঘ্যরূপে গ্রহণ করো।’


ধর্ম এবং তার ভাববোধকে আরো গভীর ক’রে তোলে তাঁর আবশ্যিকতা থেকে যেখানে এইবোধ প্রকাশ পায় সর্বশ্রেষ্ঠরূপে। প্রয়োজনীয়তা এবং তার বোধ বিশ্লেষণ তাঁকে আরো ব্যাপক করে তোলে ধর্মীয়বোধ থেকে। যে ধর্মীয়বোধ একক ক’রে তোলে রবীন্দ্রনাথকে। ব্যক্তি এবং সার্বজনীন জীবনে কতটুকু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এই ধর্মবোধের। যাহা-কে কবি আহ্বান করেন ভাবনা আর চেতনা দিয়ে। যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের চিত্তে। ব্যক্তিজীবন এবং পারিপার্শ্বিকতা কতটুকু প্রভাব বিস্তার তার ধর্মীয়বোধ বা চেতনায় ক’রে যে চেতনার ব্যাপক বিস্তৃত উপস্থিতি রয়েছে রবীন্দ্র ভাবনায়। সকল সৌন্দর্য, প্রেম এবং মানব প্রকৃতি সবই একক হয়ে ওঠে ভাবনা বা তার চেতনার দ্বারা যে চেতনার ব্যাপক বিস্তৃত-বিস্তার ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। একক চেতনার ভাবনা বিস্তার থেকে, তার ব্যাপক বিস্তৃত ভাব বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথকে      ক’রে তোলে আরো বেশি চেতনাময়। যে চেতনায় মগ্ন রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। চিত্র্য- বৈচিত্র্য ভাবনাময় জগৎ এক সময় রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে উঠে ধর্মীয় চেতনাময় জগৎ হ’য়ে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন: ‘ধর্ম আমাদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যক সন্দেহ নাই-কিন্তু সেই জন্যই তাহাকে নিজের উপযোগী করিয়া লইতে গেলেই তাহার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যকতাই নষ্ট হইয়া যায়। তাহা দেশকাল পাত্রের ক্ষুদ্র-প্রভেদের অতীত, তাহা নিরঞ্জন বিকারবিহীন বলিয়াই তাহা আমাদের চিরদিনের পক্ষে আমাদের সমস্ত অবস্থার পক্ষে এত একান্ত আবশ্যক। তাহা আমাদের অতীত বলিয়াই তাহা আমাদিগকে নিত্যকাল সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে ধ্রুব অবলম্বন দান করে। কিন্তু ধর্মকে ধারণা করতে হইবে তো। ধারনা করিতে হইলে তাহাকে আমাদের প্রকৃতির অনুযায়ী করিয়া লইতে হয়। অথচ মানব প্রকৃতি বিচিত্র-সুতরাং সেই বৈচিত্র্য-অনুসারে যাহা এক, তাহা অনেক হইয়া উঠে। যেখানে অনেক, সেখানে জটিলতা অনিবার্য-সেখানে জটিলতা, সেখানে বিরোধ আপনি আসিয়া পড়ে।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম’-কে ধারণ করেছেন বিস্তারমুখী চেতনাদ্বারা। যে চেতনায় আশা-ভরসায় চিত্ত পূর্ণ হ’য়ে আসে প্রেম, সুন্দর, সত্য এবং প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে। এই বিশ্বাস তাঁর চেতনা দ্বারা কতটা ধ্রুব হ’য়ে ওঠে তাহা ভাব আর ভাবনা কে বিচিত্র মুখী ক’রে তোলে। আনন্দ এবং প্রেমকে সন্নিবেশ করেন ধর্মীয় ভাবদ্বারা। যে ভাবনায় একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেন আপনসত্তায়। বিস্তারমুখী- ধর্মীয়ভাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ক’রে তোলে এক চরম বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে। যেখানে বিশ্বাসী হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ নিজ সোপানে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন: “ঈশ্বর সম্বন্ধে যত কথা আছে, এই কথাই সর্বাপেক্ষা সরল, সর্বাপেক্ষা সহজ। ব্রহ্মের এই ভাব গ্রহণ করিবার জন্য কিছু কল্পনা করিতে হয় না, কিছু রচনা করিতে হয় না, দূরে যাইতে হয় না, দিনক্ষনের অপেক্ষা করিতে হয় না। -হৃদয়ের মধ্যে আগ্রহ উপস্থিত হইলেই, তাঁহাকে উপলব্ধি করিবার-যথার্থ ইচ্ছা জন্মিলেই, নিঃশ্বাসের মধ্যে তাহার আনন্দ প্রবাহিত হয়, প্রাণে তাঁহার আনন্দ কম্পিত হয়, বুদ্ধিতে তাঁহার আনন্দ বিকীর্ণ হয়, ভোগে তাঁহার আনন্দ প্রতিবিম্বিত দেখি। দিনের আলোক যেমন কেবলমাত্র চক্ষু মেলিবার অপেক্ষা রাখে, ব্রহ্মের আনন্দ সেইরূপ হৃদয় উন্মীলনের অপেক্ষা রাখে মাত্র।”


