জীবন একটা চক্র । গোলাকার । ঠিক যেন ৩৬০ ডিগ্রি । যেখান থেকে শুরু সেখানে গিয়েই যেন মিলে যায় ।
মানুষ একা বাঁচে না, বাঁচতে চায় না । সঙ্গীর জন্য আকাঙ্খা তার চিরন্তন । আদম তার একাকীত্ব নিবারণের জন্য ঈশ্বরের অনুমতিক্রমে ইভকে সৃজন করে নিয়েছিল । তারপর মুনীনান্চ মতিভ্রম পথ ধরে সৃষ্টি এগিয়েছে ।
জন্মলাভের পর মা বাবা আত্মীয়স্বজন এর যত্ন পরিচর্যায় বড়ো হতে থাকে শিশু । বড়ো হতে হতে একটা পর্ব আসে যখন একদম নিজের করে একজনকে পাশে পেতে চায় সে । এমন একজন সঙ্গী যে তার শরীর মনের চাহিদা পূরণ করতে পারে । নিরন্তর খোঁজ চলে এমন একজন সঙ্গীর । যতোদিন এই সঙ্গী জুটছে না, জীবনকে কেমন শূন্য শূন্য মনে হয় । নিজের, পরিবেশের পরিচর্যা করা হয় না । সবকিছু কেমন অগোছালো হয়ে যায় ।
তারপর প্রকৃতির নিয়মে সঙ্গী জুটে যায় । সবকিছু সুন্দর গোছালো হয়ে ওঠে । মিলনের এই পর্ব চলে বেশ কিছুদিন । সন্তানসন্ততির আগমনে জীবন পূর্ন হয়ে ওঠে । কিন্তু এই জীবনও একসময় বাঁক নেয় । মিলন বিরহের রূপ নেয় । বিয়োগব্যথা জীবনের অন্যতম সত্য । সেই সত্যের পথে আবার সেই একাকী জীবন । আবার শূন্যতা । কিন্তু স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলির প্রতি দায়বদ্ধতা জীবনকে অতটা অগোছালো হতে দেয় না । কিছুটা অভ্যাসবশেও নিজেকে, নিজের চারপাশটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় ।


কবি অরিন্দম ঘোষ (শঙ্খধ্বনি) রচিত "তারপর তুমি এলে" শীর্ষক রচনায় পাই কবি জীবনের একটি পর্বে এসে দেখলেন জীবন তাঁর কাছে বিবর্ণ, বিস্বাদ হয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগে না তাঁর । কোনো কিছুর প্রতি, নিজের প্রতি যত্ন নিতে মন চায় না । দেওয়ালের কালিমাখা ঝুল একটি প্রতীক । এমন অনেক বাতিলযোগ্য বিষয়কে নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবনকে সুন্দর গতিশীল করে তোলার বিষয়ে তাঁর উৎসাহ থাকে না । শুধু যেন বেঁচে আছেন এই বোধটুকুই তাঁর থাকে । এই সব কিছুর মধ্যে একটা একাকীত্বের বোধ গ্রাস করে তাঁকে ।


মনে তখন ভালোবাসার পাখনা গজাতে শুরু করেছে । নিজের মনের মতো একজন সঙ্গীর সন্ধান শুরু হয়েছে । একদিন প্রকৃতির নিয়মে ঘটনাক্রমে এমনই একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় । সেই সাক্ষাৎ নবীকরন হতে হতে একদিন তাঁর সঙ্গেই জীবন জুড়ে যায় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে ।
"এক ঝোড়ো হাওয়ায় উন্মত্ত বাদলের দুপুরে
এই একলা ঘরে তুমি যেন এলে অক্সিজেন হয়ে"


তারপর কবি পেলেন "সত‍্যিকারের বাঁচার আস্বাদ" । কতোদিন ধরে ঠিক এর জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন । তাঁর "উন্মাদ হতে বসা ধুলোমাখা অন্তর" নতুন করে বেঁচে ওঠার ভাষা পেয়ে যায় । জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে । চারপাশের যা কিছু অসুন্দর সব বিদায় নেয় । বিদায় করে দেয়া হয় । এক রোমান্টিক আবেশে পরস্পরের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ জীবন অতিবাহিত হয়ে চলে নদীর শান্ত ধারার মতো ।


পরিবার আরো সুন্দর হয়ে ওঠে । সন্তানসন্ততি জীবনকে ভরিয়ে তোলে । তাদের ঘিরে কবির আনন্দময় জগত গড়ে ওঠে ।


কিন্তু জীবনে কিছুই নিত্য নয় । সবকিছুই পরিবর্তনশীল । যারা আসে তারাও নিজের নিয়মে বড়ো হয় । তাদেরও নিজেদের বৃত্ত গড়ে ওঠে । পুরনো বৃত্ত ছেড়ে যায় । কেউ ছেড়ে যায় জীবনের বন্ধন । ছেলে মেয়ে নিজেদের সংসার নিয়ে অন্যত্র সরে যায় । সেটাকে মেনে নিতে হয় । যে জীবনসঙ্গী একদিন এসে কবির জীবনকে সব অর্থে ভরিয়ে তুলেছিলেন, তিনিও চিরবিদায় নেন । সেই অমোঘ সত্যও কবিকে মেনে নিতে হয় ।


একলা জীবন পূর্ন হয়েছিলো । আবার সেই একলা জীবনে ফিরে যাওয়া । কিন্তু তাদের স্মৃতি থাকে । তাদের রেখে যাওয়া ঘর, দেয়াল, অনেক অনেক বিষয় থাকে যা পরিচর্যা দাবি করে । স্নেহের বশে, ভালোবাসার দ্বারা তাড়িত হয়ে কবি সেগুলির যত্ন পরিচর্যা করে চলেন । চারপাশে নোংরা আবর্জনা জমতে দেন না । ঝকঝকে করে রাখেন সবকিছু - যে অভ্যাসটা তাঁর গড়ে উঠেছিল জীবনসঙ্গীর সঙ্গে থাকার সুবাদে । তাদের স্মৃতি লালনপালন করার মধ্যে দিয়ে কবির সময় অতিবাহিত হয়ে যায় । ভালোবাসার ছোঁয়া অনুভব করেন তিনি ।


কবিকে জানাই আন্তরিক শুভকামনা !