১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে রক্ত ঝরেছিল, তার কি পরিণাম হয়েছিল, আমরা জানি l ভাষা আন্দোলন, যা ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তা রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল l এবং তার পরিণতিতে বিশ্ব মানচিত্রে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদয় হয়েছিল l ভাষা আন্দোলনের এই সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দ্বারা এবং ২০১০ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ দ্বারা ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস  হিসাবে ঘোষণা করা হয় l আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধু বাংলা ভাষা বা বাংলাদেশের জন্য নয়, সকল দেশের সকল ভাষাভাষীর। তবুও দিবসটি পালনের জন্য যে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বেছে নেয়া হলো, তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ, বাংলা ভাষাভাষী মানুষ গর্ববোধ না করে পারেন না। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, এবং সফিক ভাই এর আত্মত্যাগের স্মৃতি অমর হয়ে আছে l


ভাষার ওপর আক্রমণের এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় l সভ্যতার শুরু থেকে সমৃদ্ধ জাতি ও তার ভাষা অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতি ও তার ভাষাকে গিলে খেতে চেয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রয়াস সফল হয়েছে l একটি বিজয়ী জাতি বিজিত জাতির ভাষাকে বিলুপ্ত করে তার নিজের ভাষাকে সেই জাতির ওপর আরোপ করেছে l নানা প্রলোভন, অর্থনৈতিক কারণ, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বিজিত জাতি নিজ ভাষাকে ত্যাগ করে বিজয়ী জাতির ভাষাকে বরণ করে নিয়েছে l এভাবে পৃথিবীতে বহু ভাষার বিলোপ হয়েছে l একটি ভাষার বিলোপ মানে একটি সংস্কৃতির বিলোপ, একটি জাতিসত্তার মৃত্যু l বলা হয়, একটি পরাধীন জাতি যতক্ষণ তার মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থাকে, সেই জাতির স্বাধীন হবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল থাকে l যখনই একটি জাতি তার মাতৃভাষাকে ত্যাগ করে বিজয়ী জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে বরণ করে নেয়, তার নিজস্ব জাতিসত্তা বিলুপ্ত হয় l তাদের পরাধীনতা চিরস্থায়ী হয়ে যায় l বিজয়ী জাতি তাদের গ্রাস করে l


আন্তর্জাতিক পটভূমিতে ভাষা আগ্রাসনের এই রূপ দেখি যখন রোমান সাম্রাজ্যের প্রসার হয় l রোমানদের ভাষা ছিল লাতিন ও গ্রীক l ইতালি ও গ্রীসের কয়েকটি প্রদেশে এই ভাষা সীমাবদ্ধ ছিল l খৃষ্টপূর্বাব্দে যখন রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার হলো, রোমান ভাষা লাতিন নিজের একাধিপত্য বজায় রাখতে বিজিত বহু জাতির ভাষাকে বিলুপ্ত করল l রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে বৃটেনে একের পর এক জার্মান উপজাতি হানা দিয়েছে এবং তাদের নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিজিত জাতির ওপর আরোপ করেছে l অষ্টম শতাব্দীতে একইভাবে স্ক্যানডেভিয়ানরা এসেছে l বৃটেনের যে নিজস্ব ভাষা, কেল্টিক ভাষা, তা বিলুপ্তির পথে গেছে l ১০৬৬ সালে নর্মান বিজয় l ফ্রান্সের নর্মান্ডি প্রদেশের ডিউক উইলিয়াম শেষ আংগল স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ডকে পরাজিত করে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসলেন l শুরু হলো আংগল স্যাক্সন ইংরাজী ভাষার ওপর ফরাসি ভাষার আগ্রাসন l এই সমস্ত আগ্রাসন সামলে, সব অন্য ভাষাকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ নতুন রূপে ইংরাজী ভাষা আত্মপ্রকাশ করে l আরো পরে সাম্রাজ্যবাদের যুগে অন্য বহু ভাষার সংস্পর্শে এসে ইংরাজী ভাষার শব্দভাণ্ডার যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনই বিজয়ী জাতি ইংরেজ তার নিজের ভাষা উপনিবেশগুলির ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন l ফলে উপনিবেশগুলির বহু বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে এবং বিলুপ্তির পথে রয়েছে l একই আক্রমণ এসেছে পর্তুগিজ, ফরাসি প্রভৃতি অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের ভাষা থেকে l
বিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশগুলি অধিকাংশই স্বাধীনতা পেয়েছে l কিন্তু দুর্বল ভাষার ওপর সমৃদ্ধ ভাষার এই আক্রমণ, সন্ত্রাস অব্যাহত আছে l


