অসীম সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিটি মানুষের জন্ম । আজন্ম সেই সম্ভাবনাগুলিকে স্বপ্নে লালন করে সে । মনের অনুভবে, তার ক্যানভাসে সেই স্বপ্ন পুষে রাখে । সাধ্যমতো প্রয়াস করে সেই স্বপ্নগুলিকে সফল করার । কিন্তু সম্ভাবনা অসীম থাকলেও মানুষের সাধ্য সীমিত । পারিপার্শ্বিক সুযোগ সুবিধা তাও পরিমিত । আবার মানুষভেদে ভিন্ন রকম । সেই সুযোগ সুবিধাগুলিকে গ্রহণ করে নিজের জীবনের স্বপ্নগুলিকে সাকার করে তোলার ক্ষেত্রে সদর্থক প্রয়াস ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন রকম । মাঝে অদৃষ্ট, ভাগ্যের কিছু খেলা থাকে । একই সুযোগের পরিবেশ, একই প্রয়াস, তবু কারুর স্বপ্ন পূরণ হয় কারুর হয় না, কারুর পূরণ হয় আংশিক।
জীবনের এই সার সত্য বুঝে উঠতে মানুষের জীবনের অনেকটা পার হয়ে যায় । কি তার স্বপ্ন ছিলো, সেই স্বপ্নকে সাকার করে তোলার জন্য কতোটা সে প্রয়াস করেছে, কতটা সুযোগ সে পেয়েছে, কতোটা সে অর্জন করেছে, তার স্বপ্নের কতোটা ধোঁয়ার মতো উড়ে গেছে - একটা পর্বে এসে এই সব কিছুর হিসাব বুঝে নিয়ে মানুষ একটা বোঝাপড়ায় আসতে চায় । নিজের মনকে প্রবোধ অর্থাৎ সান্ত্বনা দিতে হয় তাকে । স্বপ্নের কতোটা অংশ অর্জন করার যোগ্য ছিলো, কতোটা মোহ ছিলো, জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে তাকে তা বুঝে নিতে হয় । তারপরেও থাকে শিশুপনা । সব বাস্তব বুঝে নিয়েও মনকে সান্ত্বনা দেবার প্রয়াস । তাকে সঙ্গ দিতে কিছু অবুঝ পদচারণা ।


"আবেশিত ক্যানভাস" রচনায় কবি আব্দুল আহাদ (কালজয়ী) মানুষের জীবনের এই নিত্য অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন । অন্য সকল স্বপ্নচারী মানুষের মতো কবি তাঁর মনের ক্যানভাসে কিছু স্বপ্ন এঁকেছিলেন । এই স্বপ্নের কতোটা বাস্তবে তিনি অর্জন করতে পারবেন, আর কতোটা নিতান্তই মোহ তা বুঝে উঠতে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে । যখন তাঁর মনে হয়েছে মনের মধ্যে পুষে রাখা কিছু স্বপ্ন নিতান্তই অধরা, অদৃশ্য, তখন জীবনের পথে ছুটতে ছুটতে কবি ক্লান্ত হন, হাঁপিয়ে ওঠেন । যেমন হাঁপিয়ে ওঠে তাঁর অতৃপ্ত স্বপ্নগুলো । তিনি লক্ষ্য করেন, অনেকটা বেশি প্রয়াস করেও তিনি কিছু স্বপ্নকে ধরতে পারেন না । তিনি বাস্তবের সম্মুখীন হন । স্বপ্নের জড়তা ভেঙে যায় । লক্ষ্য করেন তাঁর স্বপ্নগুলি ভেঙে গেছে । কিন্তু তবু কিছুকাল সেই ভাঙা স্বপ্নের ধোঁয়াটে বিদঘুটে ছাই রঙে কবির ভাবনাগুলি আটকে থাকে । অর্থাৎ সত্যের সম্মুখীন হয়েও কিছুকাল মোহাবিষ্ট হয়ে থাকেন কবি ।


তাঁর মনের ক্যানভাসে পুরোনো স্বপ্নগুলো তবু উঁকি মারতে থাকে । যেমন শিশুদের বায়না, পূরণ হবে না জেনেও তা আঁকড়ে থাকা । তিনি বুঝতে পারেন তাঁর সামর্থ্য । কতোটা তিনি পারেন, কতোটা পাবেন না  - এটা জেনেও অবোধ মনকে শাসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না । যেন ধূর্তের মতো জল মিশিয়ে তার সঙ্গ দিয়ে চলেন ।
একটা বাস্তবকে তিনি বুঝে যান । তবু সেই প্রকৃত অস্তিত্বের মাঝে আর এক অলীক অস্তিত্বকেও প্রশ্রয় দান করেন । এর পেছনে থাকে আকাঙ্খা, অনেকটা বড়ো হবার ইচ্ছা - "অস্তিত্বের সঙ্গোপনে অস্তিত্ব পালিত হয় মহৎ তপস্যায়।"


হৃৎপিণ্ডের বিম্বে অর্থাৎ হৃদয়ের অম্তঃস্থলে তার প্রতিবিম্ব রচিত হয় । বাইরের আচরণে, ভঙ্গিমায় তার সপ্রতিভ প্রকাশ ঘটে । কবি জ্ঞানত জানেন, এটা একটা ইলুসন, একটা বিভ্রম । কিন্তু মনের মধ্যে সেই বিভ্রমকে পুষে রেখেই কবি জীবনের পথে এগিয়ে চলেন । বিভ্রম জেনেও প্রতিনিয়ত মনের ক্যানভাসে তার অঙ্কন চলতে থাকে । একদিকে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া, তার অনুভব, অন্যদিকে নিত্য নতুন স্বপ্নের রচনা - এটাই মানবজীবনের সত্য । যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে চলেছে । সপ্রতিভ ভঙ্গিমায় সেই প্রদর্শিত পথে এগিয়ে চলেন কবি ।


সুন্দর রচনার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ! !