আধুনিক কবিতা তার দুর্বোধ্যতার কারণে পাঠকের কাছে আতঙ্কের কারণ l কবিতার নানা বিষয় তাঁকে আহত করে l কিছু কবিতা পড়ে মনে হয়, কবিতা পড়ে পাঠক আনন্দ লাভ করুন, তার রসাস্বাদন করে এক নির্মল অনুভবে সিক্ত হোন, কবি যেন সেটা চান না l কবির অহং কবিতাকে তাঁর নিজের কাছেই বেঁধে রাখে, পাঠকের জগতে প্রবেশ করতে বাধা দেয় l কিন্তু এটি স্বাভাবিক নয় এবং অনাকাঙ্খিত l কবি কবিতা লিখবেন পাঠকের জন্য l পাঠক সেই কবিতা পড়ে তার রসাস্বাদন করবেন - এখানেই কবিতার সার্থকতা l কিন্তু আধুনিক কবিতা পাঠকদের তার সাথে নিয়ে চলতে পারছে না l পাঠকদের বাদ দিয়ে কবিকুল শুধু নিজের অহংকে নিয়ে চলছেন, সেকারণেই এমন বিকট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে l বর্তমানে কবিতা এবং পাঠক এই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির শিকার l "আধুনিক কবিতা" শিরোনামে কবি লিলি দাস এই বিষয়টি তুলে ধরবার প্রয়াস করেছেন l
কবিতা নানাভাবে পাঠকের থেকে তার দূরত্ব তৈরি করে l কখনো কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলী এর কারণ হয় l কঠিন কঠিন শব্দ প্রয়োগ করে কবিতাকে আড়ষ্ট করে তোলা হয় l তার স্বাভাবিক পাঠ ব্যাহত হয় l শব্দগুলি পড়ে মনে হয় যেন কঠিন কঠিন কিছু অসুখের নাম বলা হচ্ছে l প্রতীক উপমা পেরিয়ে কবিতাকে অনুভব করার প্রয়াস চলে l কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন কবিতায় ব্যবহৃত ভাষার পাঠোদ্ধারে পাঠক ব্যর্থ হন, তখন শোকাহত হন তিনি l প্রতীক যত বিমুর্তই হোক না কেন, প্রথম লাইন থেকে দ্বিতীয় লাইনে গমনের একটি যৌক্তিক সুত্র না পেয়ে তাঁর পাঠপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয় l যেন সূত্রহারা, যষ্টিহারা, অন্ধের মত হোঁচট খেয়ে চলে তাঁর কবিতাপাঠ l সুর, ছন্দ, ভাবহীন ভাষার স্রোত বিকট ভঙ্গিমায় ত্রাস সৃষ্টি করে যেন কবিতা ও পাঠকের সম্পর্ককে কালিমালিপ্ত করে l
কিন্তু এমন তো হবার কথা নয় ! কবিতা তো পাঠকের কাছে নিশ্চিতভাবে অনায়াসলব্ধ শব্দের আভরণে সজ্জিতা, নিরাবরণা হবে l এরকম আধুনিক কবিতাই হবে অতুলনীয়া l


আলোচ্য কবিতায় কবি আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতা ও দুর্গমতা বিষয়ে যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, তা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে l যুগ যুগ ধরে এই বিতর্ক চলেছে এবং এখনও চলছে l পাঠকের কবিতা বোঝার দায় কি কবিকে বহন করতে হবে ?  কবির মনে যে ভাব এল, মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজের মতো করে লেখেন তিনি l এটা তাঁর স্বাধীনতা। পাঠককে কাব্য-কবিতা পাঠ করে তাঁর নিজের মতো করে আনন্দ নিতে হবে l  
বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ l চর্যাপদকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা l তাতে দিনের আলোর সুস্পষ্টতা নেই, আছে গোধূলির মায়াবী আলোছায়া। তাই বলা যায় দুর্বোধ্যতায় বাংলা কবিতার জন্মসিদ্ধ অধিকার। কবি অজিত চক্রবর্তী বলছেন, "আমরা যাহা জানি, স্পষ্টই জানি, তাহার ভাষা গদ্য - কিন্তু আমরা যাহা জানি, অথচ সম্পূর্ণরূপে জানি না, যাহাকে অনুভূতির মধ্য দিয়া হাতড়াইয়া বলিতে হয়, তাহার ভাষা পদ্য।"
সাহিত্য পাঠকেরা যেমন কবিতায় দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করেন, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো” কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন “আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে”। উৎসর্গে পাঠকের প্রতি তাঁর অভিমান পরিষ্কার। কবির বক্তব্য - আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য নয়, তার প্রতি পাঠকের অনীহাই দুর্বোধ্য।
কবিতাচর্চার ক্ষেত্রে একের পর এক এসেছে নতুন যুগ l একই ভঙ্গিতে চর্বিতচরণ কবিদের পছন্দ নয় l তাই কবিরা সর্বদাই পুরনো প্রকাশভঙ্গীকে নস্যাৎ করে নতুন বাক্ শৈলী, নতুন পরিকাঠামোর সন্ধানে তৎপর । দুর্বোধ্যতার উৎস এখানেই l বারবার চলেছে নিয়ম ভাঙার এই খেলা আর নতুন নিয়ম গড়া l প্রতিটি নতুন ধারার প্রয়োগের সময় এসেছে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ l
আসলে চলচ্চিত্র বা চিত্রকলার যেমন নিজস্ব ভাষা থাকে, কবিতারও তাই । সেই ভাষার শৈলী গদ্য থেকে আলাদা। কবিতা কবির নিভৃত অনুভূতির ফসল। তাই তাতে শৃঙ্খলা কম, অস্থিরতা বেশি। তবু সব শিল্পের মত কবিতারও দায়বদ্ধতা আছে l এই দায়বদ্ধতা হল পাঠকের উপলব্ধির কাছে পৌঁছনোর l
ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। পাঠক  সেগুলিকে অতিক্রম করে কবিতার বোধ নেন l অপারগ হলে কবিতার ভাব স্পষ্ট হয় না l অন্যদিকে কবির দায়িত্ব সেই সঙ্কেতগুলি কবিতায় এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা যাতে সেগুলি পাঠককে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।
মিতকথন কবিতার বৈশিষ্ট্য l প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ পাঠককে ক্লান্ত করে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম শব্দ ব্যবহার কবিতাকে কখনও কখনও ধাঁধাঁ বা রিডল - এ পর্যবসিত করে। কবির মনে রাখা জরুরী যে তিনি কবিতা লিখতে বসেছেন , ধাঁধাঁ তৈরি করতে নয়।
পাঠকের দেখা সম্পূর্ণভাবেই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং মানসিকতা নির্ভর। আবার কবিতা বোঝার জন্য নির্লিপ্তিও জরুরী। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক দিয়েও যাচাই করে নেওয়া দরকার। বুদ্ধিবেত্তা ও আবেগের যথাযথ এবং তুল্যমূল্য সংমিশ্রণ কবিতার অন্তর্লীন বোধ এর সন্ধান দেয়।


কবিতা রচনার মধ্যে দিয়ে চিরাচরিত এই আলোচনাকে উসকে দেবার জন্য কবি লিলি দাস মহাশয়াকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই l