ব্যক্তিত্ব দুধরনের বলে জানি l অন্তর্মুখী (introvert) এবং বহির্মুখী (extrovert) l অন্তর্মুখী যাঁরা, তাঁরা অপরের সঙ্গে বিশেষ মেশেন না l নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকেন l লাজুক প্রকৃতির হন l কম কথা বলেন l এরা আড্ডাবাজ হন না l তবে এরা খুব চিন্তাশীল হন l গভীর মননশক্তি থাকে তাঁদের l ধৈর্যশীল l আবার নার্ভাস প্রকৃতির l জনসংযোগ কম বলে আত্মবিশ্বাস কম l  এগুলি সাধারণ গুণ l পরিবেশ, পরিস্থিতি হিসাবে অন্তর্লীন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে এই গুনগুলির কমবেশি হতে পারে l আর যাঁরা বহির্মুখী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তাঁদের ক্ষেত্রে হয় ঠিক উল্টোটা l এটাও সাধারণ বৈশিষ্ট্য l ক্ষেত্র বিশেষে এর কিছু ব্যতিক্রমও হতে পারে l
আবার ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয় l বিশেষ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্মুখী ব্যক্তি বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে গেলেন, বা ঠিক বিপরীতটা - এমনটা হতেই পারে l


"ইদানিং আমি বদলে গেছি" কবিতায় কবি সরদার আরিফ উদ্দিন আমাদের এরকম এক ব্যক্তিত্ব বদলের গল্প শুনিয়েছেন l কোন্ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ব্যক্তিত্বে এই পরিবর্তন এসেছে, কবিতায় যদিও তার কোনো উল্লেখ নাই l কবি বর্তমানে অন্তর্লীন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন l ধরে নেয়া যেতেই পারে, পূর্বে তিনি বহির্মুখী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন l কোনো বিশেষ কারণে এখন পাল্টে গিয়ে অন্তর্মুখী হয়েছেন l
আম মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবি বাঙালির যেমন ব্যক্তিত্ব থাকে, কবিতায় বর্ণিত চরিত্রটি যেন সেই ধরনের l বিবাহিত, কাঁধে সংসারের বোঝা, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার দায় ও তজ্জনিত দুশ্চিন্তা l এইসব নানা কারণে লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে, কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি খুবই হিসাবি l পাছে কোনো বেফাঁস কথা বলে ফেলেন, কারো সঙ্গে অনর্থক তর্কে জড়িয়ে যান, এজন্য অফিসে, পথেঘাটে, আত্মীয়দের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তিনি সদা সতর্ক থাকেন l নিজের মধ্যে ডুবে থাকেন l শব্দ নিয়ে একা একা খেলা করে সময় অতিবাহিত করেন l শব্দ নিয়ে খেলা বলতে পত্রিকার কাগজে শব্দজব্দ সমাধান করা, নাকি কবিতাচর্চা করা - দুটোই হতে পারে l কথা খুব কম বলেন, যেহেতু তিনি এটা মেনে চলেন যে কথা মানুষের শত্রু l এরকমটা হতে তিনি বহু দেখেছেন l আবার কথা মানুষের মিত্রও হতে পারে l কিন্তু তেমন কথা বলার পটুতা তাঁর আছে বলে তাঁর বিশ্বাস নেই l তাই ইদানিং তিনি খুব কম কথা বলেন l
ব্যক্তিত্বের এই পরিবর্তনের প্রভাব তাঁর কাজের অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও পড়েছে l ইদানিং তিনি সবার আগে অফিসে যান, ফেরেনও সবার আগে l আসা যাওয়ার পথে মানুষের জট আর যানজট এড়িয়ে চলেন l অর্থাৎ পথে কারো সঙ্গে, পরিচিত বা অপরিচিত, অনর্থক গল্প করে সময় নষ্ট করেন না l রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে গল্প করা, সেটাও করেন না l এর ফলে তাঁর নাকি অসামাজিকতা প্রকাশ পায় l তাই হোক l তিনি গা করেন না l সমাজের নিষ্ঠুরতা, সমাজের স্বার্থপরতা হয়তো তাঁকে আহত করে l তিনি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান l  
অফিসে কাউকে তোষামোদ আর চামচাগিরি করাটাও তাঁর না-পসন্দ l এরকম করে তিনি নাকি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ হারাচ্ছেন l তাতেও তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই l তিনি এরকমভাবে থাকাকেই বেছে নিয়েছেন l
ইদানিং অফিসে তিনি কাজ একটু বেশীই করেন l অর্থের লোভ নেই, তারপরও খেটে মরেন l তাঁর মনে হয় কাজের মধ্যে থাকলে তিনি একটু স্বস্তি পান l যদিও এজন্য অফিসে বা অন্যত্র তিনি হাসির পাত্র l সেটা তিনি বুঝতে পারেন l  
ইদানীং একটা বিষয় হয়েছে কবি প্রায়ই হতাশায় ভোগেন l তাঁর মনে হয় চারপাশের মানুষজন যেন কেউ তাঁর আপন নন l অনেক দূরের l বিপদে আপদে তাঁদের পাশে পাওয়া যাবে না l এর থেকে হতাশা জন্ম নেয় l বরং তাঁদের দিক থেকে কোনো ক্ষতিরই আশঙ্কা করেন তিনি l তাঁর সকাল শুরু হয়  পত্রিকায় অত্যাচারের ছবি দেখে l ফলে নিজেও আক্রান্ত, অত্যাচারিত হতে পারেন, সারাটা দিন এই ভয়ে, আতঙ্কে, কষ্টে থাকেন l বুঝতে পারেন, এর থেকে মুক্তির যেন কোনো পথ নেই l
ইদানিং আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদেরকেও এড়িয়ে চলেন তিনি l তাঁরা বলাবলি করে, কবি নাকি খামখেয়ালি l আবার কেউ বলেন, কবি নাকি অতি সাবধানী l কিন্তু কবির কিছু করার থাকে না l হতে পারে অতি সাবধানতা থেকেই নিজের কাজে ফাঁকি দেওয়ার ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না l
ইদানিং আগের মত আড্ডাতেও আর যান না কবি l আড্ডায় আলোচ্য বিষয় তাঁর পছন্দ নয় l শুধু কে কাকে ল্যাং মেরে এগিয়ে যাবে বা গেল তার আলোচনা l শুধু পরনিন্দা আর পরচর্চা ! এইজাতীয় আলোচনায় একেবারেই মজা পান না তিনি l
তাঁর মনে হয় আগে পৃথিবীটা এরকম ছিল না l সব যেন হঠাৎ কেমন পাল্টে গেছে l তিনি এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না l অন্য সবাই তো ঠিক মানিয়ে নিয়েছে l এসব নিয়েই তারা তো দিব্যি আছে ! কিন্তু তিনি নিজে বর্তমান যুগের সাপেক্ষে বেমানান হয়ে গেছেন l
একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, কবির সব কবিতাতেই, কবি যখন কবিতা যোগ করছেন, বাংলা এবং ইংরাজি ভাষায় কবিতার নাম লিখে একটা ফর্ম মতো পূরণ করতে হয় l এটা করলেই ঘন মোটা লাল রঙে কবিতাটির নাম এবং একটু সরু লাল রঙে কবির নাম by default চলে আসে l এর পরে শুধু কবিতাটি থাকলেই হয় l পুনরায় কবিতার নাম, কবির নাম দেবার কোনো প্রয়োজন হয় না l এটাই দেখতে ভালো লাগে l কিন্তু কবিকে দেখলাম এর পরেও কবিতার শুরুতে কবিতার নাম, কবির নাম লিখছেন l ফলে কবিতাটি পাঠের আগে দুবার কবিতার নাম ও কবির নাম দেখাচ্ছে l


** কবিতার প্রথম স্তবকের চতুর্থ পঙক্তিতে "অনেক তো দেখালাম চালচিত্র" - এখানে "অনেক তো দেখলাম চালচিত্র" হবে মনে হয় l


ব্যক্তিত্ব বদল বিষয়ক মানবচরিত্র বর্ণনাধর্মী কবিতার জন্য কবিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই !!!