অবশেষে আজ ভোর ছ’টায়
এ নিষ্ঠুর পৃথিবীর তাবৎ হিসেব নিকেশ চুকিয়ে
তোমার অনিঃশেষ মুক্তি মিললো।
তুমি জলের শেষ চুমুকটি পান করে নিয়ে
ওড়ার প্রতীক্ষায় ছিলে। তোমার কপালে তখনো
মায়ের মমতার হাত জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছিল।    
হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে, চির বাকহীন তুমি  
মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে আজ পাখা মেলে চলে গেলে
অনন্ত ঊর্ধ্বাকাশ পানে।  জানিনা-
যাবার আগে তুমি আমাদের ক্ষমা করে গেছ কিনা!  


আমাদের আর দশজনের মত তোমারও সবই ছিল,
চোখ, কান, নাক, জিহবা, ত্বক। শুধু ছিল না--
তোমার কন্ঠে আমাদের মত ভাষা।
তোমার নিজস্ব কিছু ভাষা ছিল, সে ভাষা দিয়েই  
প্রকৃতির সন্তান তুমি মানবের সাথে কথা বলতে চাইতে।
কিন্তু আমরা নির্দয়ভাবে তোমাকে অবজ্ঞা করেছিলাম।
তুমি মূক ছিলে, কিন্তু মূঢ় ছিলে না; তবু বাক্যহীনতার
এই একটিমাত্র অভিযোগে তোমার দন্ডাদেশ হয়েছিল
এক অঘোষিত কারাবাস। ঊনপঞ্চাশ বছর সাত দিনের
কারাবাস ভোগ করে তুমি আজ মুক্ত হয়ে  চলে গেলে!


ঘরের চৌহদ্দির ভেতরে তুমি বন্দী ছিলে,  
জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে নিতে এক চিলতে আকাশ।
গৃহকোণে কোন অতিথির আগমনে,
নিজেকে গুটিয়ে নিতে ম্রিয়মান তুমি অতি সঙ্গোপনে।
তোমার ভুবনে তুমি নিতান্ত একাই ছিলে,
চির নিঃসঙ্গ, বান্ধবহীন। অনাদৃত, আনন্দবিহীন।  
আর কেউ আকাশে প্লেন দেখে আমার কথা ভাববে না,
আর কেউ কাছে এসে আমার সাথে ইশারায় কথা বলবে না!  
মাত্র পনের দিনের অসুখে তুমি কত দ্রুত হয়ে গেলে লীন,  
তোমার অন্তর্ধানে আমি হয়ে আছি তোমারই মত বাক্যহীন!


ক্ষমা চাওয়ার তো কোন সুযোগ তুমি দিলে না,
তাই তোমার কফিনের ভারী হাতল নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে
আমি হেঁটে হেঁটে গোপনে অশ্রুপাত করে ক্ষমা চেয়েছি বারবার,
নিজের দায়মুক্তির জন্য। এ জীবনে আর কোনদিন আবার,
তোমার নিষ্পাপ মুখটি দেখা হবে না। তোমার ভাষাহীন জবান
আর কখনো কোন অভিযোগ জানাবে না। অন্তিম শয়ানে
শায়িত করার আগে তোমার স্নিগ্ধ সৌম্য মুখটি দেখে নিয়েছিলাম।
মাটিতে বিলীন হয়ে যাবার আগে তোমার শেষ ছবিটি তুলেছিলাম।  
যেন সেই মুখটি সময়ে সময়ে--
আমার বিবেক, মমত্ববোধ ও প্রায়শ্চিত্তবোধকে জাগ্রত করে যায়।


ঢাকা
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
(একজন বাক-প্রতিবন্ধী নিকটাত্মীয়ের দাফন শেষে ঘরে ফিরে, যাকে আমি জন্ম থেকে মৃ্ত্যু পর্যন্ত নিকট থেকে দেখেছি।)