মা - একটি শব্দ, আপনত্ব বোঝাতে এর থেকে শক্তিশালী শব্দ অভিধানে নেই l ছোট্ট শব্দ, কিন্তু তার অভিমুখ অনেক l সাহিত্য জীবনের দর্পন, মা জীবনের রূপকার l সুতরাং মা - কে নিয়ে সাহিত্য রচিত হবে এটা খুবই স্বাভাবিক l বস্তুতঃ যত রকমের শিল্পমাধ্যম আছে সর্বত্র মায়ের চিত্রণ দেখতে পাই l সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখি দেশকাল নির্বিশেষে মা সকল রকমের সাহিত্যমাধ্যমে উপস্থিত তাঁর বহুমুখী ভূমিকা নিয়ে l মা-কে নিয়ে রচিত সাহিত্যে উভয়রকম রচনাই দেখি l এক, মায়ের প্রশস্তি l দুই, বস্তুনিষ্ঠ মন নিয়ে বিশেষ জটিল পরিস্থিতিতে মায়ের বাস্তব চিত্রণ l


মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পর্কের নাম l তাঁকে নিয়ে কতো যে কবিতা লেখা হয়েছে নানা ভাষায় তার কোনো সীমা নেই l কবিতাগুলিতে ফুটে উঠেছে মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ, অনুভুতি, আবেগ, সম্মান, পরিবারে তাঁর মর্যাদা, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি l


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'শিশু ভোলানাথ' কাব্যগ্রন্থে 'মনে পড়া' কবিতায় এক মা হারা কিশোরের কথা বলেছেন,
"মাকে আমার পড়ে না মনে।
          শুধু কখন খেলতে গিয়ে
                   হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
          কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন
          আমার খেলার মাঝে।"


কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'জননী জন্মভূমি' রচনায় বলছেন,
"আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে -কখনও মুখ ফুটে বলি নি।"


কবি কাজী কাদের নেওয়াজ 'মা' শীর্ষক কবিতায় বলছেন,
"মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর তিন ভুবনে নাই।"


কবি রেদোয়ান মাসুদ 'আমার মা" রচনায় বলছেন,
"মায়া ভরা হৃদয়টি যার সে আমার মা।
কত স্নেহ করতো আমায় মনে পড়ে তা।
মনে কোন কষ্ট থাকলেও বুঝতে দিত না।
হাসি ভরা মুখটি তার দেখলে জুড়াত গা।"


সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানের বস্তুনিষ্ঠ চিত্র এঁকেছেন
"আমাদের মা" শীর্ষক লেখায়,
"আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি। আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে, কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা। আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি। আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান। ..."


পৃথিবীর সেরা মহাকাব্যগুলিতে মায়ের চিত্রণ দেখি l মহাকাব্যগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো একটি নারীকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হচ্ছে l ইলিয়াড মহাকাব্যে হেলেনকে কেন্দ্র করে গ্রীকদের সঙ্গে ট্রোজানদের যুদ্ধ হয়, পরিণতিতে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয় l এই মহাকাব্যে হেলেনকে মা হিসাবে নয়, পাই প্রেমিকা হিসাবে l ওডিসি মহাকাব্যের শেষ অংশে যেখানে ওডিসিয়াস মারা গেছে ধরে নিয়ে তার স্ত্রী পেনেলোপীকে বিয়ে করার জন্য কতিপয় যুবক ব্যস্ত হয়ে ওঠে, ছেলের কথা চিন্তা করে পেনেলোপী সেই বিয়ে আটকানোর জন্য নানা কৌশল করেন, তখন তার মধ্যে মহান মাতৃসত্ত্বার রূপটি ফুটে ওঠে l 'রামায়ণ' মহাকাব্যে মা সম্পর্কটির নানা অভিঘাত দেখি l কৈকেয়ী তার নিজের পুত্র ভরতকে রাজা করার মানসে সতীন কৌশল্যার পুত্র রামকে চৌদ্দ বছর বনবাসে পাঠাতে সফল হন l আবার স্বামী রাম দ্বারা পরিত্যক্ত অবস্থায় বাল্মীকি মুনির আশ্রমে থেকে সীতা নিজের দুই পুত্র লব এবং কুশকে সর্বগুণে গুণান্বিত, সর্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন l সীতার এই ভূমিকায় সর্বযুগের মহান মাতৃত্বের রূপ ফুটে ওঠে l
'মহাভারত' মহাকাব্যে মাতৃত্বের নানা রূপ দেখি l কুন্তী বিবাহপূর্ব সম্পর্কে সন্তান ধারণ করেন l লোকলজ্জার ভয়ে সেই সন্তান কর্ণকে তিনি নদীর জলে ভাসিয়ে দেন l পরে ঘটনাচক্রে সেই কর্ণ যখন বড়ো হয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কুন্তীপুত্র পঞ্চপাণ্ডবের বিপদ হয়ে দেখা দেন, তখন রাতের অন্ধকারে পঞ্চপাণ্ডবের প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে কুন্তী কর্ণের কাছে উপস্থিত হন l নিজের পরিচয় দেন, কর্ণ তারই সন্তান এই সত্য প্রকাশ করেন, তাকে নানা প্রলোভন দেখান l মহাবীর কর্ণ সেই সকল প্রলোভন পায়ে ঠেলে দেন, কিন্তু আবেগ ও ভালোবাসার জালে কর্ণের কাছ থেকে পঞ্চপাণ্ডবের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে কুন্তী সক্ষম হন l কুন্তীচরিত্রের মধ্যে এমন এক মাকে আমরা পাই যিনি মায়ের কর্তব্য পালনে সব সন্তানের প্রতি সমবিচার করেন নি l ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের এই বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "কর্ণকুন্তী সংবাদ" কবিতাটি অসাধারণ রচনা করেছেন l তুলনায় এই মহাকাব্যে গান্ধারীর ভূমিকা অনেক উজ্জ্বল l তিনি একজন নীতিপরায়ণ আদৰ্শ মা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, নিজের সন্তানের দোষ অপরাধকে ক্ষমা করেন নি, আবার পাণ্ডবেরা অন্যের সন্তান হলেও তাঁর স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হন নি l  


মা- কে নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই বহু গল্প উপন্যাস নাটক রচিত হয়েছে l চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে । একটি গল্পে পাই এক প্রেমিক তার প্রেমিকার প্ররোচনায় মাকে হত্যা করে যখন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে, সে শুনতে পায় তার মা তাকে যেন বলছে, "আহা রে খোকা, তোর লাগে নি তো ?" এই হলেন মা l একটি প্রবাদ আছে, "কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়" l মায়েরা সব অবস্থাতেই সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন l বিশ্ব জুড়ে সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে এই মহান সত্যটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে l বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আহবান’ গল্পে জমির করাতির বউকে অসাম্প্রদায়িক, মমতাময়ী মা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন যার মৃত্যুর সময় সেই মমতাবোধ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতার বন্ধন সৃষ্টি করেছে l


আমরা ফিরে দেখি মা- কে নিয়ে লেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির দিকে l 'মা' উপন্যাস রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা l বিশ্বসাহিত্যে সম্ভবত সবচেয়ে পঠিত উপন্যাস। রাশিয়ার বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে এক শ্রমিক পরিবারের নারী চরিত্রের চিত্রণ এই উপন্যাস l ছেলে প্যাভেল ও তার বন্ধুদের বিপ্লব, সংগ্রামকে সমর্থন করেন এই মা l ছেলে প্যাভেল কারারুদ্ধ হন। মা আন্দোলন জারি রাখতে রুটির সাথে বিলি করেন আন্দোলনের ইশতেহার। এক সাধারণ মা নির্যাতিত মানুষের বাঁচার আশ্রয়স্থল হয়ে সর্বজনীন মা হয়ে ওঠেন।


বের্টোলেট ব্রেশট এর একটি লেখায় এক মা-কে পাই যাঁর ব্যাপক পরিচিতি মাদার কারেজ হিসাবে l   তাঁর খাবারের গাড়ি জীবিকার একমাত্র সম্বল। সংসারে আছে একটি রোগা মেয়ে আর দুই ছেলে। তিন সন্তানের বাবা তিনজন। তিনজনকে বাঁচাতে মরিয়া তিনি। বাঁচার লড়াইয়ে যুদ্ধ পরিবেশের মধ্যেও তিনি এগিয়ে যান l যুদ্ধের এ সময় পার করতে হয় মাদার কারেজকে। কলকাতার প্রাবন্ধিক সুমিতা চক্রবর্তী এই মাকে 'হিম্মৎমাই' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।


বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত ‘জননী’ মাকে নিয়ে একটি উপন্যাস l নিরুপায় জননী শত চেষ্টা করেও ধনীর লালসার শিকার এড়াতে পারেনি। সন্তান বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আত্মহত্যা করে। জননীর ঘর ভেঙে যায়।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'জননী' এক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। শ্যামা নামে এক গৃহবধূর জননী সত্ত্বার বহুবিধ আত্মপ্রকাশ এই উপন্যাসের উপজীব্য । উপন্যাসে লেখক জননী চরিত্রটিকে স্বর্গীয় বা দৈবিক মহিমায় ভাস্বর করেননি। বরং এক জননীর কাহিনী বাস্তবতার আয়নায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে শ্যামার কিশোরী বধূ থেকে পুরোদস্তুর গৃহিনী ও জননী হয়ে ওঠার গল্প তুলে ধরা হয়েছে সুনিপুণভাবে। এছাড়া আছে সংসারে স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন, মানসিক দ্বন্দ্ব, আর্থিক টানাপোড়েন, স্বার্থপর-স্বার্থহীন সম্পর্ক, মানুষের চারিত্রিক রহস্যময়তা, বাস্তবতার কাছে স্বপ্নের পরাজয়ের কাহিনী ইত্যাদি প্রসঙ্গ ।


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস 'পথের পাঁচালি'' l এ উপন্যাসের একটি মনে রাখার মতো চরিত্র হলো সর্বজয়া। অনেক কষ্টে অপু আর দুর্গার খাদ্য জোগাড় করেন তিনি। তবে সর্বজয়ার কাছে দুর্গার চেয়ে অপুর কদর বেশি। কষ্ট করে জমানো টাকা দিয়ে অপুকে কলকাতায় পাঠান পড়াশোনার জন্য l


বাংলাসাহিত্যে গর্ভধারিণী মা এবং পালিত মা নানা অভিমুখে উপস্থাপিত l স্নেহ-মায়া-মমতার প্রকাশে কেউ কম নন। অনুরূপা দেবীর ‘মা’ উপন্যাস এমনই এক দৃশ্য তুলে ধরে। অরবিন্দের দুই স্ত্রী মনোরমা ও ব্রজরানী l উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে ক্ষুব্ধ ব্রজরানীর হৃদয় শান্ত হয় মনোরমার পুত্রের 'মা' সম্বোধনে । গর্ভধারিণী নন কিন্তু মা, এমন চরিত্র অঙ্কনে শরৎচন্দ্র অনন্য l 'বিন্দুর ছেলে', 'রামের সুমতি' গল্প তার উদাহরণ l


বনফুলের মজার একটি গল্প ‘গণেশ জননী' l মধ্যবিত্ত এক দম্পতি একটি বাচ্চা হাতি পুষেন। ঘটনাচক্রে সে এক ঝুড়ি আম খেয়ে ফেলে। ‘আমাদের জন্য দুটোও রাখনি’, মানুষ মায়ের বকুনিতে বাচ্চা হাতিটি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয় । মানুষ মা লেবুর রস করে বাচ্চা হাতিকে অনুনয় করে বলেন, "একটুখানি খাও না লক্ষ্মীটি।"


মাকে বিষয় করে অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে l ‘সারোগেট মাদার’ নামে একটি কোরিয়ান ছবি আর ‘স্টেপ মম’ নামে এক হলিউড ছবিতে সৎমা হয়ে ওঠেন মমতাময়ী মা। বাংলাদেশের ‘সত্যমিথ্যা’,  ‘সবার ওপরে মা’ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে মাকে বিষয় করে l বলিউড ছবি ‘মাদার ইন্ডিয়া’, টালিগঞ্জের ছবি "উনিশে এপ্রিল" ছবিগুলোতে মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক নিরুপনে জটিলতর আর্থসামাজিক, নৈতিকতার নিরিখে আধুনিকতার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।


মা এক অনন্য সম্পর্কের নাম l শিশু যখন কিছু বুঝে না, কিছু ব্যক্ত করতে পারেনা, কোনো শক্তি নেই, ক্ষুধা পেলে শুধু কান্নাই যার ভাষা, এমন একটি শিশুকে হাজারো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে যিনি  লালন-পালন করে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন সেই মমতাময়ী নারী হলেন মা। জগৎ সংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে যে মানুষটির একটু সান্ত্বনা আর স্নেহ- ভালোবাসা আমাদের সমস্ত বেদনা দূর করে দেয় তিনি হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই । মা মানে একরাশ অন্ধকারে এক বুক ভালবাসা l ছোট্ট শিশুর প্রথম ভালবাসা, নিরাপত্তা আর মমতায় গড়া মায়ের কোল, সেই উষ্ণতার পরশে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে চায় মন। পৃথিবীজোড়া সব ভাষার সাহিত্যের নানা শাখায় এই মাকে নানারূপে আমরা খুঁজে পাই l


** ভয়েস সাহিত্য পত্রিকা শারদ সংখ্যা ১৪২৮ এ প্রকাশিত, পৃষ্ঠা - প্রবন্ধ ৩৪