না বলা কথা 
মোঃ ইব্রাহিম হোসেন
রচনাঃ ০৭-১২-২০২৩ ইং


এই! শোনো, একটু দাঁড়াও, তোমাকেই বলছি।
আমার মনের ভেতর অনেক কথা জমানো,
যা তোমাকে কখনোই বলা হয়নি, বলতে চেয়েও বলা হয়নি।


ভালোবাসা কি জানো?
ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে ধরে, শত কোটি বার আই লাভ ইউ বলে, মনের মানুষটার নাম ধরে ডাকলেও সাধ মেটে না, মেটে না তৃষ্ণা। 
আরও জড়িয়ে ধরে রাখতে চায়, আরও নাম ধরে ডাকতে চায় মন।


এই যে,  তুমি একটা নারী।
তোমার মাঝে যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে, পৃথিবীর অন্য সব নারীর মাঝেও তা-ই আছে।
কিন্তু তাদের জন্য তো মন কাঁদে না, তাদের জন্য তো চোখের অশ্রু ঝরে না, তাদের জন্য তো মন পুড়ে না।


আর তোমাকে, হ্যাঁ তোমাকে একটা নজর না দেখলে থাকতে পারি না, প্রাণটা ছটফট করে।
মন চায় কখন এক নজর তোমায় দেখবো, তোমার কোমল পরশ পাবো।
তারপর তোমাকে যখন এক পলক দেখি, মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সুখই আমি খুঁজে পেয়েছি, পেয়েছি স্বর্গের অমৃত ধারা। যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকার অবলম্বন।  এটাই ভালোবাসা।


তুমি জানতে, তোমার বাবা মা জানতো,  জানতো আরও এলাকাবাসীসহ অনেকেই।
আমি মনেপ্রাণে আমার জীবনের চেয়েও কতটা বেশি তোমাকে ভালোবাসি!


আচ্ছা বলো তো দেখি, আর কতটা ভালোবাসলে তোমাকে আপন করে আমার হৃদয়ের মণিকোঠে স্থান দিতে পারতাম?
হতে পারতাম তোমার আপনজন, সারাজীবন নয়ন মেলে দেখতাম।


না,  তা নয়,  আসলে আমার মনের ভেতরে তোমার মত বিশাল মনের অধিকারিণী মানুষটাকে আগলে রাখার জায়গা নাই! তাই তো এমনটি হলো।


আমার মা,  হ্যাঁ আমার মা, তোমার বাবার কাছে  প্রস্তাব নিয়ে গেছিলো তোমার আমার বিষয়ে,
তোমার বাবা বলেছিলো, "আরো বড় হোক ছেলে,
আমার মেয়ে কি? আমার মেয়ের থেকেও সুন্দর পুত্রবধূ এনে দেবো।"


অথচ, অথচ তোমার বিয়েটাও ভালোভাবে, আনুষ্ঠানিকভাবে হলো না, এক প্রকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জুলুমের ন্যায় রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তোমার শুভ কাজটি সম্পূর্ণ হলো, হলো তোমার হৃদয়ের লেনাদেনা অন্য একজনের সাথে।


আর তুমি তাতেই রাজি হয়ে গেলে !
কী আশ্চর্য! কী মহীয়সী নারী তুমি! 
আমার ভালোবাসার একটুও মূল্য দিলে না? 
বুঝলে না আমার ভালোবাসার মূল্য কত?
দিলে না এতটুকুও দাম !


তুমি বলতে পারবে? 
তোমার জন্মের পর তোমার বাবা মা আত্মীয় স্বজনরা কতবার তোমার নাম ধরে ডেকেছে?
তাদের থেকেও তোমার নামটি জপ করেছে এই আমার অবুঝ মন সহস্রবার, লাখো কোটিবার,
সবার অন্তরালে, অগোচরে।


শোনো!  তোমাকে কতটা ভালোবাসি?
আমার এখনো মনে পড়ে সে দিনের কথা।
তুমি আমি সে-ই ছোট বেলায় একই সাথে হাফপ্যান্ট পরে, খালি গায়ে ঘোরাফেরা করতাম, করতাম কত খেলাধুলা!


তোমার মাথার চুলগুলো ছিলো নজরুলের মতই বাবরি চুল, সবসময় ছিলো মুখে মিষ্টি মধুর হাসি,
নাক ছিলো উঁচু, চোখ-দুটো ছিলো দীঘল কালো।


ধীরে ধীরে তুমি আমি দু'জনেই একটু বড় হলাম,
জানতে পারলাম তোমার প্রকৃত নামের আড়ালে আরও একটা নাম আছে - সাইদা।


তোমাকে ভালোবেসে প্রথমে সে-ই নামটি  লিখি আমার শরীরের রক্তের কালিতে।
প্রকৃত নামটি খোদাই করে লিপিবদ্ধ রয়ে গেলো বাঁদিকের পাণিতে।


তোমাকে না পাওয়ার বেদনায় নিজের প্রাণ বলিদান দিতে উদ্যোমী হলাম।
সেদিন ছিলো বুধবার।


