বর্ষামুখর গভীর রাতে বাকি পৃথিবী যখন গভীর ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কবি একা বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন l এই একাকীত্ব, এই নির্জনতা কবির সৃজনকাজের উপযুক্ত পরিমন্ডল গড়ে দেয় l দুয়ার এঁটে যখন পাড়া ঘুমায়, কবি তখন অবনী অর্থাৎ কবিতার খোঁজে কল্পনা ও  ভাবনার দুয়ারে কড়া নাড়েন l এর সঙ্গে প্রকৃতি তার বিচিত্র রূপ, নানা কর্মকান্ড সহকারে কবির সৃজন ক্রিয়ায় অনুঘটকের কাজ করে l
নির্জনতার সঙ্গে কবিতাভাবনা ও কবিতাসৃজনের গভীর সম্পর্ক l যখন আমরা বহু মানুষের সঙ্গে থাকি, কাজেকর্মে, হৈ হুল্লোড়, আনন্দ-বিষাদে - তখন আমাদের চেতন মনটাই শুধু সক্রিয় থাকে এবং কালের নিরিখে আমরা বর্তমানে বিচরণ করি l কিন্তু যখন আমরা একা হই, নির্জনতা ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে, তখন আমাদের সচেতন মনের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতন মনও সক্রিয় হয়ে পড়ে l স্মরণশক্তি ও কল্পনাশক্তি পাখা মেলে l কালের নিরিখে মনের সরণী ধরে অতীত, বর্তমান - এর মধ্যে পারস্পরিক যাওয়া আসা চলে l মনের ভাবনায় "Forward and Backward Movement of Action" হয় l
অতীত, বর্তমান - এর কোন্ ঘটনা কি রূপে মনকে বিচলিত করে তুলবে তার নিয়ন্ত্রক হল প্রকৃতি l প্রকৃতি যেমন আবহ রচনা করে, কবিমন তার অনুসারী হয় l সোনালী চাঁদনী রাতে কবিমন সুন্দর রোমান্টিক ভাবনায় খেলে যায় l বজ্র-বিদ্যুৎ মনকে অতীত ভাবনায় বিচলিত, শিহরিত করে তোলে l
আলোচ্য কবিতায় দেখি বর্ষার আবহ l মেঘের গর্জন l অঝোর বৃষ্টিপাত l মেঘ জমে জমে যেমন বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ছে, কবির মনেও জমে ছিল অতীত দিনের অনেক ঘটনার স্মৃতি l এখন প্রকৃতির নির্দেশনায় সেই ঘটনাগুলি রাশি রাশি ভাবনা আকারে ঝরে পড়ছে l  


রাত্রি গভীর l জগতের দিবসকালীন কাজের অবসান হয়েছে l ক্লান্ত মানুষজন বিশ্রামের প্রত্যাশী l এর মধ্যে শুরু হয়েছে অঝোর বৃষ্টিপাত l মেঘের গর্জন l প্রতিবেশী সকলে দরজা এঁটে দিয়ে সুখনিদ্রার আয়োজনে ব্যস্ত l শুধু কবির চোখে ঘুম নেই l ঘুম থাকে না l
"অলৌকিক আনন্দের ভার
বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার,
তার নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান
ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে আহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ।"
(ভাষা ও ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


প্রকৃতি যেখানে উজাড় করে দিয়েছে তার ভাণ্ডার, তার অঝোর বৃষ্টিপাত, তার মেঘ-গর্জন, কবির মনের গভীর গহন থেকে উঠে আসে নানা ভাবনা, অতীত দিনের স্মৃতি ঝরঝর করে ঝরে পড়ে l বর্ষামুখর রাতে জানালার পাশে একাকী বসে কবি বাইরের দিকে চেয়ে থাকেন এবং স্মৃতির সরণী বেয়ে অতীত দিনের বহু কথা তাঁর মনে ভীড় করে l
মনকে বর্তমান থেকে যত সরানো যায়, ততই সেই শূন্যস্থানের দখল নেয় অতীত l জোর বৃষ্টিতে দূরের গাছটা যেই ঝাপসা হলো, ফিকে হয়ে আসা কোন্ সুদূর অতীতের স্মৃতি কবির মনের পুরো দখল নিয়ে তাকে বিচলিত করে তুলল l কোনো বিশেষ একজনকে কিছু বলার ছিল l সেটা বলা হয়নি l সঙ্কোচ, জড়তা, ভয় হয়তো বাধা হয়েছে l তাকে কিছু দেবার ছিল l দেয়া আর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি l দীর্ঘসূত্রতা বা অন্য কোনো কারণে l যা করণীয় ছিল, সময়মতো তা করা হয় নি l ফলে যার সঙ্গে এক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত, জীবনে যাকে চিরসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার বাসনা ছিল, কালের গহ্বরে সে যে আজ কোথায়, তাও অজানা l ব্যস্ততম জীবনে তাকে নিয়ে ভাববার অবকাশও মেলে না l এই গভীর রাতে নির্জন পরিবেশে বর্ষাঘন  প্রকৃতির প্রণোদনায় মনের গভীরে তার কথা মনে পড়ে l অন্তর থেকে মন তাকে ডাকে l


বাইরে দমকা বাতাস l কবির মনে ভাবনার ঝড় l বৃষ্টির ছাট শরীর শীতল করে l কিন্তু মন স্মৃতির ভারে বিচলিত l সেই স্মৃতি কাগজের পাতায় কবিতা আকারে উগড়ে দিতে মন অশান্ত হয় l


রোমান্টিক নস্টালজিক ভাবনায় পূর্ণ মনোরম কবিতা উপহার দেবার জন্য কবিকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা l


**
ছাঁট < ছাট (বৃষ্টির ছাট - কাপড়ের ছাঁট)