"আমি রবি ঠাকুর বলছি" কবিতাটির যে বিষয়টি প্রথম  আকৃষ্ট করল তা হল, কবিতাটির স্বচ্ছন্দ পাঠ l ভাষা এত ঝরঝরে, গ্রীষ্মের অপরান্হে ফুরফুরে শীতল হাওয়ায় নদীতীরে সবুজ মাঠে যেন বিচরণ করলাম l
কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে বর্তমান প্রজন্মে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বিচিত্র, সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম নিয়ে যে বহুগামী চর্চা চলছে তার সন্ধান এবং যে সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বর্তমান প্রজন্মের কবিতা, গান এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়েছেন, তার লেখাজোখা l রবীন্দ্র অনুরাগী ও রবীন্দ্র বিরাগীদের কর্মকাণ্ড l
বাঙালী সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্রনাথ সমার্থক l রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া বাঙ্গালী সংস্কৃতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না l
কিন্তু সময় এক জায়গায় থেমে নেই l সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্পকলা নতুনত্বের সন্ধানে লেগে রয়েছে l রবীন্দ্রনাথের নিজের যুগেই, যখন কবিগুরু   তাঁর প্রতিভা প্রকাশের মধ্য গগনে বিরাজ করছেন, তখনও রবীন্দ্র প্রতিভার জ্যোতি বলয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে l মূলত কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম এবং মোহিতলাল মজুমদার এর নেতৃত্বে রবীন্দ্র প্রভাবকে অস্বীকার করে এক স্বাধীন, স্বতন্ত্র কাব্য সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছিল l কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথমদিকে রবীন্দ্র অনুগামী হলেও পরবর্তীতে কবি হিসাব নিজ স্বতন্ত্র একটি পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছিলেন l যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত স্বতন্ত্র ছিলেন তাঁর দুঃখবাদে, নজরুল ইসলাম তাঁর প্রগলভ যৌবনের উদ্দামতায়, মোহিতলালের  মজুমদার দেহচর্যায় l সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সমসাময়িকতায়, ছন্দের কারুকাজে l
আবার এমনও বলা হয়, এই কবিরাও শেষ বিচারে রবীন্দ্র ভাবোত্তীর্ণ হয়ে ওঠেন নি। প্রকৃত আধুনিকতা এসেছিল বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেনের কাল থেকে।
মজার ব্যাপার হলো যাঁরা রবীন্দ্র অনুসারী ছিলেন না তাঁরা বাংলা কাব্য সাহিত্য জগতে স্বতন্ত্র পরিচয়ে উজ্জ্বল স্থান পেয়েছেন l কিন্তু যাঁরা রবীন্দ্র অনুসারী ছিলেন, তাঁরা বুঝতে পারেন নি যে রবীন্দ্রনাথের মায়াবী আসঙ্গ তাঁদের নিজেদের কবি প্রতিভার বিকাশ ও স্বীকৃতির পক্ষে সহায়ক ছিলো না l তাঁরা আত্মাহূতি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রবৃত্তে যাঁরা চিরকাল আবর্তিত হলেন - কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করূণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়  এঁরা রবীন্দ্রনাথের  সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে রেহাই পান নি।


এই পটভূমিতে কবি স্বপন কুমার মজুমদার রচিত "আমি রবি ঠাকুর বলছি" কবিতাটি আলোচনার অবকাশ আছে l কাল্পনিক এক দৃশ্যপট l রবীন্দ্রনাথের আত্মা পৃথিবী ভ্রমণে এসেছেন l তিনি দেখতে চান ভারতবর্ষে, তাঁর প্রিয় বাংলায় মানুষ এখনও তাঁকে মনে রেখেছে কি না l তিনি দেখতে চান, যে আদরিনী সোনার বাংলাকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তার বর্তমানে কি রূপ l এখানে এখন কোন্ কবি জনপ্রিয় l ভারতের মহামানবের সাগর তীরে কোন্ সুমধুর ঐকতান বেজে চলেছে l তিনি দেখতে চান তাঁর নিজের বহু সাধনার ফসল তাঁর কবিতাগুলির কি পরিণতি হয়েছে l মানুষের কাছে এখনও কি তাঁর কবিতাগুলির কোনো আবেদন আছে ? এখনো কি সেই কবিতাগুলি কৌতুহল নিয়ে কেউ পাঠ করে ?
১৩০২ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসে ইংরাজি 1895-96 সালে যখন রবীন্দ্রনাথের ৩৪-৩৫ বছর বয়স, তখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "১৪০০ সাল" কবিতাটি l