ঈশ্বর ভাবনা এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে ওঠে এক নৈতিক দায়িত্ব। যে দায়িত্ব বা কতর্ব্য জ্ঞান থেকে তিনি বিচ্যুতি ঘটাননি নিজের ভাব-বিশ্লেষণকে। বিশ্বলোকে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতিকে আরো গভীর ক’রে তোলেন প্রতি মুহূর্তে এবং ব্যাপক ভাবে। শক্তির সাথে সৌন্দর্য এবং প্রেমকে একই বৃত্তে নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ। যা সমগ্রভাব নিজস্ব সত্তায় গেঁথে থাকে সু-দৃঢ় ভাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন:
‘এই বিশ্বলোকের মধ্যে সেই বিশ্বলোকেস্বরের যে শক্তি প্রত্যক্ষ, তাহাকেই ধ্যান করি। এইবার উপলব্ধি করি বিপুল বিশ্বজগৎ একসঙ্গে এই মুহূর্তে এবং প্রতিমুহূর্তেই তাহা হইতে অবিশ্রাম বিকীর্ণ হইতেছে। আমরা যাহাকে দেখিয়া শেষ করিতে পারি না, জানিয়া অন্ত করতে পারি না, তাহা সমগ্রভাব নিয়তই তিনি প্রেরণ করিতেছেন। এই বিশ্ব প্রকাশক অসীম, শক্তির সহিত আমার অব্যবহিত সম্পর্ক কী সূত্রে? কোন সূত্র অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে ধ্যান করিব।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার ধ্যান করেন একাগ্রচিত্তে মন ও মননে। তিনি বলেন: ‘যিনি আমাদিগকে বুদ্ধিবৃত্তি সকল প্রেরণ করিতেছেন, তাঁহার প্রেরিত সেই ধীসূত্রেই তাঁহাকে ধ্যান করিব। সূর্যের প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষভাব কিসের দ্বারা জানি? সূর্য নিজে আমাদিগকে যে কিরণ প্রেরণ করিতেছেন, সেই কিরণেরই দ্বারা। সেই রূপ বিশ্বজগতের সবিতা আমাদের মধ্যে অহরহ যে ধীশক্তি প্রেরণ করিতেছেন-যে শক্তি থাকাতেই আমি নিজেকে ও বাহিরের সমস্ত প্রত্যক্ষ ব্যাপারকে উপলব্ধি করিতেছে-সেই ধীশক্তি তাঁহারই শক্তি-এবং সেই ধীশক্তি দ্বারাই তাঁহারই শক্তি প্রত্যক্ষভাবে অন্তরের মধ্যে অন্তরতম রূপে অনুভব করিতে পারি।’


‘সত্য’ এবং ‘ধর্ম’, ‘ধর্ম ও ‘সত্য’-একই ভাবে জড়ো হয় তাঁর আপন চিত্তে। যেখানে রয়েছে ধর্ম ভাবনা, সেখানেই উপস্থিত করেছেন সত্যকে। সত্য, আলো, সুন্দর- এই ভাবগুলো একইভাবে একক হ’য়ে উঠে সত্যের মধ্যে দিয়ে। যে সত্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধারণ করেছেন সত্য ও সুন্দর রূপে।
ধর্ম ও সত্যকে তিনি কখনও ভাবতে শিখেননি পৃথক ভাবে, বরং ধারণ করেছেন একই সাথে মেধা ও মননে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন-ই চিন্তা করেছেন ধর্ম বা তাঁর তাৎপর্যময় সংজ্ঞা নিয়ে, পাশেই অবস্থান করিয়েছেন ‘সত্য’ নামক বস্তুকে, যা কখনও সত্য বা অসত্য হয়ে রয়।


‘সত্য’-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাগ্রচিত্তে বলেন: ‘আমাদের অভাব কেবল সত্যের অভাব, আলোকের অভাব, অমৃতের অভাব-আমাদের জীবনের সমস্ত দুঃখ পাপ নিরানন্দ কেবল এই জন্যই। সত্যের জ্যোতির অমৃতের ঐশ্বর্য যিনি কিছু পাইয়াছেন, তিনিই জানেন, ইহাতে আমাদের জীবনের সমস্ত অভাবের একেবারে মূল্যচ্ছেদ করিয়া দেয়। যে সকল ব্যাঘাতে তাঁহার প্রকাশকে আমাদের নিকট হইতে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, তাহাই বিচিত্ররূপ ধারণ করিয়া আমাদিগকে নানা দুঃখ এবং অকৃতিমত্তার মধ্যে অবতীর্ণ করিয়া দেয়। সেই জন্যেই আমাদের মন অসত্য অন্ধকার ও বিনাশের আবরণ হইতে রক্ষা চাহে।’


ধ্যান, সত্য, প্রার্থনা, অন্ধকার এবং তাঁর সাথে নিজের আত্মার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্তর এবং তাঁর বাহিরকে আত্মস্থ করিয়েছেন ধ্যানের মাধ্যমে। ধ্যান বা প্রার্থনা-প্রকাশ পায় ধর্মীয় চেতনার-সবচেয়ে বহিঃস্থরূপটি নিয়ে। যাঁর মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যক্তি হ’য়ে উঠে ধর্মীয় ভাব বা চেতনায় ধর্মীয় লোক ব’লে। প্রার্থনা বা ধ্যানকে উপলব্ধি করেছেন আত্মার চেতনালোকের গভীরে নিয়ে, যেখানে তাঁর উদার চিত্তের নির্মল বহিঃপ্রকাশ রয়েছে।


প্রার্থনা, চেতনালোকের বিশ্বাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: আমরা ধ্যান যোগে আমাদের অন্তর বাহিরকে যেমন বিশ্বেস্বরের দ্বারাই বিকীর্ণ দেখিতে চেষ্টা করিব তেমনি আমরা প্রার্থনা করিব যে, যে সত্য যে জ্যোতি যে অমৃতের মধ্যে আমরা নিত্যই রহিয়াছি তাহাকে সচেতনভাবে জানিবার যাহা কিছু বাধা, সেই অসত্য সেই অন্ধকার সেই মৃত্যু যেন দূর হইয়া যায়। যাহা নাই তাহা চাই না, আমাদের যাহা আছে তাহাকেই পাইব, ইহাই আমাদের প্রার্থনার বিষয়, যাহা দূরে তাহাকে সন্ধান করিব না, যাহা আমাদের ধীশক্তিতেই প্রকাশিত তাহাকেই আমরা-উপলব্ধি করিব, ইহাই আমাদের ধ্যানের লক্ষ্য। আমাদের প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্ম এইরূপ সরল, এইরূপ উদার, এইরূপ অন্তরঙ্গ, তাহাতে স্বরচিত কল্পনাকুহকের স্পর্শ নাই।’