আন্তর্জাতিক পটভূমি থেকে সরে এসে ভারতের জাতীয় প্রেক্ষাপটে যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখবো, ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষীরা এই ভাষা সন্ত্রাসের শিকার l এখানে আক্রমণ এসেছে মূলত হিন্দি ও ইংরাজী ভাষা থেকে l হিন্দি রাষ্ট্রভাষা, ইংরাজী সংযোগকারী ও জীবিকার ভাষা l ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি প্রশ্নে অন্য ভাষাগুলি বিপন্নতা বোধ করছে l দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ ভাষা তামিল, তেলেগু, কন্নড়  এই ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে l ভারতের মতো বহুভাষাভাষী দেশে সংযোগকারী ভাষা হিসাবে ইংরাজীকে তাঁরা গ্রহণ করেছেন l তাঁদের লড়াই মূলত হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে l এই লড়াই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাঁরা নিজ নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং নানাভাবে, সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতি চর্চা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রয়োজনে ভাষার আধুনিকীকরণ প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন l


এবার ভারত রাষ্ট্রের জাতীয় পটভূমিতে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা যেভাবে সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের শিকার হয়েছে সে প্রসঙ্গে আসি l ভারতের বিভিন্ন অংশে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন শুরু করে।


দেশভাগ থেকে তার শুরু l ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান তৈরি হয় l মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে এবং হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা ভারতে যোগ দেয়। পশ্চিম বাংলা থেকে বাঙালি মুসলমানেরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশে এবং বাঙালি হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু ও ছিন্নমূল এই সব হিন্দু বাঙালিরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেন। ভারতের বাঙালি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অন্যান্য অবাঙালী জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়। আসাম, বিহার, ছত্তিশগড় (দণ্ডকারণ্য), ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এই রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম। পুনর্বাসিত এই সকল হিন্দু বাঙালিরা অবাঙালী অধ্যুষিত এই সকল রাজ্যে নানা বৈষম্যের স্বীকার হন l মাতৃভাষা বাংলার পঠনপাঠন ও সরকারি মর্যাদার দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে নামেন l


ক) অসম - অসমের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যদিও জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বাংলাভাষী। বরাক উপত্যকায়, বাংলাভাষী জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রধান ঘটনাটি ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঘটে, সেদিন ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচরে প্রাদেশিক পুলিশ হত্যা করে l আন্দোলন তীব্র আকার নেয় l শেষ পর্যন্ত অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।


খ) বিহার - বিহারের মানভূম জেলায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল সাময়িক ভাবে নতুন জেলা গঠনের (পুরুলিয়া জেলা) মাধ্যমে সেই আন্দোলনকারীদের দাবি মিটে গেলেও ভাষা আন্দোলন আজও বিদ্যমান।


