নদী পারের কবিতা l মাঝিকে আহ্বান l জীবনপথ অতিক্রম করে এবার ওপারে যাবার আকাঙ্ক্ষা l তাই মাঝিকে কায়মনোবাক্যে আহ্বান করা হচ্ছে l কবি এম,এ,সালাম রচিত "পাড়ের আশায়" কবিতায় যেন বাউল গানের সুর ধ্বনিত হয়েছে l  


"ওহে, দিন তো গেল, সন্ধ্যা হ’ল, পার কর আমারে।
তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে l" (বাউল কবি কাঙাল হরিনাথ)


কবি নদী পারাপারের আশায় ছোট্ট নদীর পাড়ে বসে আছেন l মাঝিকে আহ্বান করছেন যেন তাড়াতাড়ি এসে তাঁকে নদীর অপর পারে নিয়ে যান l নদী এখানে ভবসিন্ধু l ওপারে যাবেন অর্থ ইহলোক ছেড়ে পরলোকে যাবেন l তাই মাঝি অর্থাৎ ঈশ্বরকে স্মরণ করছেন l সকালের রবি হেলে পড়েছে, অর্থাৎ কবি জীবনসায়াহ্নে এসে পৌঁছেছেন l আঁকাবাঁকা পথ l অর্থাৎ জীবনের পথ সরল ছিল না l অনেক বাধা বিপত্তি, লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জীবনকাল অতিবাহিত হয়েছে l এখন জীবনসায়াহ্নে এসে কবির আর কোনো পার্থিব কামনা বাসনা নেই l এখন একটাই কামনা - প্রভুর দয়া, ঈশ্বরের করুণা l ঈশ্বর তাঁর সমস্ত দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে তাঁর জীবননদী পারের ব্যবস্থা করে পরপারে তাঁকে গ্রহণ করুন l
পরমার্থ লাভের আশায় জীবনভর অনেক কর্ম করেছেন কবি l হাঁপিয়ে পড়েছেন কর্ম করতে করতে l তবু মনে স্বস্তি পেয়েছেন সামান্যই l সুনীল দিগন্তের পথে এই যাত্রায় পিপাসার্ত হয়ে আছেন l
কাতর প্রার্থনা করছেন নিজের ঈশ্বরকে, তাঁর তৃষ্ণা নিবারণ করে তাঁকে পরপারে নিয়ে যেতে l জীবনভর যা কিছু পুণ্য তিনি সঞ্চয় করেছেন, সব পারানি হিসাবে দিতে তিনি প্রস্তুত l তাঁর সব কর্মফল গ্রহণ করে পরম কল্যাণময় ঈশ্বর অমাবস্যার মহানিশির কালে তাঁকে পরপারে যাবার অনুমতি দান করুন l ভবপারে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন l
পরপারে আশ্রয় পাবার পর হয়তো আবার তাঁর পুনর্জন্ম হবে l আবার অন্য কোনো মাঠ পেরিয়ে অন্য কোনো গাঁয়ে তাঁর বসতি হবে l জন্ম যিনি দিবেন, জীবনপথ অতিক্রম করার 'বাতি' অর্থাৎ উপায়ও তিনি দিবেন, এই পরোক্ষ  প্রার্থনা থাকে কবির l এখন এই উত্তাল জীবননদী পার করে তাঁর মাঝি অর্থাৎ ঈশ্বর কখন কিভাবে তাঁকে ভবপারে নিয়ে যাবেন এই চিন্তায কবি মগ্ন থাকেন l


কবিতাটিতে সংসারের সুখদুঃখের অন্তে পরপারে যাবার আকাঙ্খা ধ্বনিত হয়েছে l বাউলসঙ্গীত যেমন সংসারের অনিত্যতার ধারণা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেমভাব জাগিয়ে  তুলে, এই কবিতার মধ্যেও তেমন প্রয়াস দেখা যায়। রূপের গর্ব, ঐশ্বর্যের অভিমান, বাসনার আসক্তি থেকে মানুষ নিজেকে যদি মুক্ত করতে  চায়,  তাহলে বাউলসঙ্গীত এক অমোঘ বিধান । কাঙাল হরিনাথ, লালন ফকির ছিলেন  উনিশ শতকের দুই গ্রামীণ এলিট – যাঁদের প্রয়াসে বাংলায় বাউলগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল l তাঁদের গান কেবল দেহতত্ত্ব নয়, মানবতন্ত্র ও জীবনসত্যের ভাবসাধনারও গান ছিল l ক্রমে এর সঙ্গে যুক্ত হলেন বিষাদ-সিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেন। ব্রহ্মজ্ঞানী সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে গভীরভাবে স্পর্শ করল কাঙালের গান। এই গান তাঁর অন্তর্জীবনে আনল এক বিরাট পরিবর্তন। ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের কাজে এই গান হয়ে উঠল এক শক্তিশালী বাহন। কান্তকবি রজনীকান্ত সেন ও রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও বাউলগানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় l


কবি এম. এ. সালাম মহাশয়কে তাঁর এই সুন্দর রচনাটির জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাই l