সৈয়দ শামসুল হক বাঙলাদেশের প্রধান কবিদের অন্যতম। যিনি একটি কালের অন্তর্গত হয়েও চেয়েছেন কাল অতিক্রম করে যেতে। লেখালেখির সাথে জড়িত রয়েছেন প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। বলতে গেলে, সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাগুলোতে হাত রেখেছেন সমানভাবে। কবিতা ও কথাসাহিত্যগুলোর সৃষ্টির অন্যতম। তিনি যেমন সুপরিচিত, তেমন সমানভাবে জনপ্রিয়, এবং প্রাজ্ঞজন সর্বমহলে। তাঁর এই সব সৃষ্টিকর্মগুলোর মধ্যে থেকে কবিতা সবচেয়ে বেশি আলোড়িত ক’রে আমাকে। কাব্যসমগ্র প্রকাশের স্বপ্ন গেঁথে থাকে সকল কবিদের এবং একটা সময় এসে তা প্রকাশ পায়। গত শতকের শেষ দশকে প্রকাশ পায় তাঁর সেই স্বপ্নময় কাব্যসমগ্র। যা অন্যের কাছেও স্বপ্নীল হ’য়ে দেখা দেয়। যদিও তাঁর কবিতা স্থবির নয়, বরং তা অন্য সকলের কাছে ধরা দেয় স্নিগ্ধ হ’য়ে এবং আলোড়িত করতে পারে দিনের পর দিন। কাব্যসমগ্রের ভূমিকাতে তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতা লেখার প্রক্রিয়াটি।


সৈয়দ হকের, কাব্য সমগ্র (১৯৯৭)-এ প্রবেশ করানো হয়েছে চৌদ্দটি কাব্যগ্রন্থ। ‘একদা এক রাজ্য’, ‘বিরতিহীন উৎসব,’ ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা,’ ‘প্রতিধ্বনিগণ’, ‘অপর পুরুষ’, ‘নিজস্ব বিষয়’, ‘পরাণের গহীন ভিতর’, ‘এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি’, ‘বেজান শহরের জন্যে কোরাস,’ ‘রজ্জুপথে চলেছি,’ অগ্নি ও জলের কবিতা,’ ‘কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে,’ ‘আমি জন্মগ্রহণ করিনি’, এবং ‘নাভিমূলে ভস্মধ্যের’। এই চৌদ্দটি কাব্যগ্রন্থে রয়েছে তিন শতকেরও কিছু বেশি কবিতা।


কাব্যসংগ্রহ ব্যতীতও আলোড়িত করতে পারে আমাদেরকে। সৈয়দ হক, পঙ্ক্তি নিয়ে লেখেছেন এবং বিন্যস্ত করেছেন বিভিন্নভাবে। যখন যেভাবে চেয়েছেন। কবিতার অনুবাদ করা তো আসলে নতুন ও নিজেরই একটি কবিতা লেখা, প্রকাশ করেছেন স্ব-চিত্তে। যেমন তিনি রচনা করেছেন এক পঙ্ক্তিবিশিষ্ট কবিতা। আবার কখনও লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা। ‘গেরিলার’ শব্দ বিন্যাস যেমন আমাকে মুগ্ধ ক’রে তেমনি ‘এই বর্তমান’ করে আলোচিত। বর্তমান সময়ে তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় দুঃখ ভারাক্রান্ত প্রেম, অপর দিকে ভালোবাসার প্রবাহিত ধারা।


সৈয়দ শামসুল হক, গাণিতিক সংখ্যা ব্যবহার করে নাম রেখেছেন একাধিক কবিতার। ওই সকল কবিতাগুলো এক একটি স্বতন্ত্র কবিতা হ’য়ে দেখা দেয়। যদিও প্রত্যকটি কবিতা পৃথক রয়েছে অপর একটি কবিতা থেকে। যেমন আমি উল্লেখ করতে চাই ঃ ‘কবিতা ২১২’, ‘কবিতা ২১৯’, ‘কবিতা ২২৮’ ইত্যাদি। তিনি এখানে গাণিতিক সংখ্যাগুলো দ্বারা কি প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। এরকম ভাবে আবার কিছু কবিতা আমরা দেখতে পাই ঃ ‘নোট বই থেকে’ নামক কবিতাগুলোকে ‘নোটবই থেকে-১’, ‘নোট বই থেকে-২’, ‘নোট বই থেকে-৩’, পর্যায়ক্রমে পাওয়া যাবে পাঁচ পর্যন্ত কবিতা।


বেশ কিছু সূত্র সৃষ্টি ক’রে রচনা করেছেন কয়েকটি কবিতা। যেমন মনে করতে চাই ‘বোধন সূত্র’, ‘সম্মোন সূত্র’, ‘প্রতিষ্ঠাসূত্র’, ‘পরিণয় সূত্র,’ ‘স্মরণ সূত্র’ বিদায় সূত্র’ ইত্যাদি। এরকম আরো কিছু সূত্র সৃষ্টি করে কবিতা লিখলে খারাপ হতো না, বরং আরো বেশি ভালো হতো।


কবিতা রচনার এই রকম ব্যাপক বৈচ্যিত্রতা আর কারো মাঝে পাই না। তিনি যেমন রচনা করেছেন ছোট কবিতা আবার অপরদিকে রয়েছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর কবিতা। সৈয়দ হক রচনা করেছেন অনেক কিছু, কিন্তু কাব্য সমগ্র পড়ার পর বার বার-ই মনে হয়েছে, তিনি যা বলতে চেয়েছেন বা যে সকল দুঃখ, সুখ, অনুতাপ, বেদনা প্রকাশ করতে চেয়েছেন তার সব কিছুর উপস্থিত রয়েছে কাব্যতে। একজন কবি তার সব কথাগুলি বলে উঠতে পারেন জীবনে রচিত সমস্ত কাব্যগ্রন্থগুলোতে?
শেষ করবো প্রিয় একটি কবিতা পড়ে:


“যে আমাকে ইচ্ছে করেছে,
আমি তার
আর যে আমাকে করেনি,
আমি তারো।
প্রেম একটা জীবনের মতো, জীবন অনেকের।”