আসরের কবি অপরাজিতা মৌ আজকের তারিখে ১৭ টি কবিতা যোগ করেছেন l তাঁর বিভিন্ন কবিতার মধ্যে কিছু সাধারণ সুর পরিলক্ষিত হয় l


১৫৫. কবিতা : তৃষ্ণা
একটি সুর হলো নারী ও পুরুষের প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্কে বিশ্বাসের স্থান, তার রক্ষণ অথবা ভাঙ্গন l এবং এর প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতির শিকার সর্বদা নারীজাতি l বিশ্বাসে ভর করে একজন নারী পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে l কিন্তু পুরুষজাতি প্রায়শই সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে না l বিশ্বাসের অমর্যাদা আঁচ পেয়েও অবিশ্বাসে মোড়ানো হৃদয় নিয়ে নারী পুরুষকে বিশ্বাস করে l সে যেন অনন্যোপায় l পুরুষ ছাড়া সে যেন আরো অসহায় l তৃষিত নারী জীবন বাজি রেখে তূরূপের তাস হয় l কোনো হিসাব করে না l


১৫৬. কবিতা : সঙ্গিনী
এত কিছুর পরেও নারী পুরুষকে অস্বীকার করে নি l প্রত্যাখ্যান করে নি l প্রেম ভালোবাসার প্রশ্নে, জৈবিক কারণে সে পুরুষের ওপরই নির্ভর করেছে l এই পরস্পরনির্ভরতা সমাজ ও সভ্যতার বুনিয়াদ l 'সঙ্গিনী' কবিতায় শুনি সেই নির্ভরতার বার্তা :
"এক জীবনে বাঁচতে গেলে,
প্রেম না হলেও বেজায় চলে।
খানিক বোঝা-পড়া আর
পাশে থাকার জোর।
বাঁচিয়ে দেবে তুফান স্রোতে,
ভালোবাসার ডোর।"
'মৃণাল' কবিতায় সেই এক বার্তা :
"শুধু জানি পথ নেই,
পিছু ফিরবার।
বুকে টেনে নে আমায়,
আরো একবার।"


১৫৭. কবিতা : লতা
কবিতাটিতে পুরুষের দ্বারা যুগ যুগ ধরে প্রতারিত হতে হতে পুরুষজাতির প্রতি নারীর মধ্যে যে অবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়েছে তার বর্ণনা আছে l পুরুষের মধ্যে কে রাম আর কে রাবণ - এই প্রশ্ন জেগেছে তার মনে l নারী সর্বদা ভীত l এই বুঝি তার লজ্জা, সম্মান লুণ্ঠিত হলো l এক পুরুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সে নির্ভর করে অন্য এক পুরুষের ওপর l পুরুষ স্বভাবতই  দৃঢ়চেতা l শূর্পনখার প্রেম অভিনয় তাকে টলাতে পারে না l কিন্তু ভিখারীবেশেও রাবণ সীতাকে ভ্রমিত করে l কারণ নারী কোমলস্বভাব, লতাপ্রায় l কবিতায় চাঁদ, নদী, ফুলের সঙ্গে তার তুলনা হয় l তাই রণক্ষেত্রে বীরাঙ্গনা নারীও প্রেমের ক্ষেত্রে অবুঝের মতো আচরণ করে শোষিত ও লুণ্ঠিত হয় l কবি নিজে বলেছেন কবিতাটির মূল বিষয় হলো নারীর বিরহ, অসহায়ত্ব ও পুরুষের ওপর তার প্রেমনির্ভরতা l


১৫৮. কবিতা :  দিব্যি দিলাম
কবিতায় কবি নারীকে দিয়ে বলাচ্ছেন "নামটা আমার পুতুল বলেই, / পুতুল খেলো না ! / আমায় কষ্ট দিও না !"


১৫৯. কবিতা : বিষপ্রহর
কবিতায় বিশ্বাসভঙ্গের গল্প l প্রতিশ্রুতির ফানুস খৈ হয়ে উত্তুরে বাতাসে উড়ে গেছে l প্রবঞ্চিত নারী অপমানে দুঃখে জড়োসড়ো l রাতের অন্ধকারে সে বিষবিদ্ধ l গৃহবন্দী সে l বাইরের জগতের স্বাধীনতা তার জন্য নয় l অধিকারহীনতায় তার জীবন যাপন l কোনো শখ আল্হাদ নেই তার l সে শুধু অন্যের ভোগের উপকরণ l কোনো সম্পর্কের মর্যাদা তার জন্য নয় l অপমানিত নারী যেন অভিশাপগ্রস্ত জীবন যাপনে বাধ্য l


১৬০. কবিতা : অতৃপ্তি
কবিতায় তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা পীড়িত পুরুষ প্রতি পদে নারীকে উপভোগ করে জাগতিক দৃষ্টিতে l পুরুষ যে নারীর কাছ থেকে প্রকৃত প্রেম পেতে পারে না, এটা যে তার প্রাপ্য নয়, এই বিষয়টি বেশ জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে কবিতাটিতে  l


১৬১. কবিতা : বিবসনা
কবিতায় পাই প্রেমপ্রত্যাশী নারীর চরম লাঞ্ছনার গল্প l শাড়ির ভাঁজ খুলে বিবসনা হয়ে নারী তার সর্বস্ব দান করে তার তথাকথিত প্রেমিককে l কিন্তু পুরুষের কামনা মিটতে লাগে কেবল খানিক সময় l তারপরেই তার রুদ্র মূর্তি ! পুরুষের কামনা, লালসা নিরসনের বিনিময়ে অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতক পুরুষের কাছ থেকে নারী পায় দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, চুরুটের পোড়া দাগে দগ্ধ হৃদয়, খামচে নেয়া সরু কোমর, পিঠে চাবুকের কষাঘাত, গর্ভপাতের কান্না, শকুনের নখের দাগে বুকে আঁকা উল্কি l নারী পুরুষের সম্পর্কে প্রেমের স্থান নগণ্য l শুধু লালসা, আঘাত আর অপমান l রাতের আঁধারে দেহ খুইয়ে আঁধারের চাদর প্রাপ্তি। পুরুষশরীর নয়, নারীর প্রয়োজন নিশ্চিন্ত আশ্রয় l বিশ্বাস ও ভরসার স্থল l ক্ষতবিক্ষত শরীর ও মনের শুশ্রুষা l
পুরুষ এবং নারী l এক অপরের মুখাপেক্ষী, পরিপূরক পরস্পরের l জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাবার দিন থেকে প্রতিটি আদম ও ইভ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে আসছে l এ আকর্ষণ বহুমাত্রিক l তার মধ্যে পরস্পরের প্রতি অনুরাগ, প্রেম ও ভালোবাসার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার মূল বুনিয়াদ হলো বিশ্বাস l এই বিশ্বাসে ভর করে এক নারী ও এক পুরুষ পরস্পরের কাছে আসে l পুরুষজাতি ও নারীজাতি এই বিশ্বাসে ভর করেই একটি পরিবার থেকে শুরু করে একটি সভ্যতা গড়ে তোলে l মানবসভ্যতা l কিন্তু বিশ্বাসের এই কষ্টিপাথরে পুরুষ বারংবার নিজেকে অবিশ্বাসী প্রমাণ করেছে l সভ্যতার শুরু থেকে দেশে দেশে, কালে কালে, নগর থেকে গ্রামে, দিনে কিংবা রাতে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কিংবা শান্তির আবহে নারী বারংবার প্রতারিত হয়েছে l প্রতারিত হয়েছে কোনো পুরুষের দ্বারা l পুরুষ নানা বেশে নারীকে ছলনা করেছে l কখনো প্রেমিকের রূপে, কখনো ধর্ষকের রূপে নারীকে শোষণ, লুণ্ঠন করেছে পুরুষ জাতি l কখনো অর্থের বিনিময়ে রাতের অন্ধকারে নারীর সম্ভ্রম বিক্রি হয়েছে দেহবাজারে l কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারীকে প্রলোভিত করে তাকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে l যুদ্ধে, সাধারণ কলহে বিজয়ী পুরুষ লাঞ্ছনা করেছে বিজিত জাতির নারীসমাজকে l


কবিতা থেকে কবিতায় কবি অপরাজিতা মৌ নারী ও পুরুষের পরস্পর নির্ভরতার মধ্যে এই যে বিশ্বাসহীনতার আবহ, ফলত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর লাঞ্ছনা, অপমান, অধিকারহীনতা, গ্লানিময় অস্তিত্ব - তার লেখচিত্র মেলে ধরেছেন l তারপরেও এই সম্পর্ক বেঁচে আছে l বেঁচে আছে অবিচ্ছেদ্যতার কারণে l  


প্রতিশ্রুতিবান কবিকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা !