যখন ক্লাস থ্রি অথবা ফোরে পড়ি তখন এখনকার মতো বিনোদনের এতো সুযোগ সুবিধা ছিলোনা। সেসময় রেডিও খুব চালু মাল ছিলো। ঘরে ঘরে তখন রেডিও বাজতো। বিয়ের শাদীতে যৌতুক হিসেবেও রেডিওর খুব ডিমান্ড ছিলো। যারা যৌতুক নিতে এক কাঠি উপরে থাকতেন তাদের জন্য কাঠের বাক্সের সাদা-কালো টেলিভিশনই পয়লা পছন্দ। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে তখনকার সময়ের ছোটরা এখনকার মতো ছোটদের মতো বিনোদনের অত সুবিধা পেতনা। তাদের জন্য দিনের নির্দিষ্ট কোন একটা সময় টেলিভিশন দেখা বা রেডিও শোনার জন্য বরাদ্দ করা হতো। তেমনি ভাবে আমার জন্যও শুক্রবার ব্যতিত রাতের পড়াশোনা শেষে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য টেলিভিশন দেখা জায়েজ ছিলো। যদ্দুর মনে পড়ে নাটকের নাম অয়োময়। প্রতি শুক্রবারে সকালে সেটা প্রচার হতো। সেই নাটকে কোন এক মেয়েকে দেখে মনের মধ্যে সিডর, আইলা, নার্গিসের আগমন টের পেতাম! নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলেও নিঃশ্বাস ঘন টানতে হতো। একটা সময় নাটকের সব গুলো পর্ব একে একে শেষ হয়ে গেলে আমার চোখ দিয়ে ঝর্ণা ধারা নেমে আসলো। আজ বুঝি সে ঝর্ণা ধারার মূল রহস্য কি ছিলো...  :P

ভাত খেলে কি আর পেট ভরে যদি আলিফ লায়লা (অ্যারাবিয়ান নাইটস) দেখা না হয়? যখন টেলিভিশনে (বিটিভি) আলিফ লায়লা প্রচার হতো তখন সুনসান রাস্তা দেখে বুঝাই যেতে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ টেলিভিশনের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। বিদেশি নাটক মানেই হচ্ছে টান টান উত্তেজনা। সেখানে আধা সের যুদ্ধ, এক মুঠ কাহিনী আর এক তিন আঙ্গুলের এক চিমটি নাচ গান দিয়ে যে স্যালাইন তৈরী হতো তা বিটিভির নিজস্ব ষ্টুডিওতে ধারণ করা এক ঘেয়েমি টাইপের নাটক গিলে গিলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া দর্শকরা গোগ্রাসে গিলতো। নাটক সিনেমার ক্ষেত্রে চিরন্তন সত্য হলো দর্শকেরা সব সময় নায়কের পক্ষ অবলম্বন করবে। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সিন্দাবাদকে দুচোখে দেখতে পারতাম না কারণ সারারাগুলের (সিন্দাবাদ পর্বের মহিলা ভিলেন) একদম পছন্দ না সিন্দাবাদকে। সুযোগ পেলেই সিন্দাবাদকে নানান ঝামেলায় ফেলে দেয়, আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠি। কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে যায় যখন দেখি সিন্দাবাদ সব যক্কি ঝামেলাকে তুড়ি মেরে বীরদর্পে ফিরে আসে। মনে মনে কত বদ দোয়া দিতাম যাতে সিন্দাবাদ কঠিন কোন রোগে ধরাশায়ী হয়ে পটল তুলে। এছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিলোনা। ব্যাটাকে যেখানেই ফেলা হোক না কেন ও ঠিকই উঠে আসবেই। একটা সময় সিন্দাবাদ তার অলৌকিক শক্তির অধিকারী ধারালো তলোয়ার দিয়ে সারারাগুলকে মেরে ফেলে... আহারে মেরেই ফেললো! ধূর আর টেলিভিষণই দেখুম না! :P

ছোট পা'ওয়ালা চৈনিক মেয়েরা নাকি চীন দেশে বড়ই আভিজাত্যের প্রতীক ছিলো! তাদের আদর কদরের কোন কমতি ছিলো না। তাদের বিপরীতে বড় পা'ওয়ালা চৈনিক মেয়েরা ছিলো নির্যাতিত। কিন্তু আমি প্রতিদিন আমার ঘরে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রেখে যে চৈনিক মেয়েটাকে রোজ রোজ দেখি তার পা কখনো দেখিনি। পা দিয়ে কি হয়? ও ত আর হাঁটছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কি সুন্দর একটা হাসি দিয়ে। মোনালিসার মুচকি হাসি তাবৎ দুনিয়ার মানুষ কেন যে চোখ দিয়ে গিলে বুঝিনা। আমার ঐ চৈনিক মেয়েটার হাসি যদি একবার কাউকে দেখাতে পারতাম তাহলে বুঝতে হাসি কারে কয়! দিন যায়, মাস যায়, ঘরের অন্যান্ন ক্যালেন্ডারের পাতা বদল হলেও ওটা বদলায় না। সেসময় লেমেনেটিং বলে কিছু ছিলো না নইলে বইয়ের মলাটে না লাগিয়ে লেমিনিটিং করিয়ে রেখে দিতাম! আমার বিদ্যা দেবীকে বইয়ের মলাটে স্থান দিয়ে রক্ষা করতে পারিনি, সিংহ স্যার (রবীন্দ্র কুমার সিংহ) সেটা ছিনিয়ে নিলো... তখন থেকেই সিংহ স্যার আমার দু চক্ষের বিষ! জানিনা এখন উনি কোথায় আছেন... :(

১৯৯৬ সাল। তখনো কম্পিউটার অতটা সহজলভ্য হয়নি। কিন্তু আমার মাথায় যেটা একবার ঢুকে যায় সেটা অত সহজে বের হয়না। সারাদিন মায়ের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করতাম একটা কম্পিউটার কিনে দেবার জন্য। মা আমাকে আশ্বাস দিলেন পরীক্ষায় যদি ভালো রেজাল্ট করতে পারি তাহলে আমাকে কম্পিউটার কিনে দেয়া হবে। এখন আমার মনোযোগের পুরোটাই পড়াশোনার প্রতি। যেভাবেই হোক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে নইলে কম্পিউটার প্রজেক্ট বাতিল, আমি তা কিছুতেই হতে দেবোনা। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ক্রেয়ন দিয়ে নানান রঙের কম্পিউটারের ছবি এঁকে এঁকে খাতার পাতা ভরে ফেলতাম। পরীক্ষা শেষ হলে মাকে নিয়ে কম্পিউটারের দোকানে যাই কারণ তখন বাবা দেশের বাইরে থাকতেন। সর্বনিম্ন কনফিগারের যে কম্পিউটারটা আমার পছন্দ হলো তার দাম শুনে মায়ের গলা শুকিয়ে কাঠ! আম্মু আমাকে কানে কানে বলতে লাগলেন শোন যেখানে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ২১" রঙ্গীন টেলিভিশন কিনেছি সেখানে ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে ১৪" মনিটরের একটা টেলিভিশন (!) কেনার কি কোন মানে হয়? সেদিন আমার আর কম্পিউটার কেনা হয়নি। ঐদিন আর কিচ্ছু খাইনি এমন কি এক ফোটা পানিও না। আম্মুর ভয় ছিলো আব্বু যদি জানতে পারে আমাকে এতো দাম দিয়ে কম্পিউটার কিনে দেয়া হয়েছে তাহলে ভীষণ রাগ করবে। কারণ আমাদের জন্য টেলিভিশন দেখাতেও অনেক কড়াকড়ি ছিলো আর এতো কম্পিউটার, শয়তানের আড্ডা খানা! দুদিন পরে আব্বুর সাথে টেলিফোনে কথা হলে আমি কাঁদতে কাঁদতে আব্বুকে কম্পিউটারের বিষয়ে সব খুলে বললাম। আব্বু আমাকে আশ্বাস দিলেন তিনি লন্ডন থেকে সবচে ভালো কম্পিউটার আমার জন্য পাঠাবেন। প্রায় এক বছর পর আমার ছোট চাচা দেশে এলেন তাঁর সাথে এলো আমার কম্পিউটার। ল্যাপটপ কম্পিউটার!! ১৮০০ পাউন্ড দিয়ে কেনা!!! আমার আর আনন্দের সীমা নেই এই কম্পিউটার যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। কারেন্ট গেলেও সমস্যা নাই চার ঘন্টা অনায়াসে চলতে পারে। তখন আমি কম্পিউটারের কিছুই বুঝতাম না শুধু ভেতরের কিছু গান ছিলো সেগুলো ছোট চাচার বদৌলতে চালাতে পারতাম। দুই মাসের মাথায় ল্যাপটপটা নষ্ট করে ফেলি, কোন অবস্থাতে আর ঠিক করা যাচ্ছেনা। সিলেট থেকে ঢাকায় পাঠানো হলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। শেষ মেষ ছোট চাচা আবার লন্ডনে যাবার সময় আবার সেটাকে নিয়ে গেলেন, সেই সাথে নিয়ে গেলেন আমার সীমাহীন ভালোবাসা... :(

বিঃ দ্রঃ ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক বলছি যে এই লেখাটিকে কেউ কবিতা বা গল্প বলে ভুল করবে না, লেখাটা একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বৈ অন্য কিছু নয়। তৃতীয় বারের মতো কবিতার পাতায় কবিতার বাইরে ব্যতিক্রম কিছু প্রকাশ করার ধৃষ্টতা দেখালাম। আশা করি এবারো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আরো একটা কথা না বললে নয় যে ইদানিং ব্যস্ততা খুব বেড়েছে তাই আগের মতো বাংলা কবিতায় সময় দিতে পারছিনা আশা করছি আবারো শীঘ্র আগের মতোই সময় দিতে পারবো। ভালো থাকুন সবাই।