কবি স্বপ্নময় স্বপন-এর "আমি আমার কাব্য নই" কবিতাটি পাঠ করে বিগত ০৮/০৯/২০১৭ তারিখ আসরে প্রকাশিত আমার "কবি ও কবিতার আমি" প্রবন্ধটি পুনরায় পাঠ করলাম l কবি স্বপ্নময় স্বপন যেন তাঁর কবিতায় প্রবন্ধে বর্ণিত কথাগুলিকেই স্পষ্ট করেছেন l
কবি বলছেন,"আমার নিজস্ব স্বরে শুনি অন্য অচিন ভাষা"l
সত্যিই তাই l কবি তাঁর কবিতায় যখন উত্তম পুরুষে কথা বলেন, কবি কি নিজের কথা বলেন ?
সবসময় নয় l এজন্যই দেখি কবিতাভেদে কবির ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়ে যায় l কবিতার 'আমি' সর্বদা কবি স্বয়ং নন । কবি এক একটি কবিতায় এক একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন । যখন যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তার স্বর শোনা যায় কবির কণ্ঠে l নিজের ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করে সমষ্টিগত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন কবি ।
সমাজের দর্পণ হল সাহিত্য l সেই সমাজের প্রতিনিধি হয়ে কবি উত্তম পুরুষে কথা বলেন l সেখানে কবির নিজের কথাও থাকে, কিন্তু সর্বদা নয় l কবিতায় উত্তম পুরুষের ব্যবহারে কবি এইভাবে আত্ম থেকে নৈরাত্মতে ভ্রমণ করেন l
মহত্ত্বর মানবসত্তার সাথে সম্মিলনের স্বপ্নে  নিজেকে ভেঙে ব্যক্তি থেকে 'আমি' পর্যায়ে পৌঁছাতে হয় কবিকে l কবি স্পষ্ট উচ্চারণে চিরকালীন মানব-অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেন কবিতায়। মানুষের দারিদ্র্য, তাদের ঈশ্বরধারণা, প্রচলিত ধর্মের অনাচারের বিরুদ্ধে সমাজের ক্ষোভ কবিতায় আসে l
"আমি আমার কাব্য নই" কবিতায় কবি বলছেন কবিতার মূল বিষয় তিনি নন l তিনি একটি আধারকে কেন্দ্র করে সেখানে রসসঞ্চার করেন l যখন তাঁর মধ্যে কবিভাব আসে, তিনি স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, এবং এই জগতের সকল সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা তাঁর প্রতি প্রেমবশত তিনি সৃজনকর্মে মত্ত হয়ে ওঠেন l তাঁর সৃষ্টির আলোকে আধার আলোকিত হয়ে ওঠে l অনন্ত যুগ ধরে এভাবেই কবিতাচর্চা হয়ে চলেছে l সব লেখা অন্তর থেকে উৎসারিত l কখনো মনে হয় কবিতার বক্তব্য দুর্বোধ্য l পাঠক তা বুঝে উঠতে পারেন না l কিন্তু কবিতা দুর্বোধ্য হয় না l হতে পারে না l সেখানে মানবের বেদনার
কথা অন্তরের ভাষা দিয়ে লেখা হয় l বেদনার নীল রঙ থাকে সেখানে l অসহায় মানুষের স্বপ্নের গল্প থাকে কবিতায় l দূর স্বপ্নের নীল ছুঁয়ে নীলিমার চোখে চোখ রেখে শব্দ ওড়ে l এক একটি কবিতা যেন প্রেমের দৃষ্টিতে আঁকা এক একটি বালিকা l
কবি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন তিনি কবিতা লিখতে জানেন না l তিনি কবিতা লেখেন না l তাঁর কাব্যের বিষয় তিনি নন l এমনকি নিজেকে কবি বলতেও তাঁর আপত্তি l কিন্তু এমন হয়, তিনি কবিতা লিখে ফেলেন l এড়াতে পারেন না l সমাজে চতুর্দিকে স্বার্থের বিষ যখন চেতনাকে নীলাভ করে তোলে, সত্য কেঁপে ওঠে, বিরহ আঘাতে নীল বেদনা মানবতাকে গ্রাস করে, তখন নীলাভ কাব্য রচিত হয় l তিনি উপলক্ষ্য মাত্র l বেদনার রঙ নীল l আবার দূর নীলাকাশ, তার রঙ নীল l সেই অর্থে স্বপ্নের রঙ নীল l সেই  নীল চেতনায় কবির বোধ আচ্ছন্ন হয় l বিপ্লবী সত্তা জেগে ওঠে l প্রতিশোধের আগুন ঝরে পড়ে তাঁর রচনায় l
এই রচনার কৃতিত্ব তাঁর নয় l লেখা হয়ে যায় l
শুধু অপরের কষ্টের অনুভূতি থেকেই কবিতা আসে না l কবি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে যা দেখেন, সেই দেখায় কলম চুইয়ে কবিতা আসে না l কল্পনা জাগ্রত হয় না l দিগন্ত জুড়ে ব-দ্বীপে পাখিরা বাসা বাঁধে না l
কবির নিজস্ব ভাষা যেন কম পড়ে যায় l তখন কবি এক দৃষ্টি লাভ করেন l কবির আরাধ্য সৃজনশীলতার দেবী তাঁকে সেই দৃষ্টি দান করেন l সেই দৃষ্টির অধিকারী হয়ে কবি এক অচিন ভাষা শুনতে পান l সেই স্বরে তাঁর কবিতাগুলি রচিত হয় l
তাই বলা যায়, কবি যখন উত্তমপুরুষে কবিতা লেখেন, সেই এক 'আমি'র মধ্যে অনেক 'আমি' থাকে l তাই কবিতার  'আমি'কে সর্বদা কবি স্বয়ং মনে করলে ভুল হবার অবকাশ থেকে যায় l


কবিভাবনায় পূর্ণ এক অনুপম রচনার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা l