কোনো ভাষাতেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা চিরকাল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না l একভাবে চলতে চলতে একঘেয়েমি আসে l স্বাদ পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়ে l আর সমাজব্যবস্থা, সাহিত্য সংস্কৃতিকে যার দর্পণ বলা হয়, সেই সমাজেও তো কতো পরিবর্তন হয়ে যায় l এই পরিবর্তনের আঁচ তার দর্পণে প্রতিফলিত হতে বাধ্য l প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি উভয় দিক থেকেই ক্রিয়াশীল অর্থাৎ vice versa l ছিয়াত্তরের মন্বন্তর যেমন "আনন্দমঠ" সৃষ্টি করে, তেমনই রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেস্কুর হৃদয়স্পর্শী লেখা  ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত করে l
যদিও পুরোপুরি ঠিক দর্পণ নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বলা যেতে পারে "Tempered Mirror" অর্থাৎ কি না লেখক-কবি-শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ অনুযায়ী পরিবর্তিত দর্পণ l এখানেই ইতিহাসের সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতির পরিবর্তন সূচিত হয় l
বাংলা সাহিত্যকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয় - আদি,  মধ্য ও আধুনিক l
আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ (আনুমানিক ৬৫০ খ্রি. মতান্তরে ৯৫০ খ্রি.–১২০০ খ্রি.)
মধ্যযুগ (১২০১ খ্রি.–১৮০০ খ্রি.)
আধুনিক যুগ (১৮০১ খ্রি.–বর্তমান কাল)
আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ :
চর্যাপদ : বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ । খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যাপদের ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।
গীতগোবিন্দম্: কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যে এই কাব্যের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী l এমনকি রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে রচিত কাব্যেও জয়দেবের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর।
মধ্যযুগ :
খনার বচন : খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া। আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। অজস্র খনার বচন যুগ-যুগান্তর ধরে গ্রাম বাংলার জনজীবনের অঙ্গ l
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন : বিদ্যাপতি ও বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন মূলত গীতধর্মী কবিতার সংকলন যা বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলি নামে পরিচিত l মিথিলার মহান কবি বিদ্যাপতির কবিতা যদিও বাংলা ভাষায় লিখিত হয়নি তথাপি এটি বাংলা সাহিত্যকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে এটি মধ্য-বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হয় l তাঁর বৈষ্ণব গান বাংলার জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন প্রথম প্রধান বাঙালি কবি যিনি বৈষ্ণব গান লিখেছিলেন। চণ্ডীদাস তাঁর মানবিক এই ঘোষণার জন্য সুপরিচিত - "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই"।
শ্রীকৃষ্ণ বিজয় : এটি হল ভগবৎ পুরাণের আংশিক অনুবাদ যা মালাধর বসু কর্তৃক রচিত l ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে রচিত শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ছিল কৃষ্ণের কিংবদন্তীর প্রাচীনতম বাংলা বণর্নামূলক কবিতা।
রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ : মূল সংস্কৃত থেকে কৃত্তিবাস ওঝা বাল্মীকির রামায়ণ ও কাশীরাম দাশ ব্যাসদেবের মহাভারত অনুবাদ করেন l
চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব সাহিত্য :
বৈষ্ণব পদাবলী : চৈতন্যের জীবনের উপর ভিত্তি করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব পণ্ডিত বা কবিদের দ্বারা রচিত  l প্রধান পদকর্তা ছিলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস ঠাকুর, জয়ানন্দ, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস প্রমুখ।
মঙ্গলকাব্য :
মধ্যযুগের বাংলা কাব্যধারার এক বিশিষ্ট শাখা হল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গল শব্দের আভিধানিক অর্থ হল কল্যাণ। মধ্যযুগে বিভিন্ন দেব-দেবীর মহিমা ও মাহাত্ম্যকীর্তন এবং পৃথিবীতে তাদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী নিয়ে এই কাব্যগুলি রচিত হয়েছে l মঙ্গলকাব্যের তিনটি প্রধান শাখা হলো মনসা মঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল ও ধর্ম মঙ্গল l প্রধান তিনটি চরিত্র হল যথাক্রমে মনসা, চণ্ডী ও ধর্মঠাকুর l এছাড়াও কিছু ছোট মঙ্গলকাব্য রয়েছে, যেমন- শিবমঙ্গল, কালিকা মঙ্গল, রায় মঙ্গল, শশী মঙ্গল, শীতলা মঙ্গল ও কমলা মঙ্গল প্রভৃতি। মঙ্গলকাব্যের প্রচলিত প্রধান কবিরা হলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয় গুপ্ত, রূপরাম চক্রবর্তী প্রমুখ।
অন্নদামঙ্গল : মধ্যযুগের শেষ কবি হলেন ভারত চন্দ্র। তিনি তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই কাব্যের বিখ্যাত উক্তি হল, "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে"।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দুধর্ম, ইসলাম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। মঙ্গলকাব্য , বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি , বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলি এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়।
আধুনিক যুগ :
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বিশ্বের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা হিসেবে পরিগণিত। ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন।
প্রাক-রবীন্দ্র যুগ :
মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রা ভেঙে প্রবেশ করেন মুক্ত ছন্দে। রচনা করেন সনেট। লাভ করেন  আধুনিক কবিতার জনকের খ্যাতি। আর উল্লেখযোগ্য "ভোরের পাখি" নামে খ্যাত ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতিকবি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)।
রবীন্দ্র যুগ :
রবীন্দ্রসাহিত্য : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুসারী কবি। তাঁর কবিকাহিনী, বনফুল ও ভগ্নহৃদয় কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শুরু করেন।এই পর্বের সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান ও কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী এবং তার পর প্রকাশিত সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), চৈতালি (১৮৯৬), কল্পনা (১৯০০) ও ক্ষণিকা (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে নৈবেদ্য (১৯০১), খেয়া (১৯০৬), গীতাঞ্জলি (১৯১০), গীতিমাল্য (১৯১৪) ও গীতালি (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলে বলাকা (১৯১৬) কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিবর্তে আবার মর্ত্যজীবন সম্পর্কে আগ্রহ ফুটে ওঠে।পলাতকা (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। পূরবী (১৯২৫) ও মহুয়া (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রেমকে উপজীব্য করেন। এরপর পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), পত্রপুট (১৯৩৬) ও শ্যামলী (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়কার রোগশয্যায় (১৯৪০), আরোগ্য (১৯৪১), জন্মদিনে (১৯৪১) ও শেষ লেখা (১৯৪১) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি। শেষ কবিতা "তোমার সৃষ্টির পথ" মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, উপনিষদ্, কবীরের দোঁহাবলি, লালনের বাউল গান ও রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষিত হয়। তবে প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি এক সহজ ও সরস কাব্যরচনার আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন। আবার ১৯৩০-এর দশকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন কবি।
রবীন্দ্রোত্তর যুগ :
রবীন্দ্রানুসারী ভাবধারার অন্যান্য কবিরা হলো: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী l
বিশ শতকের শুরুতে কবিতায় রবীন্দ্রবিরোধী বলে পরিচিত কবিত্রয় হলেন মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ।
আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ: রবীন্দ্র ভাবধারার বাইরে এসে দশক প্রথার চালু করেন তিরিশের পঞ্চপান্ডব কবি: অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), জীবননান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২) ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)।
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে। এর পরে গত দেড়শত বছর ধরে বাংলা কবিতা নিরন্তর সন্ধান করেছে আধুনিকতার, প্রকাশের নতুন মাত্রায়। ভাষা, ভাব, ভঙ্গি, অন্ত্যমিল ছন্দ, আঙ্গিক সকল বিষয়েই বদলের শুরু সে সময়টাতে। সেই ত্রিশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতা কখনোই স্থবির হয় নি l এই সময়কালে বাঁকবদলকারী বেশ কিছু কবিতা এসেছে যারা নিজেরাই একেকটি বিদ্রোহ, এক একটি পরিবর্তন। তেমন কিছু রচনার নাম উল্লেখ করতে গেলে বলা যায় দুই বিঘা জমি, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, সোনার তরী, বিদ্রোহী, খেয়া পারের তরণী, ক্যাম্পে, বনলতা সেন, কেউ কথা রাখেনি, গোধূলি সন্ধির নৃত্য, আটবছর আগের একদিন, তোমাকে পাবার জন্যে হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো, নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, ভাত দে হারামজাদা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার, বাতাসে লাশের গন্ধ প্রভৃতি যুগবদলকারী কবিতার কথা।


** তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া