কবি তানভীর কালাম আজীমি ৪ বছর ৪ মাস হলো আসরে আছেন l আজকের তারিখে ৫৪৭-টি কবিতা যোগ করেছেন l দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর l বিগত কয়েকদিনে প্রকাশিত তাঁর কিছু কবিতা পাঠ করলাম l এর মধ্যে দুটি কবিতা - "অর্ধ রজনীর অতিথি" ও "আমার প্রেয়সী কবিতা" দুটির মধ্যে  একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হলো l


"অর্ধ রজনীর অতিথি" কবিতাটিতে কবি নিঃসঙ্গ l সঙ্গপ্রার্থী l ধৈর্যের সীমা শেষ l এমন সময় একদিন ঠিক মাঝরাতে তাঁর ঘরে এক ষোড়শীর আগমন l কবির নিদ্রাভঙ্গ হয় l পবিত্র স্নিগ্ধ বসনে তাঁর স্বপ্নের সুন্দরী অলস পায়ে আঁধারের বুক চিরে এক পা দু পা করে এগিয়ে আসেন কবির দিকে l তার হাতের আড়ালে ম্রিয়মান দীপশিখা l
অপরূপা ষোড়শী যেন জ্যোৎস্নায় স্নান করে ভেজা শরীরেই ঘরে প্রবেশ করেছেন l তার গভীর দৃষ্টিতে   মিষ্টি হাসি l পরণে নীলশাড়ি, কপালে তারার টিপ্, চোখে কাজল, চোখ দুটি যেন ক্লান্ত, তাই নীরব দৃষ্টি l তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে সুবাস ছড়ায় l রূপের গৌরবে আশপাশের সবকিছুকেই সুন্দর লাগে l
কিন্তু হঠাৎ যেন মনে হয় এই রূপসী ষোড়শী কোনো রক্তমাংশের মানবী নয় l যেন এক অশরীরী অস্তিত্ব l বিস্ময়ে কবির চোখের পাতা পড়ে না l এক শিহরণ জাগে শরীরে l পৃথিবীর গতি মুহূর্তের জন্য যেন থেমে যায় l তাঁর বাড়ির যে সীমানা, সেখানে যে মূল দরজা, সেখানে নিবদ্ধ কবির দৃষ্টি l  হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অলৌকিক কারণে নিঃশব্দ l
কবির সঙ্গীহীন জীবনের মাঝপর্বে সঙ্গীতের সৌরভ নিয়ে এক অপরূপা ষোড়শীর আগমন যেন অমানিশার অবসানে পূর্ণিমার আভা নিয়ে এসেছিল l কিন্তু সে স্বপ্ন ভঙ্গ হয় l আলো দানকারী প্রদীপ গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে l কবির শূন্য নিঃসঙ্গ জীবনের অবসান হয় না l অপলক দৃষ্টিতে তিনি ক্ষণিকের অতিথি সেই অপরূপা ষোড়শীকে অস্ফুট প্রশ্ন করেন l কে সেই রমণী যে মাঝরাতে এরকম অবেলায় শুধু ক্ষণিকের অতিথি হয়ে তার নিরানন্দ শূন্য ঘরে এসে আবার চলে যায় ?
কবিতাটি এক অস্পষ্টতা, এক রহস্যে শেষ হয় l কে সেই ষোড়শী ? কবি তাকে কামনা করেন l জীবনের অবেলায় সে আসে l কবি তাকে দেখেন l কবি খুশি হন তাঁর স্বপ্নসুন্দরীকে দেখে l কবির স্বপ্ন প্রায় সাকার হবার মুখে l হঠাৎ ছন্দপতন হয় l ষোড়শী অশরীরী প্রমাণ হন l কবির আঁধার জীবনে আলোর পরশ নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেই স্বপ্নসুন্দরী নিজেই আঁধারে মিলিয়ে যান l তার পরিচয়টাও স্পষ্ট হয় না l


এই রহস্যের উন্মোচন হয় কবির অন্য একটি কবিতা "আমার প্রেয়সী কবিতা" রচনাটিতে l এখানে স্পষ্ট হয় কবির প্রেয়সী রক্তমাংসের কোনো নারী নয়, বাগ্দেবী কবিতা-ই হলো তাঁর প্রেয়সী l অবশ্যই অশরীরী l
কবি বলছেন তাঁর প্রেয়সী কবিতার সঙ্গে তাঁর ভালো বোঝাপড়া হয়ে গেছে l তিনি ও তাঁর কবিতা এখন খুব গল্প করেন l অর্থাৎ খুব সহজেই তিনি এখন কবিতাচর্চা করতে পারেন l কবিতা সহজেই তাঁকে ধরা দেয় l অতীত, ভবিষ্যতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ সহকারে কবিতায় কথা বলে ওঠে l গভীর অরণ্যে ছায়াবীথি তলে, কখনো দুধেল ভোরে শিশির ভেজা প্রান্তে, কলমীলতার ঝিলে, পদ্ম পুকুর ঘাটে, ডাহুক ডাকা বিকেলে কিংবা নীরব কাশফুল বনে কবির প্রেয়সী কবিতা রচিত হয় l
কবির প্রেয়সী প্রকৃতির নানা রূপ, ঢং ও প্রকাশে কবিকে কবিতা রচনায় প্রাণিত করেন l কখনো সন্ধ্যাবেলায় ঘোমটা তুলে করবীর সুবাসিত আঁচল উড়িয়ে কবিকে ব্যাকুল করেন l কখনো রাত্রির আগমনে জোনাকি হয়ে কবিকে অজস্র বছরের মুছে যাওয়া বিরহের কাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেন l
কখনো কবিকে অবাক করে দেন দুঃখ বেদনায় পূর্ণ এই পৃথিবীতে স্বস্তির গন্তব্যের সন্ধান দিয়ে l সে গন্তব্য হলো নিষিদ্ধ রাতের মৌনতা l কবি সেই মৌনতার আহ্বান অনুভব করেন l


কখনো কোকিল ডাকা ক্লান্ত দুপুরে, নীরব স্নিগ্ধ বাতাসে ষোড়শী কবিতার অনুভবে কবির দেহে এক শিহরণ খেলে যায় l কবি নিবিষ্টচিত্তে কবিতা রচনায় মগ্ন হন l কবিতার শরীরের একটি একটি করে ভাঁজ খুলে যায় l প্রেমভাবনাপূর্ণ ভাঁজের প্রতিটি অংশে সহস্র যুগের স্মৃতি আল্পনা আকারে কবিতা হয়ে পাতায় পাতায় ঝরে পড়ে l


কবির সঙ্গহীন জীবনে কবিতার সঙ্গ কবিকে সপ্রতিভ করে l তাঁর সৃজনশীলতা উৎসাহিত হয় l কবিতা রচনার পাশাপাশি সাহিত্যের অন্য শাখা, গল্প রচনাতেও মনোনিবেশ করেন তিনি l কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সফলতা কবিকে আত্মবিশ্বাসী করে l সেই বিশ্বাসে সাহিত্যরচনার অন্য ক্ষেত্রেও তিনি পদচারণা করার প্রয়াস করেন l অপরের মধ্যেও সেই বিশ্বাস সঞ্চারিত করেন l


মনে হয়েছে "আমার প্রেয়সী কবিতা" ও "অর্ধ রজনীর অতিথি" কবিতা দুটি একে অপরের পরিপূরক l


কবিকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা !!