ক্রিং ক্রিং
মাস্টার সা'ব এসেছেন।
কার বয়স বেশি, সাইকেলের না মাস্টারের বুঝা যায় না।
অতি জীর্ণ সাইকেলের বেশ কিছু স্থানে দড়ি বাঁধা,
জীবনের মতোই বেঁধে ধরে চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা।
নিজের ঘরের টিন দিয়ে প্রাইমারী স্কুলটার ছাদ বেধেছিলেন একবার।
সেবারই তার পরিবার চিরতরে বাড়ি ছেড়েছিলো।
একা মাস্টার, টিউশনির বাড়িতে খাবারের বিনিময়েই শিক্ষা দিয়ে যান।


ক্রিং ক্রিং
বয়স আর সাধারণ থেকে একটু বেশি লম্বা হওয়া শরীরটা সোজা রাখা যায়না এখন।
প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা আছে কিনা কেউ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
তাও দুই দশক ধরে গ্রামের সব পরিবারের সকল সাধারণ চিকিৎসা তিনিই করেছেন।
একটি চামড়ার খুব পুড়ানো ব্যাগ যেখানে সিরিঞ্জ, সুই আর সাধারণ বড়ি আর কিছু বেন্ডেজ।
সাইকেল আর ব্যাগটার বয়স বোধহয় খুব কাছাকাছি।
একই দেহের অংশ মনে হয়।
এখনতো গ্রামেও এমবিবিএস ডাক্তার আছে।
তার ডাক পড়েনা তেমন।
চোখেও ভালো দেখেন না।
অনেক দিনের সঙ্গী সাইকেলটাই তাকে এখন পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।
পরিবারে কেউ বেঁচে নেই।
টাকার জন্য নিজের ছেলেটাও চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে।
শোনা যায় এরপর থেকেই নাকি তিনি সাইকেলের সাথেই কথা বলতেন।


ক্রিং ক্রিং
বাজারের ঠিক মাঝখানটায় পোস্ট অফিস।
অফিসটার সামনেই বাজারের একমাত্র টিউবওয়েল।
পোস্টমাস্টার আর রানার একজন-ই।
দেশি হলুদ খামে চিঠি এলে খুব একটা খুশি হন না মাস্টার সাহেব।
তবে বিদেশী টিকেট লাগানো সুগন্ধযুক্ত খাম এলে খুশি হন বেশ।
চিঠি পৌঁছে দিলে ভালোই বকশিস দেন সবাই।
হাসিখুশি মানুষটাকে সবাই পছন্দ করেন।
ইস্ত্রি করা খাকি জামা এবং পুরানো কিন্তু যত্নে রাখা সাইকেলটা দেখলেই বুঝা যায় জীবনে সুখেই আছেন।
অভাবেও সুখ খুজে পেয়েছেন তিনি।


ক্রিং ক্রিং
শীতের কনকনে ভোরে সময় ঠাহর করা বেশ কষ্টের।
কুয়াশার বন্যায় অন্ধকার আরো বেশি কালো।
ইমাম সাহেব বিশ্বাস করেন যা কিছুই হোক তার ঘুম ওয়াক্তের আগেই ভাংগবে।
প্রায় চল্লিশ বছরে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
নামাজ পড়ে তার জীবনের একমাত্র স্থাবর সম্পদ সাইকেলটি নিয়ে চলে যান কোরান শিক্ষা দিতে।
ইমাম সাহেবের ব্যক্তিগত বিশ্বাস আল্লাহর রাস্তায় নামলে পিছুটান রাখতে নেই,
এতে ঈমানে দূর্বলতা আসে।
তাইতো সম্পদ, সম্পর্ক কিছুতেই নিজেকে যুক্ত করেন নাই।
তিনবেলা রুটিন করা বাড়িতে যা দেয়া হয় তাই আল্লাহ্ র নেয়ামত মনে করে আলহামদুলিল্লাহ করেন।
পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ, সৃষ্টিকর্তা কারো প্রতি তার বিন্দু পরিমাণ ক্ষোভ, অভিযোগ নেই।
যদি আল্লাহ্, রাসূলের বাইরে কিছু ভালোবেসে থাকেন তা শুধু তার সাইকেল।
কথিত আছে, তার সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে দূর হয় খারাপ জ্বীন।


সময়, যুগ, বিবর্তন এর গল্পের সাথে সাইকেল খুব কাছ থেকে যুক্ত।
ঘড়ির কাটা আর ক্রিং ক্রিং।


#জামশেদ
#রোমেল
২৭ আশ্বিন, ১৪২৫ বাংলা।