দশ দিক থেকে আচমকা ধেয়ে আসছে চতুষ্কোণা কবরের অন্ধকার
একটি একটি করে দিন বাড়ছে; আর গাঢ় থেকে গাঢ়তর
অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে সবকিছু,
অথচ রোজই একটি করে বন্ধ্যা সূর্য উঠে, সে আলো দেয় না।
ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে বায়ান্নার আলোর মিছিল
ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে মহান একাত্তরের আলোর মিছিল, কেউ দেখে না।
কারো কিছু আসে যায় না।


অথচ একদিন সবাই মায়ের নামে শপথ নিয়েছিলো। ইস্পাত কঠিন শপথ।
হাতে হাত রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো শত্রুসেনার ছোঁড়া বুলেটের অগ্রভাগে;
সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জেগে উঠেছিলো,
কেউ এতোটুকু প্রাণের ভয় করেনি।
মায়ের ভালোবাসার ঋণ কিঞ্চিৎ পরিশোধের
উদগ্র বাসনায় সবাই উদগ্রীব ছিলো,
হাসতে হাসতে মান দিলো। তবু মাথা নোয়াল না।
নারীত্বের একমাত্র অহংকার ধুলোয় মিশে গেলো,
তবু এতোটুকু কাঁদলো না!


অথচ আজ ভাবতেই অবাক লাগে, যে ছেলেটির একাত্তরে জন্মই হয়নি;
সেও এখন মুক্তিযোদ্ধা!
যে রাজাকার বোনের ইজ্জত লুটে নিতে এতোটুকু কুণ্ঠিত হয়নি, সেও!
অথচ কতো শত মুক্তিযোদ্ধা অনাহারে-অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় জীবন দিলেন,
কেউ তাঁদের কোনো খোঁজ-খবর রাখেনি।
তাদের অপরাধ ছিলো, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধার একটি কাগুজে সনদের জন্যে যুদ্ধ করেননি;
তাঁরা দেশ-মাতৃকাকে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছেন।
তাঁরা স্বীকৃতির জন্যে যুদ্ধ করেনি; এ মাটির স্বাধিকারের জন্য যুদ্ধ করেছেন।


অথচ এখন সর্বত্র দুরবৃত্তায়ন! দুরবৃত্তায়নের বৃত্তে বন্দি মা-মাটি-দেশ। সবাই দেখছে।
তেতাল্লিশ বছর। কেউ কিছু বলেনি। মুখে কুলুপ আটা ছিলো। এখন মনেও আটা।
মমতাময়ী মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না।
সে মুখে ভয় আছে। আতংক আছে।
স্বাধিকার হারানোর ভয় নয়; অধিকার হারানোর ভয়।
বাঁচতে না পারার ভয় নয়; চোরাবালিতে আটকে থাকার ভয়।
সন্তান হারানোর ভয় নয়; জুলুম নির্যাতনের ভয়।
একাত্তরের পরাজিত শক্তির আবার জেগে ওঠার ভয়!


মাগো, তুমি আর কেঁদো না।
তোমার অগণিত সন্তান তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
তারা তোমার মুখে হাসি দেখতে চায়। ভয় দেখতে চায় না।
আতংক দেখতে চায় না।
তোমার সাড়ে সাত কোটি এখন সাড়ে ষোল কোটি হয়েছে মা। ভয় কী তোমার মা?
দেখো, ঠিক সময়ে সবাই আবার জেগে ওঠবে!
আবার ফিরে আসবে বায়ান্ন, আবার ফিরে আসবে একাত্তর!!
দেখো মা দেখো, তখন দুর্বৃত্তরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না!!