মানুষের পরিচয় সম্পর্ক-নির্ভর l পরিবারের কাছে সে আত্মীয়তা ও ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ l সে কারো পুত্র, তো কারো পিতা l কারো স্বামী l এরকম নানা সম্পর্কে পুরুষ ও নারী পরিবারে পরস্পরের আশ্রয়স্থল l কিন্তু প্রশাসনের কাছে মানুষ শুধুই একটি সংখ্যা l নবজাতকের আবির্ভাবে একটি পরিবারে যখন আনন্দ খুশির জোয়ার বয়ে যায়, প্রশাসনের খাতায় তখন মানুষের জনগণনায় শুধু একটি সংখ্যা বাড়ে l ঠিক তেমনই, একটি পরিবারের মূল আশ্রয়স্থল, রোজগেরে ব্যক্তি যার আয়ের ওপর, যার উপস্থিতির উপর গোটা পরিবারের অস্তিত্ব নির্ভরশীল, এরকম ব্যক্তির মৃত্যু হলে যখন একটি গোটা পরিবার ধ্বংসের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছয়, মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, তখন প্রশাসন বিষয়টিকে খুব সাধারন যোগ বিয়োগের অঙ্ক হিসাবেই দেখে l
সরকার প্রশাসনের এই পেশাদারী মনোভাব মানুষের জীবনের প্রকৃত মূল্যায়ন নয় l একটি জীবন, যা অনেকগুলি জীবনের বেঁচে থাকার প্রেরণা, যে জীবন তার কর্ম দিয়ে তার ওপর নির্ভরশীল একটি পরিবারকে এগিয়ে চলার পথ দেখায়, তাদের প্রতিটি প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর সাথে সাথে তাদের স্বপ্ন পূরণে সহযোগ দেয়, এরকম একটি জীবনের অবসানে সমাজ, সরকার, প্রশাসন এমন আবেগবর্জিত পেশাদারী অবস্থান নিতে পারে না l এখানে "একটি শ্রমিকের মৃত্যু"তেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না l বরং তার ওপর নির্ভরশীল অনেকগুলি জীবনের, তাদের বেঁচে থাকা, এগিয়ে চলা, স্বপ্ন পূরণ - সব অনিশ্চিত হয়ে যায় l একটি জীবনের অবসানের সাথে অনেকগুলি জীবনের অবসানের পূর্বাভাস থাকে l জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই অমানবিক পরিস্থিতি অনুমোদন পায় না l
দারিদ্র্যের কারনে, স্থানভেদে অসম উন্নয়নের কারনে, বহু মানুষ স্থানীয়ভাবে অর্থকরী কাজে নিয়োজিত হতে পারে না l জীবনধারণের জন্য অর্থের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে তাই তাকে যেতে হয় দূর দূর দেশে l পরিবার একজন অভিভাবকের দৈনন্দিন পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হয় l বুকে পাথর রেখে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সাধনা চলে l পরিবারকে একটু বেশী স্বাচ্ছন্দ্য দেবার উদ্যেশ্যে পরিবারের রোজগেরে মানুষটি উদয়াস্ত পরিশ্রম করে l সেই মানুষটি, এক অর্থে, তার ব্যক্তিগত স্তরে, যা সমাজের কাজ, রাষ্ট্রের কাজ, তা করে যায় l নাগরিকদের প্রতিপালন করা, প্রতি হাতে কাজ, প্রতি মুখে খাবার, প্রতি দেহে বস্ত্র, এর সঙ্গে শিক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা - এ তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব l ব্যক্তিগত স্তরে সেই মানুষটি এই দায়িত্ব পালন করছিল l তাই এরকম একজন মানুষের জীবনাবসানে রাষ্ট্র শুধু জনগণনায় একজন মানুষের সংখ্যা কমিয়ে নিলেই তার দায়িত্ব, কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না l তাকে হতে হয় সেই মানুষটির বিকল্প l সেই পরিবারটির সাহারা l
বর্তমান সময়ের অমানবিক, পেশাদার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এক অতি প্রয়োজনীয় মানবিক বার্তা দিয়েছেন কবি এই সুন্দর কবিতাটিতে l
"আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু" কবিতাটির রচয়িতা কবি এম ওয়াসিক আলি মহাশয়কে অশেষ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন l