সমাজবাস্তবতার রূপচিত্র ফুটে উঠেছে কবিতাটির ছত্রে ছত্রে l রূপের মধ্যে সমাজ কুরূপকে দিয়েছে স্থান l গ্রামে গঞ্জে, শহরে, নগরে নিত্যদিন হিংসার শিকার হতে হয় কতো প্রাণকে l কিছু মানুষের লোভ, তাদের অযৌক্তিক চাহিদা, অমানবিক আচরণ নিষ্পাপ কিছু জীবনকে অকালমৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় l সমাজ চুপ করে থাকে l একের পর এক, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে l জীবনের মূল্য শুধু কিছু পাওনার কাছে পরাজিত হয় l
নিত্যদিনের খেলায় নতুন করে সমাজরীতি অনুসারে সাজগোজ সমন্বিত হয়ে একটি জীবন, একটি বধূ নতুন সংসারে পদার্পণ করে l প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য অনেক কথা, অনেক পাওনাগন্ডার অন্তে চার হাত এক হয় l তারপর নতুন বাড়িতে চলে তার নিত্য অপমান, অবহেলা l প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে তাকে বোঝাপড়া করে চলতে হয় l সর্বদা শুধু মেনে নেয়ার গল্প l পথ ছেড়ে দেয়ার কাহিনী l চুলের বেনীতে ফুলের খোঁপা ঝাপসা হয়ে যায় l কাঁচের আয়না অস্বচ্ছ প্রতিরূপ দেয় l যে রূপ মাধুর্য, আত্মাভিমান নিয়ে তার শ্বশুরালয়ে আগমন, দিনে দিনে তা ঝরে যেতে থাকে l
নিত্য দিনের শাসন গঞ্জনা শরীরের রূপ আভা ম্লান করে তোলে l পাড়ায়, আরও দূরে কানাকানি, ফিসফাস গুঞ্জন শুরু হয় l গুজব রটে l সত্য মিথ্যা মিশে গিয়ে এক রহস্যঘন অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে l রূঢ় নিষ্ঠুর বাস্তব সামনে আসে l স্বপ্ন ভেঙে যায় l আতঙ্ক সৃষ্টি হয় মনে l তবু স্বাধীনতা থাকে না নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছু সিদ্ধান্ত নেবার l পারিবারিক চাপ, সামাজিক সম্মানবোধ সব মূর্ত রূপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় l বিপদকে অনুভব করেও কিছু করা হয়ে ওঠে না l যেন এটাই নিয়তি l বিপদের সঙ্গে জেনে বুঝে অসহায়ভাবে দিনানিপাত করতে হয় l মনের কোনায় ভয় থাকে l তবু চলে মানিয়ে নেবার প্রয়াস l সে প্রয়াস প্রায়শই ব্যর্থ হয় l শেষে নিজের জীবন দিয়ে সব মূল্য চুকাতে হয় l দীঘির জলে ভেসে ওঠে বছর তিরিশের সদ্য বিবাহিতা বধূর দেহ l তার ভালোবাসা, তার আপনজন তাকে অকালমৃত্যু দেয় l বিচার ব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা তাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় l প্রহরীদল চোখ বন্ধ করে থাকে l
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নানা সমালোচনা করতে শুরু করে l সেই বধূর দোষ খুঁজতে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চলে l মানিয়ে চলার ব্যপারে তার অক্ষমতা প্রকাশ হয় l অনন্ত প্রয়াস চলে তার খুঁত বার করার l এই অক্ষমতার অজুহাতে তার মাথায় নেমে আসে বিপদের ঘনঘটা l সব জেনেবুঝেও তাকে মানিয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয় l যেন মানিয়ে নিলেই তার জীবনটা রক্ষা পেত l সমাজ চুপ করে থাকে l যারা মানিয়ে চলতে পারে না, তাদের আবর্জনার সঙ্গে তুলনা করা হয় l সমাজে কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় না l চেতনা পরাজিত হয় l যদি কোথাও এতটুকু প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, সমাজের বধির কান তা শুনতে পায় না l সমাজের ঝাপসা আয়নায় সব ধামাচাপা পড়ে যায় l কিছু পরিকল্পিত, কিছু আকস্মিক, কোনো ঘটনার বিরুদ্ধেই সমাজ প্রকৃত অর্থে জ্বলে ওঠে না l শুধু চলে অপরাধ গোপন করার প্রয়াস l
সমাজবাস্তবতার নগ্ন রূপকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার প্রয়াস করেছেন "ঝাপসা কাঁচের আয়না কবিতা"র কবি বৈশালী l
কবিকে শুভেচ্ছা জানাই  l