দুঃখ, শোক, তাপ, শক্তি, উদারতা এবং তার মহত্ব ইত্যাদি শব্দগুলোকে আরো জোড়ালোভাবে চেতনায় স্থির ক’রে নেন রবীন্দ্রনাথ। যার ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবহার ঘটিয়েছেন সমস্ত রচনা জুঁড়ে। যেখানে তিনি স্বাধীন, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারী। ‘ধর্ম’- ‘সত্য’-আবার কখনও হ’য়ে ওঠে মানব সমাজের উপাদান ব’লে এবং কখনও সেটাই আবার ফিরে আসে ভারতবর্ষ বা তাঁর আপন লোকে। সেখানে তা ‘সত্য’ বা ‘অ-সত্য’ হ’য়ে রয়। রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থায় কখনো তার ব্যবহার ঘটিয়েছেন শিক্ষা, খষি বা উপনিষদের দ্বারা, যেখানে অবতীর্ণ হয়েছেন অগ্রপথিকের ন্যায়, যিনি সর্বদা এগিয়ে রয়েছেন অন্যদের চেয়ে একটু এগিয়ে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন :
‘একদিন নানা দুঃখ ও আঘাতে বৃহৎ শ্মশানের মধ্যে এই দুর্যোগের নিবৃত্তি হইবে-তখন যদি মানবসমাজ এই কথা বলে যে, শক্তির পূজা, ক্ষমতার মত্ততা, স্বার্থের দারুণ দুঃচেষ্টা যখন প্রবলতম, মোহান্ধকার কখন ঘনীভূত এবং দলবদ্ধ ক্ষুধিত আত্ম-ম্ভরিতা যখন উত্তরে-দক্ষিণে পূর্বে-পশ্চিমে গর্জন করিয়া ফিরিতেছিল, তখনো ভারতবর্ষ আপন ধর্ম হারায় নাই, বিশ্বাস ত্যাগ করেন নাই, একমাত্র নিত্যসত্যের প্রতি নিষ্ঠা স্থির রাখিয়াছিল। একের আনন্দ ব্রহ্মের আনন্দ, যিনি জানিয়েছেন, তিনি কিছু হইতেই ভয় প্রাপ্ত হন না। ইহাই যদি হয় তবে ভারতবর্ষে খষিদেব জন্ম, উপনিষদের শিক্ষা, গীতার উপদেশ, বহুশতাব্দী হইতে নানা দুঃখ ও অবমাননা, সমস্তই সার্থক হইবে-ধৈর্য্যরে দ্বারা সার্থক হইবে, ধর্মের দ্বারা সার্থক হইবে, ব্রহ্মের দ্বারা সার্থক হইবে।‘দম্ভের দ্বারা নহে, প্রতাপের দ্বারা নহে, স্বার্থসিদ্ধির দ্বারা নহে।’


দুঃখ, শোক, অনুতাপ, এগুলোকে জড়ো ক’রে রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে যান আপনলোকে যেখানে তিনি নিজেকে বিকশিত করতে পারেন আপন হৃদয়বৃত্তির বিস্তার ঘটিয়ে। মন এবং বিশ্বলোক এক হ’য়ে যায়। প্রার্থনা, দুঃখ-তাপ, এবং আপন বিশ্বলোকে নিমগ্ন থাকেন নিজের চেতনার ধর্মবিশ্বাস দ্বারা। বিশ্বাস বা হৃদয়বৃত্তির বহিঃ প্রকাশ যা-ই বলি না কেন, রবীন্দ্রচেতনায় উন্মেষ ঘটে এক ধর্মীয় বিশ্বাস বোধের। যে বোধ বা শক্তির একক অগ্রদূত হ’য়ে রয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই। তাই আবার ‘দুঃখ’ সম্পর্কে বলেন:
‘দুঃখের মধ্যে, শোকের মধ্যে, অভাবের মধ্যে নতমস্তকে তাঁহাকেই স্বীকার করি যাহার মধ্যে যুগযুগান্তর হইতে সমস্ত জগৎ সংসারে সমস্ত দুঃখ তাপের সমস্ত তাৎপর্য অখণ্ড মঙ্গলে পরিসমাপ্ত হইয়া আছে।’


প্রার্থনা, কামনা, সত্য, ঈশ্বর ভাবনা, গৌরব এবং তাতে তুষ্টি ইত্যাদি প্রকাশ পায় রবীন্দ্র ভাবনায়। সত্যকে ধারণ ক্ষমতা ব্যাপক হ’য়ে উঠে প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। যে প্রার্থনা কেবল মাত্র আপনলোকের বহিঃপ্রকাশ নয়, তা হ’য়ে ওঠে ঈশ্বরের নিকট নিজের আকুল আর ব্যাকুলচিত্তের মনোবাসনা পূর্ণ উক্তি। প্রাপ্তি এবং প্রার্থনা পূর্বের ‘ধর্ম’ এবং ‘সত্যের’ ন্যায়- এখানে আবার নিজের মতো হ’য়ে উঠে। যার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র মনোভাব বা সফলতার যাদুর কাঠির আকার ধারণ ক’রে যা কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই তার কষ্টের নিঃসারন ঘটায়। সত্য, অসত্য প্রাপ্তি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আবার রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে উঠে ঈশ্বর ভাবনার মতো।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন :
(ক) ‘ইহা মনে রাখিতে হইবে, আমাদিগকে যাহা কিছু দিবার তাহা আমাদের প্রার্থনার বহুপূর্বেই দেওয়া হইয়া গেছে। আমাদের যথার্থ ঈপ্সিত ধনের দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত বাকি আছে কেবল লইবার চেষ্টা, তাহাই যথার্থ প্রার্থনা।’
(খ)‘ ঈশ্বর এইখানেই আমাদের গৌরব রক্ষা করিয়াছেন। তিনিই সব দিয়াছেন। অথচ এটুকু আমাদের বলিবার মুখ রাখিয়াছেন যে, আমরাই লইয়াছি। এই লওয়াটাই সফলতা, ইহাই লাভ-পাওয়াটা সকল সময়ে লাভ নহে- তাহা অধিকাংশস্থলেই পাইয়াও না পাওয়া, অবশিষ্টস্থলে বিষম একটা বোঝা।’


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম, সাধনা, প্রার্থনা, সত্য-অসত্য, সুন্দর, অসুন্দর ইত্যাদি পর্বগুলো চেতনালোকের প্রকাশ ঘটিয়ে স্থির হননি। তিনি বলেছেন ধর্ম এবং তার প্রচার কার্য নিয়ে। যে ধর্মকে রক্ষণাবেক্ষণ এবং চেতনায় ধারণ করলেই রক্ষা পাবে ধর্ম। প্রচারের মাধ্যমে ধর্মের প্রকাশ না তাকে রক্ষা করলেই তার প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ করেছেন, ধর্মীয় চেতনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি।


তাই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন: ‘ধর্ম প্রচার কার্য ধর্মটা আগে, প্রচারটা তাহার পরে। প্রচার করিলেই তবে ধর্মরক্ষা হইবে, তাহা নহে, ধর্মকে রক্ষা করিলেই প্রচার আপনি হইবে। মনুষ্যত্বের সমস্ত মহাসত্যগুলিই পুরাতন এবং ‘ঈশ্বর আছেন’ একথা পুরাতনতম। এই পুরাতনকে মানুষের কাছে চিরদিন  নূতন করিয়া রাখাই মহাপুরুষের কাজ। জগতের চিরন্তন ধর্মগুরুগণ কোনো নূতন সত্য আবিষ্কার করিয়াছেন, তাহা নহে-তাঁহারা পুরাতনকে তাঁহাদের জীবনের মধ্যে নূতন করিয়া পাইয়াছেন এবং সংসারের মধ্যে তাহাকে নূতন করিয়া তুলিয়াছেন।’