বুঞ্জনী খাতুন, সাত ছেলে তার, অহংকার তাই!
সাত ভাইয়ের চম্পার মতোন মেয়েও ছিলো তার;
স্বপ্নসুখে ভেসে যেতো বুঞ্জনীর সংসার।
স্বামীর আহ্লাদ পেয়ে, সুখের সংসারে,
আনন্দ-হিল্লোলে টইটুম্বুর;
যেনো টলমল জলের শ্রাবণের পুকুর।
মনোরম বিশাল আকাশ,
শ্যামল ধানের ক্ষেত,
হাতছানি দিয়ে ডেকে যায় তারে-
'আয়রে কিষাণী তুই,
বুকের ভেতরে সতেজ যৌবন লয়ে বলিষ্ঠ শরীরে।
বেঁধে নেবো তোরে প্রকৃতির সাথে,
দোতরার সহোদরা,
রে নিপুণা সুরের খঞ্জনি,
টলমল জল ঢেউ তোলা নদী, অনিন্দ্য বুঞ্জনী।


হাজির উদ্দিন প্রামাণিক, স্বামী তার, স্বচ্ছল কৃষক।
গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ, গোলা ভরা ধান তার;
ছেলে মেয়ে মিলে, সুখের সংসার;
অভাবের কোনো লেশ নেই।
হাসি আর গানে আনন্দের ধারা
বহতা জলের মতো কলকল স্বরে বয়ে যায়,
চলার পথের যেনো কোন শেষ নেই।


জীবনের খেলা নিদারুণ কষ্টময়!
বোঝে নাতো কেহ;
এ মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, জরাজীর্ণ দেহ।
মৃত্তিকায় সৃষ্টি তার,
পৃথিবীতে বাঁচে মৃত্তিকায় খেলা করে,
আবার মিলে সে এই মৃত্তিকার সনে।
হাজির উদ্দিনও পরাভব মানে;
সময়ের টানে ডুবে যায় সেও গভীর অতলে,
গহীন অন্ধকারে;
যেথা থেকে আর কোনদিন কেহ ফিরিবারে নাহি পারে।
বুঞ্জনী খাতুন সেই থেকে পৃথিবীতে 'বেওয়া' হয়ে যায়।


তখনও যে তার, খাওয়া পরার দুঃখ ছিলো না কোনো;
জমি-জিরেৎ, ঘরবাড়ি, স্বামীর সংসার;
ছিলো বেশুমার।
নিকানো উঠোন, পাকা ভিটে ঘর,
মানিকের মতো জ্বলা ছেলে-মেয়ে মিলে
আটজন সন্তান তার
জ্বলজ্বল করে তারকার মতো।
সুখ আর সুখ, অনিন্দ্য সুখের ধারা
ঝরে পড়ে খোলা মাঠে;
যেন শ্রাবণীয়া বর্ষাজল ঝরে অবিরত।


এই সংসার নির্মম, বড়ো যন্ত্রণার!
বেঁচে থাকা বড়ো দায়।
সাত ছেলে যার, সুখ নাই তার,
এতোদিন পরে বুঝে গেছে বুঞ্জনী বেওয়া, হায়!
সন্তানেরা ভাগ হয়ে গেলো,
এক চুলা তাদের সাত চুলা হলো,
বুঞ্জনী বেওয়া একা গেলো, রইলো অবিকার।
বাড়ি ভাগ হলো, হাঁড়ি ভাগ হলো,
জমি-জিরাৎ সব তা-ও ভাগ হলো,
বুঞ্জনীর চোখের সম্মুখে সবকিছু হলো খান খান;
সোনার সংসার তার গুড়ো হয়ে গেলো,
অগ্নুৎপাতে যেমন গুড়ো হয়ে যায় পাহাড়ের প্রাণ।
নদীও শুকিয়ে গিয়ে চর পড়ে তাতে,
দুঃখের তাপে জমে বালিয়াড়ি, ধু ধু মরুভূমি!
বুঞ্জনী বেওয়ার সুখের আঁচলে দাবদাহ উঠে জ্বলে।


হাজির উদ্দিন সোহাগ বিলাসী ছিলো;
তাই বুঝি সে এক দোন জমি লিখে দিয়েছিলো তারে,
সোহাগের প্রতিদানে।
স্বামীর বিরহ ছাড়া বুঞ্জনীর অভাব ছিলো না আর;
সাজানো গোছানো ঘর গোলাভরা ধান,
সবকিছু মিলেমিশে সুখ অফুরান।


কিছুদিন পরে, সাত ছেলে তার যুক্তি করে পরস্পরে;
হাসি হাসি মুখে বলে-
'সোনার থালায় ভাত দেবো মা, রূপার বাটাতে পান,
রাজরানী করে রাখবো তোমারে, হও কেনো পেরেশান?
তুচ্ছ জমি-জিরেতের লাগি',
হচ্ছো কেনো মা, তুমি বিবাগী?
লিখে দাও সব আমাদের নামে,
আমরাতো তোমারই সন্তান;
তোমার নামেতে জমি যদি রয়,
সমাজের মাঝে আমদের বাড়ে অপমান'।
এই কথায়, সেই কথায়, শত কথা বলে,
ছল চাতুরীর শেষে,
মায়ের নামে যতটুকু ছিলো সবটুকু নিলো লিখে।
রাজরানী হলো ভিখারিনী আজ ছেলেদের সংসারে,
হাতের কাঠি ছেড়ে দিয়ে হলো পুত্রবধুর অধীনা;
জমির মতোন বুঞ্জনীও ভাগ হয়ে গেলো।
সন্তানদের বিচারালয়ে ডিক্রী হলো জারি-
সাতদিন করে একেক সংসারে পালা করে খাবে।
কিছুদিন পরে কপালে জুটলো তার,
'বউতোলা ভাত', সাথে বউয়েদের ঝংকার।
হদয় তার ফালাফালা হলো তিক্ত কথার তীরে,
বুঞ্জনী বেওয়া নিত্য কাঁদে, এই ছিলো তকদীরে?


সুদিন হারালো তার, হলো কুদিনের যাত্রা;
তেজস্বী ছেলের বউয়েরা যুক্তি করে
একদিন মুখের গ্রাসটুকুও বন্ধ করে দিলো।
গরবিনী মাতা ভিখারিনী হয়ে দুঃখের যন্ত্রণায়
ঘর ছেড়ে পথে বের হয়ে যায়, অজানার অন্ধকারে।
এহেন রকম বুঞ্জনী বেওয়া জন্ম নিচ্ছে
আমাদের দেশে অসংখ্য সংসারে।


০৩/০৪/২০২০
মিরপুর, ঢাকা।