জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের দায়িত্ব থাকে মানুষের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের । তার খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের সংস্থান করার । তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার । কিন্তু সরকারের সামর্থেরও সীমা থাকে । থাকে সরকারের সদিচ্ছার প্রশ্নটিও ।

বর্তমান যুগে যখন জনবিষ্ফোরণ হয়েছে প্রায় প্রতিটি দেশে, সরকারের পক্ষেও সকল মানুষের সকল প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়ে উঠছে না । দেশের কোটি কোটি মানুষের হাতে কাজ তুলে দেয়া, দু বেলা তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে ।


তবু সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে তার সামর্থ্যের মধ্যে কিছু কর্মসূচী নিয়েছে । প্রকৃত যাঁরা দরিদ্র তাঁদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের চিহ্নিতকরণের জন্য বিপিএল কার্ডের ব্যবস্থা করেছে । সেই কার্ড এই মানুষদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা হয়েছে । এই কার্ডের সাহায্যে তাঁরা যাতে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পান তার ব্যবস্থা হয়েছে সরকার নিয়ন্ত্রিত দোকানের মাধ্যমে । কিন্তু স্বল্পমূল্যে জিনিস কিনতে গেলেও অর্থ প্রয়োজন । সারা বছর সম্ভব না হলেও, এই মানুষগুলোর হাতে কিছু অর্থ তুলে দেবার জন্য সরকার বছরে ১০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করেছে । সমাজের দরিদ্রতম মানুষদের বেঁচে থাকার জন্য সরকারের এই উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় অবশ্যই যথেষ্ট নয়, কিন্তু এভাবেই মানুষগুলি বেঁচে আছেন ।


কবি প্রণব লাল মজুমদার তাঁর "কাজ চাই" শীর্ষক রচনায় এই আর্থসামাজিক অবস্থার নিরিখে এই দরিদ্রতম মানুষগুলির মনের অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন । সরকার দুঃস্থদের দুর্দশা ঘোচাতে তার কোষাগার থেকে অনুদানের সামগ্রীগুলি কেনার সুবিধা করে দেবার জন্য দুঃস্থদের বি.পি.এল.কার্ড দিয়েছে । কিন্তু মানুষ হিসাবে এই কার্ড গ্রহণ করার  মধ্যে মর্যাদা নেই । এইভাবে পরজীবীর মতো বেঁচে থাকতে চান না তাঁরা । তবু নিতান্ত বাধ্য হয়েই অর্থ-কষ্টে ম্রিয়মাণ দুঃস্থরা এই কার্ড গ্রহণ করেছেন ।
আত্মগ্লানিতে মাথা হেঁট করে পর্ণকুটিরে বসে সেই দুঃস্থরা অতি সামান্য দুই টাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাবার এই সুযোগ গ্রহণ করেছেন নিতান্ত অভাবের তাড়ণায় ।


কিন্তু এই মানুষগুলির প্রকৃত চাওয়া হলো কাজ করে অর্থ উপার্জন করা এবং সেই উপার্জিত অর্থে স্বনির্ভর হয়ে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা । "ভিক্ষা নয়, কাজ চাই" - এই দাবিতে তাঁরা সরব হন ।  সরকারী অফিসে, আদালতে তাঁদের দাবি নিয়ে উপস্থিত হন । দৃঢ়ভাবে কাজের দাবি জানান ।  


জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে সরকার এই দাবিকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারে না । তার সীমিত সামর্থের মধ্যে আংশিকভাবে এই দাবি মেনে নিয়ে এই মানুষগুলির জন্য বছরে একশ দিনের  
কর্মসংস্থানের প্রকল্প চালু করে । রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত প্রকল্পে অদক্ষ কর্মী হিসাবে অনাহার শৃঙ্খলিত প্রান্তিক মানুষেরা যোগ দেন । কাজশেষে প্রাপ্ত অর্থ ছুটে যান স্বল্পমূল্যের দোকানে দু টাকা কেজি চাল বা অন্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে । জীবনধারণের এমনই তাগিদ ।


এভাবেই দোলকের মতো সুতোয় ঝুলছে তাঁদের নিয়তি । কাজ পাওয়া, না-পাওয়ার নিদান।  বঞ্চিতরা পর্ণকুটিরে ফিরে ভাবেন এই কার্ড তাঁদের অসম্মান হলেও এর মাধ্যমেই তাঁরা বেঁচে আছেন । এই কার্ড দিয়েই তাঁরা বছরে অন্তত ১০০ দিনের জন্য কাজ পাচ্ছেন । এই কার্ড দিয়েই তাঁদের মিলছে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জীবনধারণের সামগ্রী । ফলে তাঁদের পক্ষে এই কার্ড ফেরত দেওয়াও সম্ভব নয় ।


কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা ।