‘সুধীন্দ্রনাথ বিশশতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তাঁর মতো নানা গুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি’। উপরোক্ত মন্তব্যটি সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন-বুদ্ধদেব বসু। অন্য কেউ সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কতোটুকু জানে বা বুঝে তা আমার আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু এতোটুকু বলতে পারি, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথকে চিনতে পেরেছিলেন তাঁর নিজের মতো করে; তা না হ’লে বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি আখ্যায়িত করা তাঁর পক্ষে এতো সহজ হতো না। বুদ্ধদেব বসুর সাথে যাঁদের সম্পর্ক ছিল বিশেষ করে কবিদের কথাই বলবো তিনি যদি বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি না বলে কয়েকজন বাঙালির কথা বলতেন তাহ’লে ভুল হতো না। সুধীন্দ্রনাথ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বাঙলা কবিতায় দেখা দেন নি। যেমন ভাবে দেখা দেয় বাঙলায় কিছু কবিরা। সুধীন্দ্রনাথ নিজেকে শুধু কবিতার দিক দিয়ে নয়, অন্য সকল দিক দিয়েও প্রস্তুত করতে থাকেন নিজেকে। বহু ভাষা বিষয়ে জ্ঞান, প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, তীক্ষ্ম বিশ্লেষণধর্মী আলোকময় বুদ্ধির অধিকারী এবং বিপুল পরিমাণে তথ্যে ও তত্ত্বে পরিপূর্ণ ছিলেন তিনি।


একজন কবির শুধু কি কবিতা রচনার ক্ষমতা থাকলেই হলো নাকি অন্যে কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে? আমার মনে হয় তা সুধীন্দ্রনাথকে না বুঝলে কখনো সম্ভাবপর হয়ে উঠে না। আধুনিক চিন্তা, চেতনা ও মননশীলতায় সম্পূর্ণ সুধীন্দ্রনাথের কি কি গুণ ছিল তা না বলে যদি বলি তার কি ছিল না। তাহলে হয়তো আমার ভুল হবে না। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে সকল মন্তব্যগুলি প্রকাশ করেছেন তা শুধু বুদ্ধদেব কেন আমরা যারা কবিতার সাথে পরিচিত তাঁরা নির্বিশেষে মেনে নিতে বাধ্য। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এতোটাই সজাগ ছিলেন যে, তাঁর প্রতিভার প্রাচুর্য এমন হওয়া সত্ত্বেও তিনি কেন কবিতার মতো একটা নিরীহ ব্যাপার নিয়ে জীবন কাটালেন, তা ভেবে উঠতেই তিনি আশ্চর্য হোন। আসলে এ রকম ব্যাপারগুলোকে আমরা কি বলবো ভালোলাগা নাকি চরম ভালোলাগা বা কবিতার প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ করা। সুধীন্দ্রনাথ কবিতা না লিখে যদি নিজেকে অধিষ্ঠিত করতেন সমাজের অন্য কোন পেশায় তাহ’লে অনেক কম সময়ে পৌঁছে যেতেন উচ্চতম স্থানটিতে। উচ্চতম স্থানটিতে পৌঁছাতে যা প্রয়োজন হতো তার সবই ছিল সুধীন্দ্রনাথের। কিন্তু তিনি কেন কবিতা লিখলেন? নিজেকের মুক্ত করার জন্য নাকি কবিতাকে সমৃদ্ধ করার জন্য? সুধীন্দ্রনাথ যদি বাঙলায় কোনো কবিতা না লিখতেন তাহলে কি কোনো ক্ষতি ছিল বাঙলা কবিতার? নাকি সুধীন্দ্রনাথ কবিতা লিখে আমাদের দেখিয়ে গেলেন কবি আর অ-কবির মধ্যে কতোটা পার্থক্য থাকতে পারে।


সুধীন্দ্রনাথ ‘স্বভাব কবি নন, ছিলেন স্বাভাবিক কবি।’ তা না হ’লে কবিতা নিয়ে এতো মান বিচার করা তাঁর প্রয়োজন হতো না। যেমনটা প্রয়োজন হয় না স্বভাব কবিদের। সুধীন্দ্রনাথের কবিতা লেখা-ব্যাপারটি বুদ্ধদেবের কাছে যতোটা আশ্চর্যের ব্যাপার মনে হয়েছে, এমনটি হয়নি অন্য কারো কাছে। কবি বা কবিতা সম্পর্কে কোন নিগূঢ় আলোচনা করতে গিয়ে এমনটি হতে হয় কবিদের। আমার মনে হয়েছে, সুধীন্দ্রনাথের এতো প্রস্তুতিমূলক মনোভাবই আশ্চর্য করেছে বুদ্ধদেবকে, যিনি নিজে কবি হয়েও হয়তো এতোটা বুঝতে পারেননি। তা না হ’লে তিনি যখন বলেন ঃ ‘সুধীন্দ্রনাথ যদি কবি না হতেন, তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব এ রকম হতো না’। কিংবা বুদ্ধদেব আবার যখন বলেন ঃ ‘সুধীন্দ্রনাথ যদি ভিন্ন ধরনের কবি হতেন তাহ’লে তাঁর জীবনও ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ধরনের হতো’। ‘আমি শেষ বাক্যটি থেকে একটি কথা বলতে চাচ্ছি, ‘ভিন্ন ধরনের কবি হতেন’, আসলে বুদ্ধদেব বসু ভিন্ন ধরনের কবি বলতে কি বা কাদের বুঝাতে চেয়েছেন সেটা আমার বোধগম্য নয়।


সুধীন্দ্রনাথ, প্রথমদিকে বাঙলা ভাষা যাঁর আয়ত্তে ছিল না। পরবর্তীতে  সেই ভাষায় কাব্য সাধনা করা, এমন হওয়াটাকে আমাদের ভাষায় কি বলা যেতে পারে। সুধীন্দ্রনাথ সাত বৎসর বিপুল পরিশ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে ‘তন্বী’ নামক কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ ক’রে বাঙলা কবিতায় প্রবেশ করেন। একের পর এক প্রকাশ করেন: ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫) ‘ক্রান্দসী’ (১৩৪৪), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৩৪৭), ‘সংবর্ত’, (১৩৬০), ‘দশমী’ (১৩৬৩), অনুবাদগ্রন্থ ‘প্রতিধ্বনি’ (১৩৬১)। লিখেছেন দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ; ‘স্বগত’, (১৩৪৫), ‘কুলায় ও কালপুরুষ’ (১৩৬৪)। একযুগ সময় ধরে সম্পাদনা করেছেন ‘পরিচয়’ নামক সাহিত্য নির্ভর পত্রিকা। কিছু ছোটো গল্প ও উপন্যাস তিনি লিখেছেন।


সুধীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন হঠাৎ করেই কোন মৌলিক জিনিস দেখা দিতে পারে না। আর তার জন্যেই আত্মোপলব্ধির এক স্বচ্ছ মুহূর্তে প্রকাশ করেছিলেন সেই বানী যা সকল কবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য: ‘আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি।’ বলা বাহুল্য, আসলেই তিনি আলোর দিকে উঠছেন। কতোটা আলো তাঁকে আলোকিত করেছিল তা-এখন বলার অপেক্ষা রাখে না। সুধীন্দ্রর কবিতা আলোর সর্বোচ্চ স্থানটিতে পৌঁছতে পেরেছিলো। বাইরে থেকে প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে সুধীন্দ্রনাথ নিজেকে আরো সৃষ্টিশীল পর্যায় পর্যন্ত পরিচালিত করতে থাকেন। (১৯৩০-১৯৪০)-এই দশকটাকে সুধীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনার মধ্যে থেকে প্রধান সৃষ্টিশীল রচনার জন্মকাল ব’লে আখ্যায়িত করা হয়। যেহেতু ‘অর্কেস্ট্রা’, ‘ক্রন্দসী’, ‘উত্তরফাল্গুনী,’ ‘সংর্বত’ সমগ্র কাব্য ও গদ্য অনুবাদ এবং প্রবন্ধের দু’টি আলোকময় গ্রন্থ তিনি এই দশকেই সম্পূর্ণ করে তোলেন। আমি ভেবে আরো বেশি আশ্চর্য হই এ জন্য যে, এতো কিছু রচনার মধ্যে দিয়েও ‘পরিচয়ের’ একটি প্রোজ্জ্বল পর্যায়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকেন। তিনি নির্ঝর ভাবে প্রবাহিত হয়েছেন সৃষ্টিশীলতার দিকে। সুধীন্দ্রনাথ শুরু করা মাত্রই তা সম্পূর্ণ ক’রে ওঠেছেন এবং আবার নতুন কিছু শুরু করেছেন। এভাবেই পরিচালিত করেছেন নিজেকে। সর্বোপরি তিনি একই সময়ে বিভিন্ন লেখাগুলো লিখতে থাকেন। যেন সৃষ্টির জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তাঁর উপর।


বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেছেন অভিধানের মতো। কারণ, ‘সুধীন্দ্রনাথ-ই একমাত্র কবি যিনি উত্তর জীবনে বাঙলা ও বাঙলায় ব্যবহারযোগ্য প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের নির্ভূল বানান জানতেন। সুধীন্দ্রনাথ, কবিতার জন্যেই বলি বা জ্ঞানের জন্যেই বলি না কেন, সর্বদিকে বিস্তৃতভাবে প্রসারিত করেছেন নিজেকে। যা অন্যে কারো মধ্যে দেখতে পাই না।


‘সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন : ‘তিনি আধুনিক বাঙলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকারাজ্জ্বল চেতনার কবি।’ সুধীন্দ্রনাথের নিরাশা অস্তিত্বের গহনে প্রবিষ্ট। আধুনিক বাঙলা কবিতায়, তাঁর সম-সময়ে তিনি-ই একমাত্র ‘অস্তিত্ববাদী’ কবি। সুধীন্দ্রনাথের চেতনায় অস্তিত্ববোধ ‘সর্বদাই এসেছে ‘না’-যুক্ত অস্তিত্ববাদী বা নাস্তিত্ববাদী কবি-ও বলতে পারি। অপরদিকে সুধীন্দ্রনাথকে বলতে পারি আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের ‘মেটাফিজিক্যাল’ নির্ভর কবি। যা তাঁর হাতেই হয়ে উঠে সম্পূর্ণ মেজাজ ও রীতিতে।
আমার এই লেখার শিরোনামটা ছিল সুধীন্দ্রনাথের কবিতা ‘দুর্বোধ্য না দুরূহ’, তা কিন্তু আমি এখনও প্রকাশ করি নি।


সুধীন্দ্রনাথের কবিতা রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো পড়া মাত্রই প্রবেশ করে না অভ্যন্তরে। দুর্বোধ্যের আভিধানিক অর্থ এ রকম যা বুঝতে পারা কঠিন বা অর্থোদ্বার করা কঠিন। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথের কবিতা অর্থোদ্বার করা কিছুট কঠিন হলেও বুঝতে পারা যাবে না এমনটা নয়। হয়তো প্রথমবার পড়ামাত্রই সম্পূটা বুঝা হ’য়ে উঠে না। কিছু শব্দের অর্থোদ্বার করতে পারলেই কোনো অসুবিধা থাকে না। আর ‘দুরূহ’ যার আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় সু-কঠিন বা কষ্টসাধ্য বা অত্যন্ত কষ্টে সাধনা করা হয় এমন। সুন্দর কিন্তু কঠিন এ রকম সুধীন্দ্রনাথের কবিতা। সুন্দর তা ঠিক আছে আর কঠিন তা আমি প্রথমেই বলেছি কিছু শব্দের অর্থোদ্ধার। শব্দগুলোর অর্থ বের করতে পারলেই এই কঠিন আর কঠিন থাকে না।