শহর একটা বড় ফ্ল্যাটে,মেসে থাকি।
পড়ার টেবিলে এখন আর অঙ্ক বইটা খুলে রাখিনা।
আমার কানে এখনো  কথাটা বারেবারে শুনি,"বাজান তুই অঙ্কডায় খালি কাঁচা,বিকালে না ঘুমায়া অঙ্কডা বেশি বেশি কর।"আমিও আগের দিনের অঙ্কের বাড়ির কাজের খাতা আর বই
টা খুলে ঘুমাইতাম।তুমি আমার এই চালাকিটা  ধরতে পারো নাই।
আমি এখন  আর ব্রিজঘাটে,রাস্তার মোড়ে চার দোকানো ভিসিআর দেখতে দাড়াই না।
খুব মনে পরে কথাটা,দেশ-গ্রামের চাচাদের শাসন ভরা কথা,"তোর আব্বার কাছে বিচার দিমু তুই ভিসিআর দেহছ।"


আব্বা,আমি এখনও রাত জাগি,কিন্তু রেডিওতে আর ছায়া ছবির গান শুনতে শুনতে উচ্চতর গণিত করিনা।পড়ার টেবিলে বসে আজো অপেক্ষা করি,
এই বুঝি করুন সুরে মারফতি গান গান গাইতে চার দোকানের আড্ডা শেষ করে বাড়ি ফিরছো।ডাক দিয়া কইবা,"বাজান-
ঘুমাইছো?নাকি অঙ্ক করোছ?


আমি এখনো ভুলতে পারিনা আব্বা,মধ্যরাতে আরেকবার  তোমার সাথে ভাত খাওয়ার কথা।মরিচের খন্দ আর ধানের খন্দ আসলে এখন আর কেউ বলেনা,"বাজান কি কি লাগবো তোর,অহনই ক।ট্যাহা ভাঙা অইয়া গেলে কিন্তু কইতারবিনা।"
আব্বা,কেউ আর আমারে দিস্তা দিস্তা খাতা,আর প্যাকেটভর্তি কলম কিনে দেয়না।
সাইকেল ঠিক করার জন্য এখন  আর তোমার  গোলার মরিচ চুরি করিনা।


বাজার থেকে ফিরে কেউ আমারে হালখাতার নিমকি জিলাপির প্যাকেট এনে দেয়না।
আব্বা,কেউ আর আমাদের আদরের ছোট বোনটারে সব্জিখেতের মইয়ে উঠায়না।
হোস্টেলের গেটে আমার জন্য খাবার নিয়া কেউ আর দাড়ায়া থাকেনা।আমি এখন একা একাই অন্য কলেজে পরীক্ষা দিতে যাই।
তখন তোমাকে মনে পড়ে ভীষণ।বৃত্তি পরীক্ষা,মেটিক পরীক্ষার সময় রিজার্ভ করা রিক্সা দিয়ে আমারে নিয়া যাইতা।হোস্টেলের বন্ধুরা এখন আর তোমার নাম নিয়া আমার সাথে দুষ্টামি করে বলেনা,"তোর আব্বায় আইছে।
আব্বা,কতদিন হয়,তোমার সোনালি রঙের ঘর্মাক্ত চেহারাটা দেখিনা।কতদিন হয় তোমার জামার ঘামের পিতৃ সুলভ ঘ্রাণটা পাইনা।
জ্বরে কাতরানো তোমার বিলাপের শব্দ ওই ঘর থেকে আর কানে আসেনা।
ক্যান্সারে কয়েকদিন ভুগে এভাবে হঠাৎ তুমি চলে গেলে বাবা?আমারে তো কেউ বলেনি,তোমার ক্যান্সার,মরণঘাতী ক্যান্সার,সন্তানকে পিতৃহীন করার ক্যান্সার,তুমি বাঁচবানা!
যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ফোন করে বাড়ি ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে এত আদর করলা,দোয়া করলা আমার জন্য।ক্যান বললেনা,এইটাই শেষ দেখা।ভোরের স্বপ্নে তোমার চলে যাওয়া দেখে ফোন দিলাম।
তুমি তখনও বলনি আব্বা,আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই তুমি চলে যাচ্ছো।
আমারে কইয়া যাইতে পারলানা?তোমার চলে যাওয়া আমি কেন দেখলাম না আব্বা?


এখন আমি প্রায়ই রাত জেগে তোমার কাছে চিঠি লিখি।কবিতায় তোমাকে ডেকে মনের স্বাদ মিটাই।
আমি ভালো নাই বাবা;মা এখন বড়ো অসহায়!
অবুঝ শিশুর মতো,সবকিছুই আমাদের মনমতোই করে;কোন স্বাদ আহ্লাদ নাই তার।বাবা,তুমি কেমন আছো ওইদেশে?আমার কথা কি মনে পড়ে?
আমার জন্য কি অপেক্ষা করো?
আমিও অপেক্ষায় আছি-
তোমার কাছে যাওয়ার।
ভালো নাই বাবা তোমায় ছাড়া।এ জগতের সবাই শুধু পরই না,আস্ত স্বার্থপর এক একটা।
মাথার উপর ছায়া না পাওয়া মরুর পথিকের যন্ত্রণা কেউ বোঝেনা,আব্বা।আমার আর এই তাপ সহ্য হয়না।আমার ছায়া দরকার,তোমার ছায়া,বিশাল বটগাছের ছায়া।