কবিতার নাম 'হ্যালুসিনেশন' l হ্যালুসিনেশন হলো এমন এক অবস্থা যখন কোনো প্রকার উদ্দীপনা ছাড়াই ব্যক্তি কোনো বিশেষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি লাভ করে। হ্যালুসিনেশন সব ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রে হতে পারে l শোনার ক্ষেত্রে, দেখার ক্ষেত্রে, ত্বক অনুভূতির ক্ষেত্রে, জিহ্বা ও নাসিকা অনুভূতির ক্ষেত্রে l
শোনার হ্যালুসিনেশনের ক্ষেত্রে কানে এমন আওয়াজ আসে বাস্তবে যে আওয়াজের অস্তিত্ব নেই l চোখের হ্যালুসিনেশন বা ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন হলো এমন অবস্থা যখন ব্যক্তি চোখের সামনে এমন কোনো বস্তু দেখতে পায় যা বাস্তবে সেখানে নেই l ত্বকের হ্যালুসিনেশনে ব্যক্তি অনুভব করে তার ত্বকের ওপর দিয়ে বা নিচ দিয়ে কিছু একটা  চলাচল করছে, যদিও বাস্তবে এমন কিছু ঘটে না l জিহ্বা আর নাসিকার হ্যালুসিনেশন একসাথে বা পৃথকভাবে হতে পারে। জিহ্বার হ্যালুসিনেশনে ব্যক্তি  কোনো এক অজানা জায়গা থেকে খাবারের স্বাদ পেয়ে থাকে। নাসিকার হ্যালুসিনেশনে এমন হতে পারে, আশপাশের কেউ কোনো গন্ধ শুঁকছে না অথচ সেই ব্যক্তি তার নাকে এক উৎকট গন্ধ পেতে থাকে l
ইলিউশন আর হ্যালুসিনেশন প্রায় এক হলেও তার মধ্যে পার্থক্য আছে l হ্যালুসিনেশন আর ইলিউশন দুটোই বোঝার ভুল। তবে ইলিউশনে উদ্দীপক থাকে, হ্যালুসিনেশনে এমন কোনো উদ্দীপক থাকে না। সামনে ঝুলে থাকা দড়ি যদি কারো কাছে সাপ মনে হয় তাহলে এটা ইলিউশন। আর কেউ যদি কোনো দড়ির অস্তিত্ব ছাড়াই সাপ দেখতে পায় তাহলে তা হলো হ্যালুসিনেশন।
নানা অবস্থাতে ইলিউশন ঘটে থাকে। যখন উদ্দীপন তীব্রতা কমে আসে, তখন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষও ইলিউশনের শিকার হতে পারেন। যখন সন্ধ্যায় আলো কমে আসে তখন সামনের ঝোপকে মনে হয় কেউ যেন বসে আছে। ব্যক্তির সজ্ঞানতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন কোনো রোগের কারণে আমাদের হুঁশ অবস্থা কমে যায় তখনো এমন বিভ্রান্তি ঘটতে পারে। এ কারণে স্ট্রোক, কিডনি রোগীরা এমনকি জ্বরের রোগী পর্যন্ত এমন বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন। ইলিউশন ঘটার ক্ষেত্রে রোগীর মনের অবস্থাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুব উদ্বিগ্ন অবস্থাতে দূরের ঝোপকে শত্রু মনে হতে পারে।


কবি ফয়েজ উল্লাহ রবি (পারিজাত) রচিত 'হ্যালুসিনেশন' কবিতাটিতে দেখা ও স্পর্শের হ্যালুসিনেশন ঘটেছে l কবিতার শুরুতে পাই, সকালে ঘুম ভেঙ্গেই কবি দেখছেন পাশে তাঁর স্ত্রী/প্রেমিকা শুয়ে আছেন l হ্যালুসিনেশন-এর ক্ষেত্রে যেটা হয়, মন সর্বদা যা চিন্তা করে, সর্বদা যা কামনা করে, সর্বদা যা আশঙ্কা করে, তারই প্রতিচ্ছবি সে দেখে বা তার ধ্বনি শোনে l এক্ষেত্রে কবি যেহেতু তাঁর প্রেমিকার কথা সর্বদা চিন্তা করেন, সর্বদা তাঁকে পাশে পাবার আশা করেন, তাই তিনি একেবারে তাঁর বিছানায় তাঁর 'অনামিকা' প্রেমিকাকে দেখছেন l হ্যালুসিনেশন কিন্তু স্বপ্ন নয় l একেবারে জাগ্রত অবস্থায় সত্যি সত্যি সামনে দেখার অনুভব, যদিও বিষয়টি সত্য নয় l কিন্তু যিনি হ্যালুসিনেশনে আছেন, তাঁর মনে কিন্তু কোনো সন্দেহ কাজ করে না l তিনি বাস্তবজ্ঞানেই তা দেখেন l এক্ষেত্রে কবিও তাই দেখছেন l অনেকদিন পরে প্রেমিকার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে বলে তাঁর মনে হচ্ছে l কবি দেখছেন তাঁর প্রেয়সীর এলোমেলো চুল, লিপিষ্টিকের রঙ গালে লেগে একটা দাগের মতো হয়েছে l চেহারা শান্ত l কোমলতায় ভরা l হয় তো অনেক দিন পর আজ শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছে সে l স্নেহভরা হাতে, খুব কোমলভাবে প্রেমিকার কপালে আসা চুলগুলো কানের পাশে সরিয়ে দেন কবি, সাবধানে, যাতে তার ঘুম না ভেঙে যায় l এখানে ত্বকের হ্যালুসিনেশন হয় l কবি অনুভব করেন তিনি হাত দিয়ে প্রেমিকার চুল স্পর্শ করলেন l কপাল ও কানও হয়তো স্পর্শ হলো l সত্য জ্ঞানেই তিনি এই স্পর্শ অনুভূতি পেলেন l
সকালবেলা নিজের বিছানায় সুদর্শনা প্রেমিকার এই দর্শন কবির কাছে একেবারে দিনের আলোর মতো সত্য অনুভবে আসে l কোন শব্দ না করে বাথরুমে যান তিনি l সেখানে চোখেমুখে ঠান্ডা জলের স্পর্শ পান l হ্যালুসিনেশনের ভাব কাটতে থাকে l মনের মধ্যে সন্দেহ জড়ো হয় l প্রতিদিনের মতো আজও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম ভেঙ্গেছে l তবে আজ ব্যতিক্রম কেন ? হঠাৎ আজ প্রেমিকা পাশে কি করে ? ভাবতে থাকেন l ভাবতে ভাবতে কোনো সমাধান না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন l ব্রাশ করতে করতে শোবার ঘরে ফিরে আসেন তাঁর সকালের দেখাটাকে পরখ করতে l কিন্তু কোথায় কে ? বিস্মিত হয়ে যান তিনি l মাত্র কিছুক্ষণ আগে যাকে দেখলেন স্বচক্ষে, স্বজ্ঞানে, সে গেল কোথায় ? নিজের সেই দেখার ওপর আস্থা রেখেই রান্না ঘর, ছাদ, সব জায়গায় খোঁজেন তিনি। 'অনামিকা' প্রেমিকাকে স্বগত প্রশ্ন করেন, সে কি আসলেই গত রাতে এসেছিল ?
নাকি কবি যা দেখেছেন, তা সত্য ছিল না l ছিল শুধু
এক ‘হ্যালুসিনেশন’। দেখার ভ্রম l প্রেমিকার জন্য সর্বদা কবির ভাবনা, তাকে পাশে পাবার কামনা এই হ্যালুসিনেশনের জন্ম দিয়েছে l
সুন্দর সহজ বর্ণনায় পূর্ণ গদ্য কবিতা l  সোজা সাপটা বক্তব্যে কাব্যরস প্রস্ফুটিত l
কবিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন !