بسم الله الرحمن الرحیم


                —আশরাফুল ইসলাম
বড়ফেছি, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট৷


স্বরবৃত্ত:—
এই বৃত্ত বা রীতির অন্যনাম হলো— লোকছন্দ, প্রাকৃত বাংলা ছন্দ, ছড়ার ছন্দ, দলবৃত্ত, বলবৃত্ত, বলপ্রধান, লৌকিক ছন্দ, চিত্রা ইত্যাদি৷


রবীন্দ্রনাথ বলেন— "স্বরবৃত্ত ছন্দ আউলের মুখে, বাউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে, মেয়েদের ছড়ায় বাংলাদেশের চিত্তটাকে একেবারে শ্যামল করে ছেয়ে রয়েছে৷"


সত্যেন্দ্রনাথ বলেন— "এ নিরক্ষরের ছন্দ৷ সংস্কৃতের উল্কিতে এর চেহারা বদলে যায় নি; সেই জন্যই ভাষার নিজেস্ব রূপটি এতে বজায় আছে৷"


কেউ কেউ এই রীতিকে  'মেয়েলি ছন্দ' বলে থাকেন৷


স্বরবৃত্ত হল যে রীতিতে যুগ্মধ্বনি(বদ্ধস্বর) সব সময় একমাত্রা গণানা করা হয় বা ধরা হয় এবং প্রত্যেক পর্বের আদিতে শ্বাসাঘাত পড়ে৷ সাধারণত এই রীতিতে পূর্ণপর্ব চারমাত্রায়৷ অপূর্ণ পর্ব তিন, দুই, এক মাত্রায়; চরণান্তে শেষ পর্ব অপূর্ণ হয়৷ তবে শেষ পর্ব অপূর্ণ হতেই হবে এমন নয়৷


স্বরবৃত্তের বৈশিষ্ট্য:—
ক) স্বরবৃত্তে যে-কোনো অক্ষর এক মাত্রা গণনা করা হয়(মুক্তাক্ষর, বদ্ধাক্ষর)৷


খ) প্রত্যেক পর্বের প্রথমেই স্বরাঘাত পড়ে৷


গ) এই রীতিতে প্রত্যেক পূর্ণপর্বে কমপক্ষে একটি করে যুগ্মধ্বনি(বদ্ধাক্ষর বা বদ্ধস্বর) থাকে৷


ঘ) কথ্য রীতির ক্রিয়াপদ ব্যবহার হয়৷


ঙ) লঘু চপল ভাব প্রকাশের উপযোগী৷


চ) এইটা দ্রুত লয়৷


উদাহরণ:—


বাংলা তোমার/৪ বেহাল দশা/৪
বিশ্বমাঝে/৪ আজ!১
কেমন করে/ রাখবে ঢেকে/৪
এমন বড়/৪ লাজ?১


বাংলা বলে/৪ শোন রে বোকা-/৪
ভণ্ডশিষ্যের/ গুরু,২
প্রতারকের/৪ হস্তে পড়ে/৪
ধ্বংস আমার/৪ শুরু!২


স্বাধীন হলাম/৪ নামে মাত্র/৪
পেলাম ধোঁকা/৪বাজ,১
তাদের বংশ/৪ তোর কাছে যে/৪
শিখলো কাব্যের/৪ কাজ৷১


বুঝলি না তুই/৪ পেয়েছিলেম/৪
আজব পশু/৪ যত,২
এদের দেখে/৪ মাপ রে বোকা/৪
আমার বুকের/৪ ক্ষত!২


পূর্ণপর্ব ৪ মাত্রা, অপূর্ণ পর্ব ১ ও ২ মাত্রা৷
প্রত্যেক পূর্ণপর্বেই বদ্ধাক্ষর(যুগ্মধ্বনি/বদ্ধস্বর) রয়েছে৷


স্বরবৃত্তে স্বরাঘাত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷


স্বরাঘাত বা শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর(Accent বা Stress):— কবিতা আবৃত্তি কালে পর্বের প্রথমে যে বিশেষ জোর বা ঝোঁক পড়ে তাকেই স্বরাঘাত বা শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর বলা হয়৷ কারও কারও মতে এটা "বল"৷
সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রস্বরের প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়৷ প্রত্যেক চরণের প্রত্যেক পর্বের শুরুতে প্রস্বর করা হয়৷ প্রস্বর —এর জন্য পর্বের শুরুতে বদ্ধস্বর ব্যবহার করা উত্তম৷


স্বরবৃত্তের মাত্রা নির্ণয়:—
আমার= আ১+মার১=২, আ— মুক্তাক্ষর তাই একমাত্রা, মার— বদ্ধাক্ষর তাই ১ মাত্রা৷


মুক্তাক্ষরকে মুক্তস্বর আর বদ্ধাক্ষরকে বদ্ধস্বরও বলা হয়৷ স্বরবৃত্তে বদ্ধস্বর ও মুক্তস্বর ব্যবহার করা ভালো৷ প্রবোধচন্দ্র সেন অক্ষর ব্যবহারের পক্ষে নন, তিনি দল ব্যবহারের পক্ষে৷ তাঁর মতে মুক্তদল, রুদ্ধদল৷


আমিন= আ১+মিন১,(আ— মুক্তস্বর, মিন— বদ্ধস্বর৷
ভর্তি= ভর১+তি১,(ভর— বদ্ধস্বর, তি— মুক্তস্বর)৷


এবার পর্বে আসি:—
পর্ব— প্রত্যেক লাইনে বা চরণে এক যতি থেকে অন্য যতি পর্যন্ত ব্যবধানকে পর্ব বলে


পর্বকে আমরা (/) চিহ্ন দিয়ে আলাদা করবো৷


বাংলা তোমার/ বেহাল দশা/
বিশ্বমাঝে/ আজ!
কেমন করে/ রাখবে ঢেকে/
এমন বড়/ লাজ?


এই স্তবকে প্রত্যেক পূর্ণপর্ব ৪মাত্রা করে, অপূর্ণপর্ব ১মাত্রা করে৷


স্বরবৃত্তে প্রত্যেক পূর্ণপর্বে একটি বদ্ধস্বর থাকতে হয় আর সেটা পর্বের প্রারম্ভে হলে খুব ভালো হয়৷ তবে রাখতেই হবে এমন নয়৷


স্বরবৃত্তের ব্যতিক্রম এবং বিশেষ নিয়মসমূহ—
১/ ৩ মাত্রার পূর্ণপর্ব৷
২/পাঁচ মাত্রার পূর্ণপর্ব৷
৩/ পরপর ৩ বন্ধস্বর ৪ মাত্রা ধরা৷
৪/ পরপর ২ বদ্ধস্বর ৩ মাত্রা ধরা৷
৫/ পরপর ৫ মুক্তস্বর ৪ মাত্রা ধরা৷
৬/ পরপর ৩ মুক্তস্বর ৪ মাত্রা ধরা৷
৭/ নিরুপায় হয়ে অথবা ব্যাপৃত বা সংকোচিত উচ্চারণে মাত্রা সমতা দেয়া৷


তবে এই নিয়মগুলো চর্চার উপর এবং দক্ষতার উপর নিতে হবে যেন তাল-লয় না-কাটে এবং মুখে না-আটকে৷


বিঃদ্রঃ— ব্যতিক্রম ও বিশেষ নিয়ম কেউ না মানলে সেটা তার ইচ্ছা৷ ব্যতিক্রম ও বিশেষ নিয়ম এড়িয়ে লেখাই ভালো৷ তবে বাংলা সাহিত্যে ছন্দশাস্ত্রে ব্যতিক্রম ও বিশেষ নিয়ম অবশ্যই রয়েছে৷