আসরে মাঝে মাঝেই একটি বিতর্ক দেখি - শখের কবি ও কবিতা বিষয়ে l
বাংলা কবিতা ওয়েবসাইটে বর্তমানে যে আট হাজারেরও বেশী কবি নিবন্ধিত আছেন, জানা প্রয়োজন, তাঁদের কতজন শখের কবি পরিচয়ে তৃপ্ত আছেন এবং এর বাইরে তাঁদের আর কোনো উচ্চাশা নেই l নিশ্চয় আসরের সকল কবি এর মধ্যে পড়েন না l তরুণ কবিরা তো অবশ্যই না l তাঁরা আসরে কবিতা লিখতে লিখতে প্রশিক্ষিত হয়ে উঠবেন, হাত পরিণত হবে, চিন্তাশক্তি পরিশীলিত হবে, কবিকল্পনা সমৃদ্ধ হবে, ছন্দজ্ঞান, অলংকারাদির ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে উঠবেন, বর্তমান প্রজন্মের কবিতাচর্চার যে ধারা সেটা রপ্ত হবে - এবং এই সব কিছুকে পুঁজি করে কবিতা চর্চার মূল স্রোতে মিশে যেতে পারবেন এই উচ্চাকাঙ্খা তাঁরা রাখেন l এই ধরনের উচ্চাকাঙ্খা রাখাটাই সমীচীন l কারণ উচ্চাকাঙ্খা শিল্পীর ধর্ম l যার উচ্চাকাঙ্খা নেই সে কখনও বিকশিত হয় না l


এই আসরে বিগত দিনের নানা আলোচনা, মন্তব্য, মন্তব্যের উত্তর ইত্যাদি পড়ে শখের কবি বলতে যে ধারনা পেয়েছি সেটা এরকম l জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত l নতুন করে আর কিছু পাবার আকাঙ্খা রাখেন না l মনের আনন্দে কবিতা লেখেন l প্রতিভাবান হতে পারেন, না-ও পারেন, কিন্তু যেমন আছেন তেমনই থাকতে চান l কোনো পরিবর্তন চান না l নেহাত শখের বশে, নিজের আনন্দে লিখছেন, কেউ দুটি পরামর্শ দিয়ে সেই আনন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করুন, এটা তাঁরা চান না l কবিতা তাঁদের কাছে ধ্যানজ্ঞান নয়, ব্যস্ত কর্মজীবনের ফাঁকে একটু মনে হলো, একটা কবিতা রচনা করে ফেললেন, আসরে সেটা প্রকাশ করলেন l সেই রচনাকে ঘিরে তাঁদের কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই l তাঁদের রচনার ওপর গঠনমূলক আলোচনা তাঁরা চান না l কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে উন্নতির পথে এগুনোর তাঁদের কোনো পরিকল্পনা নেই l কবিতার ব্যাকরণগত, আঙ্গিকগত কোনো পরামর্শ তাঁদের পছন্দ নয় l তাছাড়াও কবিতা ও কবিতাচর্চার ওপর কোনো পরামর্শমূলক প্রবন্ধ বাংলা কবিতা ওয়েবসাইটে প্রকাশও তাঁদের অপছন্দ l কারণ এর ফলে তাঁদের আনন্দে ব্যাঘাত হয় l যেভাবে তাঁরা লিখছেন, সেই ভাব পরিবর্তনের কোনো পরামর্শকে তাঁরা স্বাগত করেন না l


এটাও জানা দরকার এই আট হাজারের ওপর নিবন্ধিত কবির মধ্যে কতজন নিজেদের শখের কবি হিসাবে দেখেন না l কবিতা যাঁদের কাছে ধ্যানজ্ঞান, কবিতার প্রতি যাঁরা নিবেদিতপ্রাণ l কবিতাকে ঘিরে যাঁরা অনেকটা পথ এগুতে চান l এদের মধ্যে কেউ ইতিমধ্যেই হয়তো কবি হিসেবে খ্যাতিলাভ করতে পেরেছেন, মূলধারার সাহিত্য-চর্চায় যুক্ত আছেন, এক বা একাধিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, বা প্রকাশের স্বপ্ন দেখেন l অর্জিত কবিখ্যাতিকে উন্নতির পরবর্তী স্তরে দেখতে চান l তরুণ হতে পারেন, প্রবীণ হতে পারেন, হয়তো সবে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, হয়তো অনেকদিন ধরে কবিতা চর্চা করেও এখনও সেরকম খ্যাতি পান নি, কিন্তু নিজেদের কবিতাকে ঘিরে, নিজের কবি পরিচয়কে ঘিরে তাঁরা মনের মধ্যে ambition অর্থাৎ উচ্চাকাঙ্খা রাখেন l তাঁরা নিজেদের কবিতার ওপর গঠনমূলক আলোচনাকে স্বাগত করেন l মত বিনিময়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে সচেষ্ট থাকেন l আলোচনা পাতায় কবিতার বিষয়ে যে লেখাগুলি প্রকাশিত হয়, নিজের বিবেচনা অনুযায়ী নির্বাচন করে গভীর আগ্রহের সঙ্গে সেই লেখাগুলি পাঠ করেন l কখনও আলোচনায় অংশ নেন l এবং কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেন সেই আলোচনাগুলি পাঠ করে তাঁরা কতটা উপকৃত হচ্ছেন l প্রয়োজনে, যুক্তিসঙ্গতভাবে ভিন্নমতও প্রকাশ করেন l এইভাবে এক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিবেশে আদান প্রদান, মত ও ভাব বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে কবিতাচর্চা ও কাব্যচর্চা চলে l কবিতা রচনা কোনোকালেই কাব্য-আলোচনা ছাড়া হয় নি, হতে পারে না l আসরে এরকম সিরিয়াস মনোভাবাপন্ন, প্রতিভাধর, প্রতিশ্রুতিময় নবীন প্রবীণ কবির সংখ্যা অনেক l


শখের কবি ও শখের কবি নয় এই পৃথকীকরণ এইজন্য আবশ্যক - যেহেতু লক্ষ্য করছি, আসরে এই নিয়ে কিছু অনাকাঙ্খিত বিতর্ক হয়েছে - এই পৃথকীকরণ করে দিলে এইজাতীয় বিতর্কের অবসান হতে পারে l
আসরে কবিতা প্রকাশের পাশাপশি, কবিতাচর্চার  নানা বিষয়ে আলোচনা প্রকাশিত হয় l স্বাভাবিকভাবেই এই আলোচনাগুলিতে কবিতার ক্ষেত্রে চিরকালীন কিছু তত্ত্ব, প্রতিষ্ঠিত কবিদের কিছু প্রবাদপ্রতিম উদ্ধৃতি, কবিতার প্রকার, প্রকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলি এসে যায় l যাঁরা সিরিয়াসলি কবিতা লিখছেন, নবীন কিংবা প্রবীণ, তাঁদের কাছে এই আলোচনাগুলি খুবই উপযোগী l এবং আসরের বহু কবি এই আলোচনাগুলি যে পাঠ করছেন, সেটা পাঠের সংখ্যা ও মন্তব্য দেখে বোঝা যাচ্ছে l কৃতজ্ঞতার সাথে তাঁরা সেটা স্বীকার করছেন l
যদি জানা যায়, কে শখের কবি থাকতে চান এবং কে সত্যিকারের কবি হয়ে ওঠার স্বপ্ন রাখেন, তাহলে তাঁদের কবিতায় মন্তব্যদানের ক্ষেত্রে প্রস্তুতিমূলক সাবধানতা নেওয়া যায় l


আলোচনা পাতায় কবিতার তাত্ত্বিক ও ফলিত বিষয়ে যে লেখাগুলি প্রকাশিত হয়, সেগুলি পাঠ করা তো বাধ্যতামূলক নয় l সেরকম মনে করলে শখের কবিগণ এই আলোচনাগুলি স্বছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন l কিন্তু এরকম লেখা এখানে 'অপ্রাসঙ্গিক', এইজাতীয়  কথা বলা থেকে তাঁদের বিরত থাকা উচিত l এই বক্তব্য, যাঁরা প্রকৃতই কবিতাকে ভালোবাসেন, প্রতিনিয়ত নিজের কবিতাচর্চায় পরিশীলন চান, তাঁদের স্বার্থের পরিপন্থী l

শ্রদ্ধেয় কবি স্বপন কুমার মজুমদার মহাশয়ের একটি কবিতায় সম্প্রতি করা একটি মন্তব্য প্রাসঙ্গিক মনে করে এখানে সংযুক্ত করলাম,
"০৮/০৬/২০১৭, ১৯:৪৮ মি:
আসরে সবাই তাঁর নিজের মতো l নিজের সহজাত প্রবণতা যেদিকে চালিত করবে, ঈশ্বরের ইচ্ছা মনে
করে সাধক হৃদয়ে সেটাই করা বিধেয় l বাকি সবাই কে কি বলল, কে কি লিখল, সেটা শুনতে পড়তে বাধা নেই, কিন্তু তাকে গুরুত্ব দেওয়াটা আবশ্যিক নয় l
মনের আনন্দে লিখুন l যা প্রেরণা দেয়, তাকে হৃদয়ে স্থান দিন l অনুপ্রেরণায় নব নব সৃষ্টি করুন l যা অপমান করে, কটুক্তি করে, মনের মধ্যে একটা ডাস্টবিন রাখুন l সব ওখানে নিক্ষেপ করুন l
ভালো থাকুন কবি l অনেক শুভেচ্ছা !"


শখের কবি হিসাবে যাঁরা নিজেদের পৃথক দেখতে চান, এবং যাঁরা শিক্ষার্থীর মনোভাব নিয়ে কবিতাচর্চার পথে সামনে এগুতে চান, তাঁদের মধ্যে এই অনাকাঙ্খিত বিতর্ক এড়ানো খুব জরুরী l
কোনো interference নয় l সকলকে তার নিজের মতো লিখতে দিয়ে আসরে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আবেদন রাখলাম l


অনেক অনেক শুভেচ্ছা সকলের জন্য l