(বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা হিন্দু ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য l কিন্তু এই পূজা অর্চনা বর্তমানে কেবল মন্ত্র উচ্চারণ ও আচার অনুষ্ঠান পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই l অনেকদিন থেকেই পূজা বহুবিচিত্র যুগোপযোগী উপাদান সহযোগে এক বর্ণাঢ্য উৎসবে পরিণত হয়েছে l জীবনের সব রঙকে ছুঁয়েছে পূজা l মানুষের যাবতীয় চাওয়া পাওয়া পূজার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে l ব্যবসা বাণিজ্যে জোয়ার আসে l পূজার প্রাক্কালে নতুন বস্ত্র কেনাবেচা হয় l ঘর দুয়ার পরিষ্কার হয় l পূজা উপলক্ষ্যে নতুন গান লেখা হয় l গাওয়া হয় l পত্রপত্রিকা পূজা সংখ্যা প্রকাশ করে l নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় l শিল্প প্রদর্শনী চলে l মেলা বসে l সমাজসেবামূলক কর্মসূচি নেওয়া হয় l থিম অর্থাৎ নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকসজ্জার আয়োজন হয় l ছুটি উপলক্ষ্যে আত্মীয়স্বজন সব এক জায়গায় একত্রিত হয় l হাসি, গান, গল্প, হইহুল্লোড়, ভূরিভোজ - সব কিছু মিলে পূজা এক মহা মিলনমেলা ও আনন্দমেলায় পরিণত হয়েছে l

ধর্ম সম্বন্ধে বলা হয় ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ রচনা করে l কিন্তু ধর্ম বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে পাশাপাশিও নিয়ে আসে l আজকের দিনে একটি ধর্মানুষ্ঠানের যে আয়োজন, তার যে প্রস্তুতি, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে যোগান ব্যবস্থা, তাকে ঘিরে যে ব্যবসা বাণিজ্য চলে, সেখানে নিয়োজিত থাকেন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বহু বহু মানুষ l এইভাবে ধর্ম বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে পরস্পর নির্ভরশীল করে পাশাপাশি নিয়ে এসেছে l


মালদার গ্রামাঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমার শিশুকালে কালীপূজা যেমন হতে দেখেছি, বর্তমান কবিতাটি তার একটি লেখচিত্র l আজকের দিনের এত জাঁকজমক তখন পূজাকে স্পর্শ করে নি l প্রত্যন্ত একটি গ্রামে, স্বল্প আয়োজনে, মনের উচ্ছ্বাস, উৎসাহে যেভাবে পূজা আয়োজিত হতো তার স্মৃতিকথা l
মালদায় গ্রামের দিকে একটি ছড়ার চল আছে l
"আশ্বিন মাসে মানুষ পাগল
টাকা দিয়ে কিনে ছাগল
নিজেই কাটে নিজেই খায়
মাটির ঠাকুরের নাম লাগায় l"
কবিতার শেষ দুই পঙক্তিতে তার প্রতিধ্বনি আছে l)


কালী পূজা


গ্রামের বাড়ীতে কালীর পূজাতে সেকালের আয়োজন
সারাদিন সেথা নাই মাথাব্যথা রাত্রিটা প্রয়োজন l
প্যান্ডেল নাই আলো রোশনাই প্রতিমার সমাগম
গ্রাম যেথা শুরু বট গাছ পুরু থান এক পাটাতন l
এদিকে গ্রামেতে ছেলেপুলে মাতে পটকায় দেয় রোদ
পাটকাঠি দোলে নারকেল খোলে মোমবাতি হয় যোগ l
কাগজ-কাঠিতে যায় সবে মেতে আকাশ-প্রদীপ গড়া
বাঁশ এক গেড়ে দড়ি খানা জুড়ে বংশ-প্রদীপ ওড়া l
ঘরে ঘরে রয় পাঁঠা নিশ্চয় অবিরাম তার সেবা
স্নান আয়োজন ঘষা-মার্জন লক্ লক্ করে জিহ্বা l
বাড়িতে বাড়িতে মাতা ভগিনীতে ডালপুরি আয়োজন
সবুরেতে থাকা পথ আঁকাবাঁকা তর্জন গর্জন l


রাতখানি যবে অনেকটা হবে ঢাক-ঢোল সাথে নিয়ে
পুরুতটা পাশে জোগাড়টা আসে কালী থানে বসে গিয়ে l
এক হ্যাজাকেতে এলাকাটা মাতে অবিরাম শোঁ শোঁ রব
হঠাৎ তা নিভে নিরুপায় সবে লন্ঠন আলো সব l
শোরগোল মাঝে ঢাক ঢোল বাজে কাঁসর ঘন্টা জোর
একটুখানিতে শত লোক জোটে পাঁঠা নিয়ে হুল্লোড় l গ্রামে কত লোকে বিদেশেতে থাকে পড়াশোনা কাজ নিয়ে
বাড়িতে সবাই মজা করে তাই পূজার ছুটিটা পেয়ে  l
স্মৃতি হাতড়ায় গল্পটা চায় ছুটে গেছে যাহা কিছু
আমদানি রসে আসরটা বসে বড়ো-ছোট পিছু পিছু l
বাজি পটকাতে ছেলে-পুলে মাতে আড্ডাটা জোরদার
পূজা শেষকালে বলিদান হলে ঘরে যায় যার যার l
রাতখানি জুড়ে হই-হুল্লোড়ে পাঁঠাখানি চলে ছিলা
অতি উৎসাহী মাংসের রাহী ভেজে খায় মেটেগুলা l


কালীর থানেতে আঁধার মাঝেতে শূন্য লোকের ভীড়
পূজা সাময়িক জোর সমধিক খানা-পানি সুনিবিড় l
পূজার মাসেতে উৎসাহে তেতে মানুষ কিনেছে পাঁঠা
বলি দিয়ে তায়, নিজেই তা খায়, ঠাকুরের নামে যা তা l