গ) উড়িষ্যা - ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর পূর্ব বাংলার হিন্দু উদ্বাস্তুদের উড়িষ্যার বিভিন্ন গ্রামে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে বাঙালিদের বাংলায় পঠনপাঠন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় রাজ্য  সরকার বাংলায় শিক্ষার ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিকে হিন্দি মাধ্যমে রূপান্তর করা হয়। সামান্য কিছু বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে বাংলা মাধ্যম পুস্তক সরবরাহ করা হয় নি। বাঙালি পড়ুয়ারা বৈষম্যের মুখোমুখি হয়। পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। পরে নিখিল ভারত বাঙালি উদ্বাস্তু সমিতির নেতৃত্বে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলায় পঠনপাঠন এবং সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। রাজধানী দিল্লিতে পর্যন্ত তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সাময়িক কিছু সমস্যার সমাধান হলেও বাকি দাবিতে সংগ্রামকারীরা আজও আন্দোলনরত।


ঘ) কর্ণাটক - পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দুদের এক অংশ দক্ষিণাত্যের কর্ণাটক রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়। সেখানের বাঙালি পড়ুয়াদের বাংলায় পাঠনপাঠনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বাংলা মাধ্যমের দাবিতে ও বাংলা ভাষাকে পাঠ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করার জন্য কর্ণাটকের বাঙালিরা আন্দোলন করেছিল। তাঁদের আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে বাঙালি অধ্যুষিত গ্রাম গুলিতে বাংলা পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করে কর্ণাটক সরকার এবং বাংলাকে কর্ণাটকের দ্বিতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেয়।


ঙ) ঝাড়খন্ড - ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গের শুধু প্রতিবেশী রাজ্যই নয়, প্রাচীন বঙ্গের পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলের অংশবিশেষ এই রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই রাজ্যের একাধিক জেলায় বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জেলাগুলি পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। বর্তমানে ঝাড়খন্ডের জনসংখ্যার ৪২% বাঙালি, যা একক ভাবে ওই রাজ্যের বৃহত্তম জাতি। এছাড়াও বাংলা ঝাড়খন্ডের বাঙালি ও উপজাতিদের  সংযোগকারী ভাষা। কিন্তু, হিন্দি, ইংরেজি ও উর্দু এই রাজ্যের প্রধান সরকারি ভাষার মর্যাদা পেলেও বাংলা আজও প্রধান সরকারি ভাষার মর্যাদা পায় নি। ঝাড়খন্ডের একাধিক বাঙালি সংগঠন ও উপজাতি সংগঠন বাংলাকে প্রধান সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবিতে দীর্ঘদিন সাংগ্রামরত। ঝাড়খণ্ডে বাঙালিদের আন্দোলনের চাপে ২০১০ সালে বাংলাকে এই রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, তা কার্যকরী হয় নি। এছাড়াও বাঙ্গালাভাষী পড়ুয়ারা বঞ্চনার স্বীকার হয়েছে, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিকে হিন্দি মাধ্যমে রূপান্তর করা হয়েছে l


চ) দিল্লি - ১৯৪৭ এর ভারত ভাগ ও ১৯৭১ এর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু হিন্দুরা ভারতে রাজধানী দিল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিলো। এই সময় দিল্লিতে তাঁদের মূল বাসভূমি ছিল চিত্তরঞ্জন পার্ক। এছাড়াও বিভিন্ন সময় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও ভারতের অন্যান্য বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য থেকে বাঙালিরা দিল্লিতে আসায় পাঞ্জাবীদের পর বাঙালিই দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যালঘু জাতি। ভারতের জনগণণা অনুযায়ী দিল্লিতে আনুমানিক ২৫ লক্ষ বাঙালির বাস। কিন্তু সেখানেও বাঙালিরা বৈষম্যের স্বীকার। দিল্লিতে অন্যান্য ভাষার নিজেস্ব একাডেমি থাকলেও বাংলা ভাষা একাডেমি নেই। বাঙালি পড়ুয়াদের জন্য বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় নগন্য। কাজেই দিল্লির বাঙালিরা ভাষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত। বাঙালিদের আন্দোলনের জেরে বর্তমানে দিল্লিতে একটি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছ l


Ethnologue - ভাষার ওপর এই আগ্রাসন বিশ্ব জুড়ে চলছে l Ethnologue (বিশ্বে প্রচলিত মাতৃভাষাগুলির Catalogue) অনুসারে বিশ্বে প্রায় ৭০০০ মাতৃভাষা আছে l ভাষাবিদরা বলছেন আগামী ১০০ বছরে এর অর্ধেক সংখ্যক ভাষা extinct অর্থাৎ বিলুপ্ত হয়ে যাবে l


একটি ভাষা সম্বন্ধে কখন আমরা বলি যে সেই ভাষাটি endangered অর্থাৎ বিপন্ন হয়েছে ?
ক) সেই ভাষায় কথা বলার লোক যখন কমে আসে l
খ) অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রলোভনে সেই ভাষাভাষীরা অন্য ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেন l
গ) পরবর্তী প্রজন্ম প্রথম ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষা হিসাবে সেই ভাষা শেখে না l
ঘ) সরকারি কাজে, পঠন পাঠনে সেই ভাষার ব্যবহার থাকে না বা কমতে থাকে l
ঙ) সেই ভাষায় সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা হয় না l


একটি ভাষা endangered কি না, সেটা নির্ণয়ে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয় l গুরুত্বপূর্ণ হলো পরবর্তী প্রজন্মে সেই ভাষা Traansmission বা সঞ্চারণ হচ্ছে কি না l ইন্দোনেশিয়াতে এমন ভাষা আছে, ২০ লক্ষ লোক সেই ভাষায় কথা বলেন l কিন্তু তাঁরা বয়স্ক l নতুন প্রজন্ম আর সেই ভাষা শিখছে না l এটি endangered ভাষা l কিন্তু লাডিন (Dolomite in Italy) ভাষায় মাত্র ৩০০০০ লোক কথা বলেন l কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম মাতৃভাষা হিসাবে সেই ভাষা শিখছে l অতএব এটি endangered ভাষা নয় l হাওয়াই (উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একটি দ্বীপ) ভাষায় মাত্র ১০০০ বক্তা l কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ সংখ্যাটি স্থির l নতুন প্রজন্ম এই ভাষা শিখছে l শিক্ষার মাধ্যম এই ভাষা l তাই এটিও endangered ভাষা নয় l


UNESCO একটি ভাষার Safe এবং Extinct এর মাঝে Endangerment এর চারটি স্তর নির্দেশ করেছে l
ক)  Vulnerable  - যখন শিশুরা গৃহপরিবেশের বাইরে সেই ভাষা ব্যবহার করছে না l
খ) Definitely Endangered - শিশুরা সেই ভাষা ঘরে বাইরে কোথাও বলছে না l
গ) Severely Endangered - কেবলমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিরা সেই ভাষায় কথা বলছেন l নতুন প্রজন্ম নয় l
ঘ) Critically Endangered - বয়স্ক ব্যক্তিদের সকলে নয়, মাত্র কয়েকজন সেই ভাষায় কথা বলছেন l
UNESCO এর মতে বিগত তিনটি প্রজন্মে প্রায় ২০০ টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে l


কখন আমরা বলতে পারি যে একটি ভাষা safe অর্থাৎ নিরাপদ ?
ক)সেই ভাষায় প্রচুর মানুষ কথা বলেন, অর্থাৎ এটি তাঁদের মাতৃভাষা l
খ) মাতৃভাষা নয় এমন বহু ব্যক্তি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে সেই ভাষা ব্যবহার করেন l অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা অর্জন প্রভৃতি কারণে এটি হতে পারে l
গ) সরকারি স্বীকৃতি l অর্থাৎ সরকারি কাজে সেই ভাষার ব্যবহার l
ঘ) একাধিক দেশে সেই ভাষার সরকারি স্বীকৃতি l বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগকারী ভাষা হিসাবে মর্যাদা প্রাপ্তি l
ঙ) ভাষার বিভিন্ন register l অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহারের সামর্থ্য l
চ) বিদেশে "বিদেশী ভাষা" হিসাবে পঠনপাঠনের সুযোগ l
ছ) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে, আন্তর্জাতিক সংস্থায় সেই ভাষার ব্যবহার l
জ) সেই ভাষায় শিক্ষাক্রম পরিচালনা l
ঝ) সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা l


২০১৫ সালে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বিশ্বে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে ব্যবহার করেন এমন প্রথম সাতটি ভাষা হলো :  
১ - চীনা ভাষা (১২০ কোটি),
২ - স্প্যানিশ (৪০ কোটি),
৩ - ইংরাজি (৩৩কোটি ৫০ লক্ষ),
৪ -  হিন্দি (২৬ কোটি,
৫ - এরাবিক (২৪ কোটি)  
৬ -  পর্তুগিজ (২০ কোটি)  
৭ - বাংলা (১৯ কোটি) l
এর মধ্যে আকর্ষণীয় বিষয় হলো চীনা ভাষা চীনদেশের মাতৃভাষা l এছাড়া তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও আমেরিকায় অন্যতম সরকারি ভাষা l


স্প্যানিশ ভাষা স্পেনের ভাষা হলেও সর্বাধিক স্প্যানিশভাষী আছেন মেক্সিকোতে, প্রায় ২৫ শতাংশ l এছাড়াও কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে এই ভাষা ব্যবহারকারী আছেন l অর্থাৎ স্প্যানিশ ভাষা ঐ দেশগুলিতে আগ্রাসীর ভূমিকা নিয়েছে l


সবথেকে আগ্রাসী ভাষা হলো ইংরাজি l এটি magpie ভাষা, অর্থাৎ অন্য বহু ভাষার শব্দভাণ্ডারে সমৃদ্ধ l খোদ ইংল্যান্ডে ইংরাজী মাতৃভাষা ৫ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের l আমেরিকায় এই সংখ্যা ২২ কোটি ৫০ লক্ষ l এছাড়াও কানাডা (২ কোটি), অস্ট্রেলিয়ায় (১ কোটি ৫০ লক্ষ) ইংরাজি মাতৃভাষা l ইংরাজী সর্বাধিক বিস্তৃত ভাষা l পৃথিবীর ৯৪ টি দেশে ইংরাজি সরকারি ভাষা l এছাড়াও বহু দেশে ইংরাজি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃত l অষ্টাদশ শতকে অস্ট্র্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের পর ইতিমধ্যে দেশটির ২৫০টি অর্থাৎ ৯০ শতাংশ ভাষার বিলুপ্তি ঘটেছে। ইংরাজি ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে ভাষা খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষার আগ্রাসনের শিকার হয়ে প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছিল, সেই ভাষা চতুর্দশ শতকে আগ্রাসী সকল ভাষা থেকে জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে, সেই ভাষাগুলিকে আত্মস্থ করে শক্তিশালী ভাষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে ইংরেজ জাতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হবার কারণে উপনিবেশগুলির ওপর ভাষা আগ্রাসন শুরু করে l


পৃথিবীর ২৬ কোটি হিন্দি ভাষাভাষী মানুষের বাস ভারত ও নেপালে l


চীনা ভাষার মতো এরাবিক একটি Microlanguage l অর্থাৎ এই ভাষাগুলির অনেক variety আছে l প্রায় ৬০ টি দেশে আরবী ভাষা প্রচলিত আছে l


পর্তুগিজ ভাষার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এটি খোদ পর্তুগালে মাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা, যেখানে ব্রাজিলে প্রায় ১৯ কোটি মানুষের l উপনিবেশ শাসনের সুবাদে ব্রাজিলে পর্তুগিজ ভাষার আগ্রাসনের এটি একটি উদাহরণ l ১৫৩০ সালে পর্তুগিজরা ব্রাজিলে উপনিবেশ স্থাপনের পর এখন পর্যন্ত দেশটির ৫৪০টি বা ৭৫ শতাংশ ভাষার অপমৃত্যু ঘটেছে।


এবার আমাদের মাতৃভাষা বাংলা l ভারতে হিন্দির পরে বাংলা ভাষায় সর্বাধিক মানুষ কথা বলেন l ভারতে প্রায় ৮ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা l পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, কর্ণাটক এবং অন্য প্রদেশে বাঙালিদের বাস আছে l
কিন্তু বিশ্বে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা আছেন বাংলাদেশে - প্রায় ১০ কোটি ৬০ লক্ষ l


জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা নানাবিধ মজার তথ্য দিয়েছে ভাষা সম্পর্কে। ইউনেস্কো বলছে, প্রচলিত হাজার ছয়েক ভাষার মধ্যে কোনো কোনো দেশে প্রচলিত আছে একাধিক ভাষা। আবার এমন দেশও আছে বৈকি, যাদের কোনো মাতৃভাষা নেই। যেমন তাইওয়ান l প্রতিনিয়ত অযত্ন, অবহেলা ও সংগ্রহের অভাবে ভাষার মৃত্যু ঘটছে। আবার আগ্রাসী ভাষার হুমকির মুখে পড়ে, যাকে বলে আগ্রাসন, কোনো কোনো ভাষার চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে, রূপ বদল হচ্ছে। ছয় হাজার ভাষার মধ্যে ৯৬ শতাংশ ভাষা ব্যবহার করে মাত্র ৪ শতাংশ লোক। ইন্টারনেট সার্চ করলে ৯০ শতাংশ ভাষার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। আফ্রিকার ৮০ শতাংশ ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপ পাপুয়া নিউগিনির ৫০ লক্ষ মানুষ কথা বলে ৮২০ রকম ভাষায়। ইন্দোনেশিয়ার মানুষ কথা বলে ৭৪২টি ভাষায়। নাইজেরিয়ার মানুষ ৫১৬টি ভাষায় এবং ভারতে ব্যবহৃত হয় ৪২৭টি ভাষায়।


একটি কথা বলে শেষ করব, একটি ভাষা বিপন্ন দুদিক থেকে হয় l এক, অন্য একটি ভাষা দ্বারা l দুই, নিজ ভাষীদের অবহেলা ও উপেক্ষা দ্বারা l ভাষার যে সম্পদ ও শক্তি দিয়ে অন্য একটি ভাষা আগ্রাসন করছে, নিজের ভাষার মধ্যে সেই শক্তি সঞ্চার করতে হবে l শুধু ভালবাসা দিয়ে একটি ভাষাকে বাঁচানো যায় না, তাকে শক্তিশালী করতে হয় l


কি করতে পারি আমরা ?
ক) পরবর্তী প্রজন্মকে মাতৃভাষায় পাঠ দেয়া l
খ) মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগী হওয়া l
গ) সরকারি কাজে মাতৃভাষার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা l
ঘ) মাতৃভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চাকে উৎসাহিত করা l বই কিনে প্রকাশনা শিল্পকে উত্সাহ দেয়া l
ঙ) প্রযুক্তির ব্যবহারে মাতৃভাষাকে সংযুক্ত করে তাকে সদা সর্বদা প্রাসঙ্গিক করে তোলা l
চ) দৈনন্দিন নানা কাজে, অনুষ্ঠানে, দোকানের নামকরণে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা l
ছ) সংকীর্ণতা নয়, বিভিন্ন সমৃদ্ধ ভাষার সঙ্গে সংযোগ ও আদান প্রদানের মাধ্যমে নিজ ভাষাকে সমৃদ্ধতর করে তুলতে হবে l

প্রতিনিয়ত ভাষাচর্চার ব্যাপারটা অব্যাহত রাখতে হবে। ভাষা হলো বহতা নদীর মতো। তার মুখে পলিমাটি জমতে দেয়া যাবে না l


**
দৈনিক "উত্তরবঙ্গ সংবাদ" পত্রিকায় উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় ২২-০২-২০১৮ তারিখ প্রকাশিত l সম্পাদিত l