উনিশ শো একাত্তর সালের সাতই মার্চের শপথ এবং ঐ বছর ষোলোই ডিসেম্বর তার রূপায়ণ l মাঝে নয়টি মাস l এই নয় মাস জুড়ে তীব্র আন্দোলন - আন্দোলন মুক্তির জন্য, আন্দোলন স্বাধীনতার জন্য l শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান শেখ মুজিবের কণ্ঠে সেই দৃপ্ত আহ্বান,
"এবারের সংগ্রাম
মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম
স্বাধীনতার সংগ্রাম।"


"সাত থেকে ষোল" শিরোনামে কবি জাহিদ হোসেন রনজু সেই বীরগাথা আমাদের শুনিয়েছেন দৃপ্ত রচনায়, আবেগ আপ্লুত স্বরে l সাতচল্লিশে স্বাধীনতা লাভ করার পরদিন থেকেই পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তানের নানাবিধ শোষণ নির্যাতনের শিকার l একটা পর্বে ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন করে রক্তের বিনিময়ে পূর্ববঙ্গ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল l কিন্তু পাক শাসকেরা এই পরাজয়ের গ্লানি অন্য নানাভাবে উসুল করতে থাকে l পূর্ববঙ্গের ওপর শোষণ নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলে l ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি ছাড়া পূর্ববঙ্গের সামনে আর কোনো পথ নেই l একাত্তর সালের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সেই উপলব্ধি এবং এই লক্ষ্য পূরণের দৃপ্ত শপথ ঘোষিত হয় l ঠিক এই বিন্দু থেকে কবি জাহিদ হোসেন রনজু তাঁর গাথা শুরু করেছেন l সেদিন রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য l দুর্বার জনস্রোত বানের মত আছড়ে পড়ছিল, তার মধ্যে ছিলো বৃদ্ধ থেকে শিশু, পুরুষ মহিলা উভয়ই l বুকে বিশ্বাস বেঁধে গ্রাম থেকে, শহর থেকে রেসকোর্স মাঠে তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন মুক্তির স্বাদ পেতে l সারা দেশের সাত কোটি মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন কখন বাংলার বীর সেনানী মুক্তির বার্তা নিয়ে আসবে l


সেদিন রেসকোর্স ময়দানে মানুষের আশা আকাংখ্যার মূর্ত প্রতীক বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন l আশার আলোকে আলোকময় হয়ে মহাকালের মহানায়ক নির্ভীক দৃঢ় কণ্ঠে স্বাধীনতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন l সেই আহ্বান সবকিছু ছাপিয়ে পূর্ববাংলার প্রতিটি স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের কানে প্রবেশ করেছিল, তাঁদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল l তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে এবার বাংলা স্বাধীন হবে l কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে একই সঙ্গীত,
"এবারের সংগ্রাম
মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম
স্বাধীনতার সংগ্রাম।"


ঘরে ঘরে মাঠে ঘাটে মানুষ উল্লসিত হয়ে ওঠেন l গ্রাম গঞ্জে মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার রাজপথ l ঘরে ঘরে গড়ে ওঠে দূর্গ l
নিজেদের রক্ত বাজি রেখে চারিদিকে শিকল ভাঙার গান, মুক্তির শপথ প্রকট হয়ে ওঠে l সকলেই এক বাঙালি পরিচয় নিয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন l
এভাবেই প্রবল স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যায় l দিকে দিকে শোনা যায় একটি নাম-
'তোমার নেতা, আমার নেতা
শেখ মুজিব শেখ মুজিব'


শত্রুপক্ষও বসে থাকে না l তাদের বিশ্বাসভাজন কিছু মানুষ দেশের মধ্যে অন্তর্ঘাতে লিপ্ত থাকে l মেঘে ঢাকা বাংলার আকাশ, থমথমে পরিবেশ l অনেক গুজব, কানাঘুষা চলে l বাঙালি নিধণের গভীর ষড়যন্ত্র রচিত হয় l পঁচিশে মার্চের সেই কালো রাত, 'অপারেশন সার্চ লাইট', পাক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে l সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তারা শিশু, বৃদ্ধ জোয়ান পুরুষদের হত্যা করে, নারীদের হরণ করে তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচারে চালায়, খাদ্যবস্ত্র লুঠ করে এবং অগ্নিসংযোগ করে, বাড়িঘর, বাজার হাট জ্বালিয়ে দেয় l পরপর তিনদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলে l একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়, স্বাধীনতা ছাড়া পূর্ববঙ্গের আর কোনো পথ নেই l
ভয়ঙ্কর সেই ক্রান্তিকালে, ছাব্বিশে মার্চ প্রথম প্রহরে
জীবন বাজি রেখে ইথারে বঙ্গবন্ধু মুক্তির চরমপত্র লিখলেন, "আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন' l


সেই অমিয় বানী শুনে বাংলা ফুঁসে ওঠে, গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী l মৃত্যু উপত্যকায় গড়ে ওঠে বাঙালি প্রতিরোধ l টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সব প্রান্তরে বাংলার দামালেরা মরণপণ লড়ে যায় l কখনো সম্মুখ সমরে, কখনো গেরিলা কায়দায় l
এভাবেই শত্রু সেনাদের আক্রমন পিছনে ঠেলে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে নয় মাস যুদ্ধ শেষে বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয় l


সেদিনটা ছিল ষোলই ডিসেম্বর উন্নিশ শ একাত্তর সাল l দিকে দিকে বিজয়ের সুর বাজছে, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে কাঙ্খিত স্বাধীনতা এসেছে l বাঙালির জীবনের সর্বাধিক গৌরবজনক দ্বিতীয় দিন, প্রথমটি এসেছিলো ভাষার প্রশ্নে, দ্বিতীয়টি মাটির প্রশ্নে l


এভাবেই পূর্ব পাকিস্তান মানচিত্র থেকে মুছে গিয়ে বাংলাদেশ হয়ে যায় l বাঙালি জাতির বিজয়ের স্মারকভূমি l


কবি তাঁর রচনায় বাঙালি জাতির সর্বাধিক গৌরবময় ইতিহাসকে যথাযথ আবেগ ও বীররসজারিত করে উপস্থাপন করেছেন, কবিকে জানাই অভিনন্দন l