এই কবিতায় কবি মানসনেত্রে দেখছেন ১০০ বছর পরেও পাঠক কৌতুহল ভরে তাঁর কবিতা পাঠ করছেন l প্রকৃতপক্ষে এই দৃষ্টি কবির কামনাকেই তুলে ধরে l অমরত্বের সাধনা সকল শিল্পীর l সৃষ্টির মাধ্যমে ভক্তদের মধ্যে বেঁচে থাকার কামনা নিয়েই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কবির প্রার্থণা, ১০০ বছর পর এই বাংলায় যখন বসন্ত আসবে, বসন্তের গান গাওয়া হবে, সেদিন সেই গায়কের কণ্ঠে যেন তাঁর রচিত গান মন্দ্রিত হয় l ১০০ বছর পরের পাঠককুলের কাছে নিজের আশীর্বাদবচন প্রেরণ করে কবি তাঁর মনের অমরত্বের বাসনার কথা অকপটে প্রকাশ করেন l

১০০ বছর কাটে নি l ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে, ইংরাজি 1927-28 সালে অর্থাৎ কবিগুরুর কবিতাটি রচনার ঠিক ৩২ বছর পর, যখন কবির বয়স ৬৬-৬৭ বছর, তখন অনুজ কবি কাজী নজরুল ইসলাম আগামীর পাঠক ও কবি সমাজের প্রতিনিধি হয়ে কবিগুরুর কবিতাটির জবাবী কবিতাটি লেখেন l সেই কবিতাটির শিরোনাম ঐ একই -"১৪০০ সাল" l


নজরুলের রচনার প্রতি ছত্রে রয়েছে অগ্রজ কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, অন্তরের প্রেম ও ভালবাসা l রবীন্দ্রনাথ চির যৌবনের দূত রূপে কাব্য হয়ে, গান হয়ে স্বপ্নে দেখা দেন তার অনুরাগী পাঠকদের, নতুন প্রজন্মের কবিদের l
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি অমর l শতবর্ষ পরেও তরুণ কবিরা কবির মাধবীবাসর জাগে l রাতে সুগন্ধি ফুল ফোটে এবং কবির গান গাওয়া হয় l শতবর্ষ পরেও তরুণ কবিরা রবিকবির বন্দনা করে l স্বপ্নে রবি কবির গান ভেসে আসে l নতুন প্রজন্ম কবির বসন্ত বাসরে কবির বসন্ত গান গায় l অপূর্ব সঙ্গীতমূর্ছনা-ময় কবিতা l অনুজ কবির শ্রদ্ধা অগ্রজ কবিকে l


কবি স্বপন কুমার মজুমদার রচিত "আমি রবি ঠাকুর বলছি"  আলোচ্য কবিতাটি পড়ে যেন মনে হচ্ছে, কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় যে ভাবে কবিকে আশ্বস্ত করেছিলেন, আগামীতে এই ভারতে, এই বাংলায় সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, সংস্কৃতির সমস্ত শাখায়  তাঁর সর্বময় উপস্থিতির কথা, কবিগুরু বোধ হয় তাতে পুরোপুরি ভরসা পান নি l তাই কাজী নজরুলের ওই জবাবী কবিতাটি লেখার ঠিক (১৪২৪-১৩৩৪) = ৯০ বছর পর কবিগুরুর আত্মা সরজমিনে দেখতে এসেছেন, বাস্তবেই পরিস্থিতিটা নজরুল তাঁর কবিতায় যেরকমটা লিখেছেন, সেরকমই আছে কি না l
তিনি দেখতে চান বাস্তবেই কেউ কৌতুহল ভরে তাঁর বহু সাধনার ধন, তাঁর সাধের কবিতাগুলি এখনও পাঠ করে কি না l তিনি দেখলেন এখনো পুরনো দিনের কেউ কেউ তাঁর কোনো কোনো কবিতা পড়ছে l কিন্তু নতুন প্রজন্ম, আজকের শিশুরা আর "সহজ পাঠ" পড়ছে না l এখন সেই কুমোর পাড়াও নেই, আর সেই গরুর গাড়িও নেই l ঘরে ঘরে এখন সবার সঙ্গী চারচাকা কার, মোবাইল, ল্যাপটপ, আর কম্পিউটার। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে কবি লক্ষ্য করেন তাঁর শখের গানগুলি একালের নতুন গানগুলির পাশে যেন বড়ই বেমানান l তানপুরাটা আছে l তারগুলিতে ধুলি হয়তো জমেনি l কিন্ত তাঁর গানের কদর নেই l আরও লক্ষ্য করেন, তাঁর রচিত গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এখন কেউ পড়ে না l শুধু অচলায়তনের মতো কোনো কোনো বনেদী ঘরের আলমারির শোভা বাড়ায়।


কবির জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ এখনও ঘটা ক'রে পালিত হয় l "তাশের দেশ",  "চিত্রাঙ্গদা" বা শাপমোচন  মঞ্চস্থ হয় l কিন্তু কবি অনুভব করেন এর কৃতিত্ব তাঁর নয়, সব হচ্ছে তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির দৌলতে l
আর নৃত্যনাট্যগুলিতে কিছুটা নাচের লম্ফঝম্পের সুযোগ আছে তার জন্য l


এখন মানুষের কাছে  "কাল ছিল ডাল খালি /আজ ফুলে যায় ভ'রে" জাতীয় ছড়ার মর্যাদা নেই l এখন শৃঙ্খলা ব্যাপারটাই নেই l অকালে বসন্ত মানা হচ্ছে l  ফুল ফোটে নি, তবু নাকি আজ বসন্ত।
সভ্যতার সঙ্কট নিয়ে কবিগুরু কত সুন্দর রচনাগুলি লিখেছিলেন৷ l মানুষকে সতর্ক করেছিলেন l হিংসা পরিহার করার বাণী দিয়েছিলেন l কিন্তু সবই তার বিফলে গেছে l এখনও তিনি দেখছেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী l চারিদিকে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি l তিনি অনুমান করেন এ হলো অতিসভ্যতার সংকট l অথচ এই নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিকতায় হাঁপিয়ে উঠেই তিনি  লিখেছেন,
"দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর l"
অন্যত্র লিখেছেন,
"আমি     ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক,
আমি      চাই না হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক l
........
যদি       পরজন্মে পাই রে হতে ব্রজের রাখাল-বালক
তবে      নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে সুসভ্যতার আলোক l"


বিষন্ন হৃদয়ে কবি লক্ষ্য করেন, এখনো পৃথিবীতে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
পরলোকে ফিরে যেতে যেতে কবি তাই রেখে যান সেই পুরনো একই প্রশ্ন -
"তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
       তুমি কি বেসেছ ভালো?"


পুরো কবিতা জুড়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, আমরা মনেপ্রাণে রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারি নি l রবীন্দ্রনাথকে আমরা ব্যবহার করি বটে, যে কোনো আনুষ্ঠানিকতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি, তাঁর বাণী দিয়ে এলাকা ছেয়ে ফেলি, কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করি l কিন্তু যখন বিষয় আসে রবীন্দ্রনাথকে মেনে চলার, ব্যক্তিগত স্তরে, সামাজিক, বা জাতীয় স্তরে, তখন কবিগুরুর মহত্বের শিক্ষা, শান্তির ললিত বাণী আমরা বিস্মৃত হই l


কবি স্বপন কুমার মজুমদার মহাশয়কে একটি অতি সুন্দর কবিতার জন্য জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা l


প্রাসঙ্গিক :
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত "১৪০০ সাল" কবিতাটির লিঙ্ক :
http://www.bangla-kobita.com/rabindranath/1400-shal/


২) কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ১৪০০ সাল" কবিতাটির লিঙ্ক :
http://www.bangla-kobita.com/nazrulislam/1400shale/


৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম রচিত
"১৪০০ সাল" কবিতা দুটি ঘিরে আলোচনা ১০-০৪-২০১৭ তারিখ l তার লিঙ্ক :
http://www.bangla-kobita.com/jchowdhury298/year-one-thousand-four-hundred-from-rabindranath-to-kaji-najrul-islam/


৪) ০৯-০৫-২০১৭ তারিখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭ তম জন্মদিবসে "সকলের রবীন্দ্রনাথ" শিরোনামে প্রবন্ধ l তার লিঙ্ক :
http://www.bangla-kobita.com/jchowdhury298/rabindranath-for-all/


৫) কবি স্বপন কুমার মজুমদার রচিত "নববর্ষের কাব্য" কবিতার ওপর আলোচনা ১৯-০৪-২০১৭ তারিখ l তার লিঙ্ক :
http://www.bangla-kobita.com/jchowdhury298/series-eighteen-to-twenty-one/


৬) কবি স্বপন কুমার মজুমদার রচিত "বিধি যখন চোখ দিয়েছ" কবিতার ওপর আলোচনা ১৬-০৫-২০১৭ তারিখ l তার লিঙ্ক :
http://www.bangla-kobita.com/jchowdhury298/bidhi-jokhon-chokh-diyecho-forty-nine/