ভোরবেলায় পদ্মা নদীতে নৌকায় চড়ে
আমাদের ওপারের আমতলীর চরে
নিজের ক্ষেত থেকে পটল তুলে নিয়ে আসলাম,
মাকে তা দিলাম।
মা বললো, বাজারে তা বিক্রি করে অন্যন্য তরিতরকারি কিনে নিয়ে আয় বাবা।


আমি বাজারে গিয়ে তা বিক্রি করে (সবার অগোচরে গরলসহ) তরিতরকারি ও জিলাপি কিনে নিয়ে আসলাম।


বিকেল বেলা।
দরজায় ঢুকতেই দেখি মা রান্না করছে চুলায়।
মা বলে ডাকতেই আমার দিকে তাকানো মায়ের মিষ্টিমধুর হাসিমাখা বদন দেখে আমি আর আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।


এ-ই ভেবে যে, মাকে ছেড়ে চলে যাবো চিরতরে পরপারে।
মা আমার এতিম হয়ে যাবে।
কীভাবে আমাকে ছেড়ে মা একা থাকবে?
আমি ছাড়া যে পৃথিবীতে মা'র আর কেউ নাই।
তবুও যেন মন মানে না, বাঁচার ইচ্ছেও জাগে না অবুঝ মনে।


তোমাকে যে কথা দিয়েছিলাম, তোমাকে না পেলে আমি বাঁচবো না, চলে যাবো ওপারে।
তোমাকে পেলাম না, আমি বেঁচে থাকবো, তোমার যদি কোনো ক্ষতি হয় এ ভেবে।
বিশ্বাস করো, আমি চাইনি তোমার কখনো ক্ষতি।


গোধূলির ক্ষণ,
স্ব-হস্তে রক্তের লেখা একটা চিঠি শাখেনা নামের একটা মেয়ের হাতে পাঠালাম তুমি বরাবর।
তাতে যা লেখা ছিলো,


প্রাণের প্রিয়তমা!
আশা করি ভালোই আছো।
আমিও ভালোই আছি, আমার কথা ভেবো না।
তোমার কোনো দোষ দেবো না। যত দোষ সবই আমার। তবে একটা কথা, ভালোবাসার অপরাধে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর কোনো দিন তোমার সাথে দেখা হবে না, হবে না কোনো কথা। ডাকবো না আর প্রিয়া বলে, কাঁদবো না কভু আঁখিজলে।


চলে যাচ্ছি চিরতরে পরপারে। আর কোনো দিন ফিরে আসবো না, ডাকবো না প্রিয়া নাম ধরে।
আমার হৃদয়ের যত ভালোবাসা তোমার নামে সবই  দিলাম বলিদান, ভালো থেকো প্রিয় জান।
যেখানেই থাকো সুখে থেকো, সুখে থেকো চিরদিন। জীবন হোক স্বপ্নের রঙে রঙিন।
এ প্রত্যাশায় তোমার জন্য মহান রবের কাছে এ আমার শেষ দোয়া , আমার কিছু নাই আর চাওয়া পাওয়া।


ইতি:- তোমার পাগল প্রেমিক।


এরপর ঠিক মাগরিবের ক্ষণ। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। মা মাগরিবের নামাজ পড়ছে বারান্দায়। তিনদিন যাবৎ আমার খাওয়া দাওয়া নাই। পেটে  ক্ষুধাও যেন নাই, সব হারিয়ে গেছে।
চুপিচুপি মায়ের পাশ দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম।


গরল মিশ্রিত শরবত মুখের সামনে ধরলে তোমার হাজারও স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তোমার সুন্দর চেহেরাটা আমার চোখের তারায় ভেসে বেড়ায়। 
আরও কত কি যে মনে পড়ে তোমাকে না পাওয়ার বেদনায়।
শেষমেশ শরবত টুকু খেয়েই ফেললাম। তখনও মা নামাজ পড়ছে।


আমি আবার ছুটে দোকানে গেলাম, বিস্কুট কিনে এনে তোমার মামাসহ অনেকের মাঝে বিতরণ করলাম আর আমার জন্য দোয়া করতে বললাম।


একটু আঁধার নেমে আসলো। মাথাটা যেন ঝিনঝিন করছে, টলমল করছে, মনে হচ্ছে যেন দুনিয়াটা ঘুরছে। চোখে সর্ষে ফুল ফুটছে।


টলমল করতে করতে সেসব স্থানে ঘুরলাম আর কাঁদলাম, যে সব স্থানে তোমার সাথে কথা হয়েছিলো, হয়েছিলো দেখা, হয়েছিলো মিষ্টি মধুর কত না আলাপ!


ঘরে ফিরে আসলে জনম দুখিনী মা খেতে বললো,
আমি বললাম আপনি খেয়ে নিন মা, আমি এখন  খাবো না। আমার পেটে ক্ষুধা নাই।


মা বললো, তুই না খেলে আমিও খাবো না।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে মায়ের সাথে খেতে বসলাম।
নীরবে কাঁদতে কাঁদতে একটু ক্ষিপ্ত হয়েই বললাম,  দেন দেন খাচ্ছি।


আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে।
চুপিচুপি মুছে ফেলছি মাকে বুঝতে দিচ্ছি না।
চোখের কোণে এত পানি জমছে যে, আমি প্লেটের খাবারও দেখতে পাচ্ছি না, সবই ঝাপসা লাগছে।
খেতে খেতে আমার বমি হতে শুরু করলো।
আমি বললাম,  মা আপনি খেয়ে নিন। আমি পরে খাবো, এখন ভালো লাগছে না।


ক'দিন আগে মামাদের বাড়ি থেকে একটা রেডিও নিয়ে এসেছিলাম।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আস্তে আস্তে কাঁদছি, এপাশ ওপাশ করছি, আর গান শুনছি,
"তুমি একাবার এসে দেখে যাও,
ভালোবাসারই মরণ"
আর অঝোরে নীরব কান্নায় ভিজছে সিথানের বালিশ।


মা বারান্দায় এশার নামাজ পড়ছে।
আমার যেন বুকটা চেপে ধরছে, ছটফট করছি বিছানায়। হঠাৎ জোরে একটা শব্দ হলো আমার হাত পা নাড়ার, আরও শব্দ হলো দীর্ঘ নিঃশ্বাসের।
মা বললো কী হয়েছে বাবা তোর ?
আমি বললাম, কিছু হয়নি মা, আপনি যান শুয়ে পড়ুন।


কিন্তু মায়ের মন মানে না।
মাও কান্নাকাটি শুরু করে দেয় আমার এ অবস্থা দেখে এবং আমার মুখ শুঁকে কি যেন একটা গন্ধ পায়। 
সবাইকে ডাক দেয় মা।
পাড়ার সবাই এসে বাড়ি ভরপুর।
একজন নারী প্রতিবেশী মাকে বললো,
বুবু!  তুমি আর দেরি করো না। ছেলেকে বাঁচাতে হলে এখনই মেডিকেল নিয়ে যাও
অবস্থা খুব ভালো না। আমি নিশ্চিত, সে গরল পান করেছে।


সে রাতে কোনো রিকসা, গাড়ি ঘোড়াও নাই। ঝড়বাদলের রাত, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।
ঘাটে কোনো নৌকাও নাই।  চারিদিক ছুটাছুটি করে মা একটা ছোট লঞ্চের ব্যবস্থা করলো। আমাকে খাটে করে নৌকা করে মেডিকেল নিয়ে গেলো।


সেখানে গিয়েও মা নামাজের বৈঠকে আঁচল বিছিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইলো।


হে আল্লাহ!  তুমি আমার সব কিছুর বিনিময়ে, আমার প্রাণের বিনিময়, আমার খোকার প্রাণ ভিক্ষা দাও, বিনিময়ে আমার জীবন নিয়ে নাও।
খোকা ছাড়া যে পৃথিবীতে আমার আর কেউ নাই।
আমার বাঁচার সাধ নাই, আমার খোকাকে চাই।
এভাবেই মা কান্নাভিজা কণ্ঠে সিজদাতে লুটিয়ে পড়লো মহান আল্লাহর দরবারে।


অবশেষে মায়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করলেন,
ফিরিয়ে দিলেন নতুন করে নতুন জীবন।


শেষ কথা জানো?
এতো কিছু হওয়ার পরেও জানো প্রিয়া?
তোমাকে, তোমাকে, তোমাকে আজও ভুলতে পারেনি আমার পাগল অবুঝ, বেকুব এ মন।


এখনো তোমাকে রাতে স্বপ্নে দেখে দু-চোখ বেয়ে জল চলে আসে, ঝরঝর করে ঝরে চোখের পানি।
ভিজে যায় সিথানের উপাধান।
মনের গহীনে নীরবে নিভৃতে চোখের নোনা জলের প্লাবনে জীবিত নামের মৃত অবয়ব ভাসে,
পাগল মনটা আজও তোমাকে পাগলের মতই ভালোবাসে।


তোমাকে অনেক কথায় বলবো বলবো ভাবি,
কিন্তু দেখার পর তোমার দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়লে সব কিছুই ভুলে যাই। আমি বোবা হয়ে যাই।
বিষণ্ণতার ছাপ নিরাশার ভালোবাসায়।


আজ সাহস করে কলম ধরলাম, তোমাকে বলার জন্য আমার জীবনের অপূর্ণতা,
যদি কখনো তোমার হাতে পড়ে এ গদ্য কবিতাখান,
ভালোবাসার অপরাধে  করে দিও ক্ষমা,
দিও ক্ষমা ও প্রিয়তমা!


ভালো থেকো, সুখে থেকো সর্বক্ষণই থাকি এ প্রার্থনায়, তোমাকে বলার মত আর কিছুই নাই।
স্বপ্নে আসো, স্বপ্নেই যাও।
স্বপ্নের মানুষ তো তুমি, স্বপ্নেই হারাও!


--------------------সমাপ্ত-------------------