মানুষ ও প্রকৃতি এই নিয়ে আমাদের অস্তিত্ব l মানুষ অবশ্যই প্রকৃতির অংশ l কিন্তু নিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করে, নিজের পারিপার্শিকতার পরিবর্তন করে মানুষ শুধু নিজেকে নয়, তার পারিপার্শিকতাকেও প্রকৃতি থেকে অনেক অনেক দূরে নিয়ে গেছে l তাই প্রকৃত প্রকৃতির সন্ধানে আমাদের যেতে হয় লোকালয় থেকে দূরে, যেখানে প্রকৃতি বেঁচে আছে তার নিজের মতো করে l যেখানে আধুনিক মানুষ, তার সভ্যতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রলোভন প্রকৃতির স্বরূপ হরণ করে নি l যেখানে তথাকথিত সভ্য মানুষের আধুনিক জীবনযাপনের ব্যভিচার, হিংসা, হানাহানি, প্রবেশ করে নি l


এরকম এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সন্ধান দিয়েছেন কবি খসা হক তাঁর "এসো জাফলং এ চলি" কবিতাটিতে l


"প্রকৃতি কন্যা হিসেবে পরিচিত জাফলং।
বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত, একটি এলাকা।
জাফলং, সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, এবং এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত।"
(কবিতাটির ওপর মন্তব্য : অনিমেষ দন্ডপাট ১৩/০৬/২০১৭, ১৭:২৪ মি:)


কবিতাটির স্পষ্ট দুটি ভাগ আছে l
প্রথম দুটি স্তবকে আছে জাফলং স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ বর্ণনা l আর শেষ দুটি স্তবকে আছে আত্মানুসন্ধান, আত্মসমালোচনা, ও আত্মশুদ্ধির সুর l


কবি প্রথম দুটি স্তবকে জাফলং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে এভাবে মেলে ধরেছেন l জাফলং এ মেঘের সাথে পাহাড়গুলোর এমনই  চেনাজানা যে কালো পাহাড় কালো মেঘের সঙ্গে যেন মিলেমিশে গেছে l  l যেন দুই সত্তার কোনো মিলনের টানে সহাবস্থান l সেই মেঘের মাঝে লুকিয়ে আছে কোমল জলকণা l সেই জলকণার স্পর্শ অপরূপ অনুভব দেয় l
স্বচ্ছ জলের নীচে পাথরবাঁধা তল নজরে আসে l এর মাঝে নৌকা ঠেলে ঠেলে জেলে পাথর তোলে l পাথুরে ওই জেলের হাসিরাঙা মুখ l দেখে মন ভরে যায় l জেলেদের নৌকো ভারী ভারী পাথর দিয়ে বোঝাই, কঠোর তাদের পরিশ্রম, তবু এই খাটুনির কষ্ট, দুঃখ তাদের মুখের হাসিকে ম্লান করতে পারে না l জীবনব্যাপী  এই কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে তাদের  এমন নিবিড় সংযোগ যে হাসিমুখে সেটিকে তারা জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছে l যে কোনো পর্যটক এমন পরিবেশে এক অনাবিল আনন্দের অনুভব পাবেন l


পরের দুটি স্তবকে কবি কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন l মানুষ প্রগতির নামে, তার স্বার্থপরতার কারনে প্রকৃতি থেকে দূরে, অনেক দূরে সরে গেছে l যুগান্তরব্যাপী মানুষের অনাচার, অত্যাচার, ব্যভিচার, হিংসা, হানাহানি, অন্ন বস্ত্র নিয়ে পশুতে মানুষে টানাটানি - এর ব্যথা পাথরের বুকে জমে আছে l সেই পাথর সব কিছুর সাক্ষী l তাই "পাথর কাঁদে শোকে!"


নিরেট প্রকৃতির কোলে এসে সভ্য জাতির এই অসভ্যতার কথা বড়ো বেশী করে ধরা দেয় l ধিক্কার  জন্মায় তথাকথিত মানবসভ্যতার ওপর l জাফলং এর কালো পাহাড়ের কোলে অনন্ত খরধারাকে মনে হয় যেন নয়নজলে ভরা জলের ধারা l
"জীবনের বিষাদগুলো হলো বাঁধনহারা।
কাতর হয়ে অধম হয়ে লুটায় নতশির-
আপনার মাঝে কেমন লাগে অস্থির!"


এক অপরাধবোধে আনত হয় মানবজাতির মস্তক l
নিজের সব বিদ্যাবুদ্ধি এই জননীসমা প্রকৃতির সামনে অসার মনে হয় l উপলব্ধি হয়, মানুষ হয়ে মানবতার সাধনা হয় নি l শুধু স্বার্থসাধনা হয়েছে চিরকাল l উন্মুক্ত প্রকৃতির সামনে এসে মানুষ এক চেতনাবোধে উদ্দীপ্ত হয় l নিজের আমিত্ব, স্বয়সম্বল সব প্রকৃতি মায়ের কোলে অর্পণ করে সে l


কবিতাটির মধ্যে পাই মানুষের আত্ম অনুসন্ধানের এক প্রয়াস l সভ্যতার শুরুতে মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো l কিন্তু জ্ঞান যতো বেড়েছে, বিজ্ঞান যতো এগিয়েছে, মানুষ যতো সমৃদ্ধ হয়েছে - ততটাই সে প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গেছে l মানবজাতির মূল যে ধর্ম, মানবিকতা, তা সে বিস্মৃত হয়েছে l চলার নেশায়, আরও আরও বড়ো হবার নেশায়, সে হিংসা, হানাহানি, কঠোরতা, বঞ্চনাকে আশ্রয় করেছে l অনাচার, অত্যাচার, ব্যভিচারে ভরে গেছে দেশ l প্রকৃতি থেকে যতো আমরা দূরে গেছি, ততই এই লক্ষণ আমাদের মধ্যে প্রকট হয়েছে l সরলতা, সহজ জীবন যাপন, একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো - এগুলি আমরা বিস্মৃত হয়েছি l

মানবজাতিকে তার নিজস্বতার বোধ দিতে হলে তাকে নিয়ে যেতে হবে তার অপাপবিদ্ধ প্রকৃতি মায়ের কাছে, যেখানে আদিম অকৃত্রিম প্রকৃতি তাকে নতুন করে মানবতার পাঠ দিবে l সেখানে আত্ম অনুসন্ধান, আত্ম সমালোচনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে পুনঃ আবিষ্কার করবে আত্ম বিস্মৃত মানুষ  l নিজের সব অহং প্রকৃতি মায়ের পায়ে অর্পণ করে আত্মশুদ্ধি করবে সে l
তাই কবি খসা হক সকলকে জাফলং যাবার আমন্ত্রণ দিয়েছেন l জাফলং একটি রূপক l প্রকৃতির যে কোনো সুন্দর স্থানের রূপক যেখানে এখনো মানবজাতির কদর্যতা প্রবেশ করে নি l
ছন্দে তালে, সুন্দর বর্ণনায়, আবেগপূর্ণ প্রকাশে কবি তাঁর বিষয়টিকে মেলে ধরেছেন l
কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা l


**
ভরিয়ে দেই বুক - ভরিয়ে দেয় বুক
আরাধোনা - আরাধনা