দুজন পরস্পরকে ভালোবেসে কাছে আসে । তারপর একসাথে থাকা । এই থাকার মধ্যে নানান অনুভূতি । ভালাবাসা সৃষ্টি হয় পরস্পর সম্বন্ধে একটা ধারণা থেকে । এই ধারণা তৈরি হয় আবেগ থেকে । তার মধ্যে কতোটা ঠিক, কতোটা নয়, কতোটা একেবারেই বিপরীত, সেটা পরবর্তীতে প্রকাশ পায় । যখন প্রকাশ পায় তখন সম্পর্কের রসায়ন যায় পাল্টে । যে বিপুল প্রত্যাশা থাকে পরস্পরের কাছ থেকে তা ধাক্কা খেলে মনের ওপর চাপ পড়ে । তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবেই কিছু ভাবনা কিছু প্রতিক্রিয়া বেরিয়ে আসে ।


প্রেম সম্পর্কের প্রাথমিক অবস্থায় প্রেমিক প্রেমিকা যতোটা না যুক্তিবোধের দ্বারা তার থেকে অনেক বেশি আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় । পরস্পর সম্বন্ধে একটা রোমান্টিক ভাবনা কাজ করে যায় । পরস্পরের কাছে স্বপ্নের নায়ক নায়িকা হয়ে থাকে তারা । তারপর যতো দিন যায়, যতো তারা পরস্পরকে চিনতে থাকে, সম্পর্কের বাঁধনে কাছাকাছি আসে, তখন ধীরে ধীরে বাস্তব তাদের কাছে ধরা দেয় । রোমান্টিকতা ধীরে ধীরে কমে আসে । অভিমান ভালোবাসার জায়গা নেয় । অভিযোগ দানা বাঁধে ।


কবি লীনা দাস "স্বপ্নময় ও অপরাজিতা" শিরোনামে রচনায় এমনই দুই প্রেমিক প্রেমিকার প্রেম অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন যেখানে তাদের পরস্পর সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে প্রেম যতো পুরনো হয়েছে । প্রেমের তীব্রতা কমে যাবার এই বিষয়টিকে, তার বেদনাকে  কবি স্বজন হারানোর ব্যথার সঙ্গে তুলনা করেছেন ।


প্রেম স্বজনের মতো । মানুষের অস্তিত্বকে ঘিরে থাকে । স্বজন বিদায় নিলে মনে যেমন ব্যথা লাগে, প্রেম কমে গেলে বা হারিয়ে গেলে এমনই বোধ হয় । বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে । ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা বলে মনে হয় । প্রিয় স্বজনকে ঘিরে অনেক অনেক স্মৃতি মনের মনিকোঠায় ভিড় করে আসে আর ভেতরটাকে কাঁদিয়ে যায় । প্রেম হারিয়ে গেলেও এমন মনে হয় । যেন খুব কাছের কেউ একজন সঙ্গ ছেড়ে গেছে । ভেতরকে পুরো শূন্য করে দিয়ে চলে গেছে । পুরনো প্রেমের সেই স্মৃতি বারবার মনকে আঘাত দেয় ।


যখন প্রেম তীব্র ছিলো, তখন পরস্পরের সবকিছুই ছিলো সুন্দর । প্রিয়তমের নরম সুন্দর নীল চোখ ছিলো এক বিরাট ভরসার জায়গা, এক বিরাট আশ্রয়স্থল । অনেককিছু না থাকার মধ্যেও সেই সুন্দর নীল চোখ সুন্দরতম অনুভব ছিলো, যেন শূন্য এক উদ্যানে ফুটে থাকা নীল ফুলের সারি । অপরাজিতা সেই স্বপ্নময়কে ভালোবেসেছিলো । সে ভালোবাসা ছিলো সমুদ্রের মতো গভীর । ফুলের মতো সুন্দর ।


কিন্তু সব ভালোবাসা প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না । যখন এমনটা হয় তখন পরস্পর সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় । নীল রোমান্টিক চোখ তখন আগুনের গোলায় রূপান্তরিত হয় । বাস্তবের কঠোর আঘাত পেলব রোমান্টিক সম্পর্কে কুঠারাঘাত করে । প্রেমিকের যে মুখমন্ডলে ছিলো সরলতার ছোঁয়া, সেখানেই ক্রুর শয়তানি হাসির আভাস ফুটে ওঠে । প্রেমের মোহ ভেঙে যায় । মনে হয় যেন কোন্ এক অন্ধকার ভয়ঙ্কর অপরাধজগত থেকে উঠে এসেছে এক দানব । নিজের প্রেমিককে যখন দানব মনে হয় তখন প্রেমের আর কিছু অবশেষ থাকে না । তার ভয়াল চাহনি ভেতরকার মনকে আতঙ্কিত করে তোলে । এই আতঙ্কের বোধ সম্পর্কের অস্তিত্বকে নষ্ট করে নির্লিপ্ততা নিয়ে আসে ।


প্রেমের এই পরিণতি, তার শোক মনকে নির্লিপ্ত করে তোলে । আর কোনো প্রত্যাশা থাকে না । পরস্পর সম্বন্ধে দায়িত্ববোধও কমে যায় । কিছু হলে বা না হলে যেন কিছু যায় আসে না ।


প্রেম খুব নরম অনুভূতির নাম ।  আঘাত সহ্য করতে পারে না । খুব অভিমানী । নরম তুলতুলে ।
ধারাবাহিক আঘাত আর শোক  সেই প্রেমকে মেরে ফেলে । তার শোকে মন মুহ্যমান হয়ে থাকে । ধীরে ধীরে নির্লিপ্ততা গ্রাস করে গোটা অস্তিত্বকে । আশা প্রত্যাশার মৃত্যু হয় । ক্রমে পুরোপুরি নির্লিপ্ততা গ্রাস করে ফেলে । তখন আর কোনো দুঃখবোধও থাকে না । নেমে আসে অসীম শান্তি । অধিক দুঃখে মনটা যেন পাথরে পরিনত হয় ।


কবিকে জানাই শুভকামনা !