মায়িশা তাসনিম ইসলাম - আসরে নতুন যোগদান করেছেন। আজকের তারিখে দেখলাম তাঁর ১৩ টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই পাঠকপ্রিয় কবি। আসরে নতুন লিখছেন। কিন্তু কবিতাগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় লেখার হাত আছে এবং অনেকদিন থেকে চর্চায় আছেন। সহজ অথচ বলিষ্ঠ ভাষা ৷ ভাবপ্রকাশ প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ৷ চমৎকার সব বিষয় ৷ প্রতিটি লেখায় পাই গভীর ভাবনার প্রতিফলন।
যে বিষয়েই কবিতা লিখুন, উপমা, উৎপ্রেক্ষা বিষয়ানুগ। বক্তব্যে ধারাবাহিকতা, স্বচ্ছতা স্পষ্ট। প্রকাশভঙ্গি সরল। কল্পনার যে আবহ কবিতায় তৈরি হয়, পাঠক সহজেই মানসনেত্রে তার চিত্রকল্প নির্মাণ করতে পারেন। শব্দ চয়ন, কথকতার ধরন, বিষয়বস্তু নির্বাচন - সবক্ষেত্রেই স্বকীয়তার ছাপ স্পষ্ট।


প্রেম বিষয়ক কবিতাগুলি সুন্দর সব রোমান্টিক পটভূমি নির্মাণ করেও শেষ পর্যন্ত এক বিবেচক মরমী প্রেমিকার সুরে কথা বলে। প্রেমিকের ভালো মন্দ তুলে ধরে। নিজের পছন্দ অপছন্দ গোপন করে না। অন্তরের ভালবাসা প্রকাশ পায় কবিতা থেকে কবিতায়। কিন্তু সে ভালবাসা পরিবেশ পরিস্থিতি সাপেক্ষে পরিমিতি বোধের ছাপ রাখে, অবুঝ নয়।


আজ পর্যন্ত আসরে প্রকাশিত কবির ১৩ টি  কবিতা - প্রেম, বিরহ, জীবনমুখী ইত্যাদি বিষয়ক - তার ওপর স্বল্প আলোকপাতের প্রয়াস করব।


আসরে প্রকাশিত প্রথম কবিতা "প্রেম বিবর্তন" এই কবি তাঁর উপস্থিতির উজ্জ্বল সাক্ষর রাখেন l আদম-ঈভের আদিম সৎ প্রেম হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে বিশ্বাসভঙ্গের যে ঐতিহ্য রচনা করেছে, তাতে প্রেম তার মাধুর্য হারিয়েছে l


"তার চেয়ে কি ভাল ছিলো না আদিম প্রেম?
যে প্রেমে সততা ছিল, উল্লাস ছিল, বেদনা ছিল
প্রেমের সুতোয় নির্বস্ত্র প্রেমিক-প্রেমিকারা বুনতো টেকসই অভিসার।
অথচ আজ?
সভ্যতার আড়ালে লুক্কায়িত অন্তর্বাসে বোনা আছে প্রতারণার অশ্লীল উল্লাস !" (প্রেম বিবর্তন)


কিন্তু নিজের প্রেমবিশ্বাসে অটল কবিতার কথক প্রেমিক,


"কিন্তু আমাকে ফেলে দেয়ার দুঃসাহস পাবে না এমন হাজারো ভূমিকম্প।
দাঁড়িয়ে থাকব এমন উচ্চতায়;" (পরাভূত বাস্তব)


কবিতাগুলিতে পাই সুন্দর শব্দচয়ন, কাব্যিক প্রকাশভঙ্গি, অপরূপ উপমা ও শব্দচিত্র l বৃষ্টি বর্ণিত হয়েছে "আকাশের সজল সংলাপ" (চিন্হ) রূপে l


জীবনচক্রের অনুরূপ প্রেমচক্র চলবে জন্ম জন্মান্তর ধরে,
"শুরু হবে আরো একবার, প্রণয়ের বিনিদ্র নেশায় পেলব রাত্রিগুলোর অবগাহন ।
কিন্তু কোন এক বৃষ্টির দিনে সেই গোলাপটাও পুড়ে হবে ছাই,
এভাবেই চলবে জন্ম-জন্মান্তর।" (গোলাপচক্র)


প্রলোভনকে অস্বীকার করে প্রেমে নিজস্ব নীতিতে অবিচল থাকার বার্তা,
"সত্যের কংকালের উপর ধারণ করে আছি অন্ধকারের অভেদ্য চামড়া- " (বসন্ত পূর্ণিমা এবং একটি আত্মঘাতী উপাখ্যান)


প্রেমে বিশ্বাসের জয়গান,
"আমার সূর্যহীন আকাশ থেকে তুমি কিভাবে রোদ টেনে নিলে?
কিভাবে অবিশ্বাসের তুষারপাতে জন্ম নিল হঠাৎ বিশ্বাসের অলয়-পুষ্প?" (শেকড়)


প্রেমবোধে অহংবোধ বিসর্জন এবং প্রেমের অটল বিশ্বাসে অবিচল ভাব,
"আমার মাঝে থাকা আমিকে যখনই তোমার কাছে নিয়ে গেছি,
তখন আমাকে আর আমি চিনতে পারিনি।
…..
এত হৃদয় আছড়ে পরলো অথচ আমি ফিরেও তাকাইনি
নক্ষত্রের ডাক কিংবা জোনাকি-সমর্পনেও থেকেছি অবিচল।
কোনো মরুঝড় পারেনি এ চোখে ধূলো জমাতে,"  
(শতাব্দীর বিধ্বস্ত চোখ)


অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেম ও তার মোহে পদস্খলন হলে ক্ষতির পাল্লা যে মেয়েদের দিকেই বেশি থাকে এই সচেতনতার সতর্কবার্তাও আছে,
"তার চোখের কালোয় যে সমাধি এঁকেছ,
কাল টিপ পরতে গেলে দেখবে ললাটে বয়ে যাচ্ছে কাফনের নদী।
তোমার নগ্ন বক্ষ ছুঁয়ে দেওয়া প্রেমিকের হাতে আজ তামাকের ওষুধ,
উনুনের ধারে কাছে যেয়ো না, এ পৃথিবীতে এখন তুমিই সবচেয়ে বেশি দাহ্য।" (বালিকাবেলা এবং বিষ )


অপূর্ণ প্রেম, একতরফা প্রেম - তার বেদনা,
"আহত অনুরাগের স্পর্শে তুমি সমুদ্র হয়ে গেলে!
…..
আবার যখন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ হতে চাইলাম
এনে দিতে চাইলাম গভীর রাতের স্নিগ্ধ স্পন্দন,
সূর্যসঙ্গমে তুমি হয়ে উঠলে বিদগ্ধ পাহাড়!
……
তবুও আজন্ম প্রেমান্ধ আমি তোমার চূড়ায় বসাতে চেয়েছি প্রেমের পতাকা
…..
শেষবার যখন চোখ মেলি, দেখলাম তুমি হয়ে গেছো বৃক্ষ!
তোমার সবুজের দিকে বিভ্রান্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম শুধু অনিমেষ, আমি আর আকাশ হতে পারিনি।" (আঁধারের স্বরলিপি)


আছে প্রেমিকের বিশ্লেষণ l তার সংসর্গে ভালো এবং মন্দের অনুভব, নিজের পছন্দ ও অপছন্দ অকপটে প্রকাশ,
"যেখানে দিগন্তের অনিন্দ্য শুভ্রতা,
যেখানে ভালোবাসার অমলিন চাহিদা।
….
যেখানে আঁধারকালো কাব্যিক রাতের তীব্র গন্ধ,
যেখানে লেখা থাকে অবাধ্য আঙুলের স্পর্শ-শিহরিত  কাব্য অনন্ত !
….
অথচ যখন তোমার চোখের দিকে তাকাই,
আমি দেখি ধূমপানের উগ্র নেশা খেলা করছে...
যেন বিষাক্ত কোনো রক্তিম সরোবর আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে!
….
আর আমার হৃদয়ের অ্যাশট্রেতে জমা পরে কতগুলো বিক্ষুব্ধ ছাইয়ের আর্তনাদ।" (ধূমপায়ী প্রেমিক)


প্রেমে বিশ্বাসঘাতীর জন্য রয়েছে চরমতম শাস্তির আর্জি,
"তোর মুখ থেকে নির্গত অভিশাপে হেসে ওঠে মৃত্যু,
নিশ্বাসগুলো স্পর্শ করলে পুড়ে যেত সব অহংকার !
….
অশুদ্ধ রক্তের বিস্ফোরণে ধ্বংস হয় শুধু প্রেম,
…..
অবিচারের আদালতে যে ঈশ্বরের চোখ বাঁধা থাকে,
সেও তোকে পাপী ঘোষণা করে খুলে ফেলে চোখের কালো কাপড়।
বিক্ষুব্ধ প্রেমিক-প্রেমিকারা দাবি করে মৃত্যুদণ্ড,"
(বধ্যভূমি থেকে)


আছে সাহসী প্রেমিক যেখানে "আকাশ হয়ে জন্ম নেওয়া প্রেম সূর্যকেও বশ করতে জানে।"  (ক্যাকটাসের সমুদ্র)
বৃষ্টি প্রেমরূপে ঝরতে চায় l অনুমতি নেই l প্রেমিকা অপবাদের লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয় l  প্রেমহীন ক্যাকটাস-এর সমুদ্রে অন্তঃক্ষরণে যন্ত্রণাদগ্ধ হতে থাকে l
"জলের ঔষধকে বিষ ভেবে ফেলে দিলে হাত থেকে
অপবাদের লজ্জায় প্রসারিত বুকে জন্ম নিলো ক্যাকটাসের সমুদ্র,
একদিন এই সমুদ্রে দাঁড়িয়েই তুমি রক্তপাতের দূর্গ গড়ে তুলবে।" (ক্যাকটাসের সমুদ্র)


আছে নির্মল প্রেমে আত্মনিবেদনের ঘোষণা,
"তোমার যে পথ অনন্তের দিকে ধাবমান,
সে পথেই অস্তিত্বের প্রগাঢ়তা বিছানো আছে

আমি চিরকাল সে পথেরই শায়িনী।
যখনই তুমি তাকাবে প্রেমময় চোখে,
দেহ থেকে আত্মাটা খুলে হয়ে উঠবো নিবেদিত স্রোতস্বিনী।" (নিবেদন)


১৩ টি কবিতাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর l নিরন্তর চর্চা ও সাধনা কবিকে কবিতাচর্চার পথে অনেকদূর নিয়ে যাবে প্রত্যাশা রাখি l


কবিকে জানাই শুভকামনা !