পর্ব : ১


বিবর্তন এবং ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে উতপ্ত গলিত অবস্থা থেকে আজকের এই বাসযোগ্য আদর্শ পৃথিবীর উত্তরণ ঘটেছে। সামগ্রিকভাবে জীবনের প্রয়োজনে এবং আরো ভালো থাকার মানসিকতায় মানুষ আদিম অবস্থা থেকে নগরসভ্যতায় প্রবেশ করেছে। নতুনকে জানার এবং গ্রহণ করার মানসিকতায় উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে আজ আমরা বিজ্ঞান এবং তথ্য-প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। এই উৎকর্ষতা রাতারাতি একক প্রচেষ্টায় আসেনি। এটা মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। অনেক বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে- কারো মেধা, কারো শ্রম এবং কারো অর্থায়নে আমরা আজকের বর্তমানকে পেয়েছি। দুর্বল মনের লোকমাত্রই পরিবর্তনে ভয় পায়। তারা জগতকে নিরেট সময়ে বাঁধতে চাই। কিন্তু মহাবিশ্ব নিয়ত সম্প্রসারণশীল। তাহলে এটা পরিষ্কার যে, জগতের নিয়মই পরিবর্তন।


আমাদের বাংলা ভাষাও ঠিক সেই পরিবর্তনের হাত ধরে আজকের আদর্শরূপ লাভ করেছে। যে ভাষা দেশ, কাল এবং পরিবেশভেদে পরিবর্তিত হয়- পরিবর্তিত হয় কণ্ঠের মাধ্যমে। হাজার বছরেরও বেশি সময়ের পথপরিক্রমায় বাংলা ভাষা সুললিত, সহজবোধ্য এবং প্রাঞ্জল হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- সংস্কৃত শব্দ ‌‌'চন্দ্র' থেকে প্রাকৃত রূপ 'চন্দ' এবং 'চন্দ' পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় 'চাঁদ' হয়েছে। সহজে উচ্চারণের সুবিধার্থে কঠিন শব্দ থেকে সহজতর শব্দের রূপ গঠিত হয়েছে। বর্তমান বাংলা ভাষার যুক্তাক্ষরগুলো ভেঙে সরলীকরণ করা হচ্ছে- একশ’ বা দুইশ’ বছর পর হয়তো বাংলা শব্দের ব্যবহার ও বানান আরো সহজতর হবে- আরো পরিবর্তিত হবে। পরিবর্তনশীল ভাষাকে আয়ত্ত করতে হলে শব্দ ও সঠিক বানান ব্যবহারে সচেষ্ট হতে হয়- চর্চা করতে হয়। এমনি এমনি তা আয়ত্তে আসে না।


অনেকের বলতে শুনেছি- ‘সারাজীবন যে বানান জেনে আসছি, লিখে আসছি- সে বানান আজ ভুল! একি মানা যায়!’ এক্ষেত্রে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, আদিযুগের (৯৫০-১২০০ সাল) নিদর্শন চর্যাপদ-এর ভাষা এমন দুর্বোধ্য; যা পড়াই দুরূহ, অর্থোদ্ধার আরো কঠিন। যে কারণে চর্যাপদ-এর ভাষাকে 'সন্ধ্যাভাষা বা আলো-আঁধারির ভাষা' বলা হয়েছে। পুরাতন আর আধোগঠিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে চর্যাপদ-এ। এই সব শব্দ হাজার বছর ধরে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরাতন রূপ থেকে পূর্ণাঙ্গ আদর্শ রূপ লাভ করেছে। যা বাংলা ভাষাকে করেছে সহজতর, প্রাঞ্জল।


বাংলা একাডেমি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলা ভাষার প্রচার, বানান এবং ব্যবহার নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করে থাকে। শব্দার্থের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত 'ব্যবহারিক বাংলা অভিধান' এবং সঠিক বানানের ক্ষেত্রে 'বাংলা বানান অভিধান' অনুসরণ করাই শ্রেয়। 'ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে' একটা শব্দ বিভিন্ন বানানে বিভিন্ন অর্থে অন্তর্ভুক্ত থাকে, কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন বানানটি ব্যবহার করবো তা কেবল 'বাংলা বানান অভিধান' অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য। বানান অভিধান দেখার ক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হয় তা হলো- সঠিক বানানটি থাকে প্রথমে এবং স্ল্যাশ(/) চিহ্নের পরে থাকে উচ্চারণ। সুতরাং প্রথম বানানটি ব্যবহার্য। যেমন- সঠিক বানান 'ব্যাপী' কিন্তু এর উচ্চারণ 'ব্যাপি' (বর্জনীয়)। ব্যাপী এর প্রয়োগ : মাসব্যাপী, দুনিয়াব্যাপী ইত্যাদি। সঠিক বানান ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইচ্ছেমতো শব্দের বানান ব্যবহার না করে বাংলা একাডেমির বাংলা বানান অভিধান অনুসরণ করাই যৌক্তিক।