কাব্য গ্রন্থটির নাম 'চারলাইন/৭১'। কবি- ফারহাত আহমেদ। খুব ঢাউস আকারের কবিতার বই নয়; পাঠক এক বসাতেই পুরো কাব্যগ্রন্থটির সবগুলো কবিতা পড়তে পারবেন। আমি এক বসাতেই সবগুলো কবিতা পড়তে বাধ্য হয়েছি। 'বাধ্য হয়েছি' এই কথাটি বলার পেছনে যুক্তি হলো, একটি ছড়া-কবিতা পড়ার পর, পরের লেখাটি পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। যদিও, এ কাব্যগ্রন্থে সর্বমোট ৫০ টি ছড়া-কবিতা আছে। কিন্তু প্রতিটি ছড়া-কবিতার ভাবের গভীরতা এতই ব্যঞ্জনাময় যে, একটি দীর্ঘ কবিতার সংক্ষিপ্তরূপ বলা যায়। প্রতিটি কবিতার বক্তব্যের ভাবনাকে ভাব-সম্প্রসারণ করার মত যোগ্যতা বহন করে। তাই, মাত্র চারলাইনের একটি ছড়া-কবিতাকে আমি 'কবিতা' বলে উল্লেখ করছি।


কবির প্রোফাইল অনুযায়ী জন্ম ১৯৭১ সাল। এই কাব্যগ্রন্থের ছড়া-কবিতাগুলো লেখা হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ '৭১ কে চিত্রায়িত করে। চিত্রকল্পময় লেখাগুলো পাঠ করার পর মনে হলো,  কবি যেন স্বচক্ষে এই ঘটনাগুলো দেখেছেন। আর সেগুলো ছন্দের আঁকরে বিবৃত করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তাঁর গভীর জ্ঞানের ব্যাপকতা আমাকে বিমোহিত করেছে। ছন্দের কারিশমা এবং বক্তব্যের গভীরতা কাব্যগ্রন্থটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। প্রতিটি ছড়া-কবিতা যেন একেকটি তৈলচিত্র মনে হলো। কাব্যগ্রন্থটির মাধুর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে প্রতিটি ছড়া-কবিতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি স্কেচ দিয়ে। চার লাইনের ছড়াটি পড়লে, যে চিত্রটি মনের ক্যানভাসে অংকিত হবে;  সে চিত্রটি যেন তুলির আঁচড়ে তুলে ধরেছেন অনবদ্যভাবে কোন একজন বোদ্ধা শিল্পী। আমার কাছে ভালো লেগেছে কবির ছড়া-কবিতায় বক্তব্যের স্বচ্ছতা এবং স্পষ্টবাদিতা। কোনও রাখঢাক নেই, শব্দের তুলিতে ইতিহাসের সত্যকে সুন্দরভাবে এঁকেছেন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সরাসরি 'বর্বর পাকিস্তানি' এবং তাদের এদেশীয় দোসরদেরকে 'রাজাকার' বলতে, একটুও দ্বিধান্বিত হননি।


মাত্র দু'টি ছড়া-কবিতায় বীরের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। একটি হলো, বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে,
চার লাইন বঙ্গবন্ধু
----------------
মন্ত্রের নাম স্বাধীনতা, তুমি
জাতিকে জাগাও নেতা,
বাঙালি জাতিকে বাংলা দিয়েছো
তুমি তাই তার পিতা।


আর, অন্যটি হলো, বীর-প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে নিয়ে,
ছড়া-কবিতা নম্বর- আটচল্লিশ
--------------------------
একটা তারার নাম জানি যার
কথা হয় অবিরাম,
বাংলার আকাশে জ্বলে দিনে-রাতে,
তারামন তার নাম।


আর বাকি প্রায় সব ছড়া-কবিতাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশি নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর সংঘটিত নির্যাতনমূলক অপকর্মের এক একটি খণ্ড চিত্র। এই কাব্যগ্রন্থের একটি ছড়া-কবিতা পড়ার পর অনুসন্ধিৎসু পাঠককে পরবর্তী ছড়া-কবিতাটি পড়ার জন্য আগ্রহান্বিত করে তুলবে আমার বিশ্বাস। কবি ফারহাত আহমেদ-এর 'চারলাইন/৭১' কাব্যগ্রন্থটির কয়েকটি ছড়া তুলে দিলাম পাঠকের রসাস্বাদনের উদ্দেশ্যে।


ছড়া-কবিতা নম্বর- পনের
----------------------
অগ্নিগর্ভে শ্লোগান শেখাও,
ঘুম চলে যাক অচিনপুর,
বাঙালি জাগলে হায়েনা পালায়
অনেক অনেক অনেক দূর।


ছড়া-কবিতা নম্বর- সাতাশ
-----------------------
সবে নয় মাস কিন্তু মুক্তি,
যোজন যোজন দূর,
যোদ্ধার কাঁধে যোদ্ধার লাশ,  
সালটা একাত্তর।


ছড়া-কবিতা নম্বর- ঊনত্রিশ
------------------------
মাটি খুঁড়ে কেউ সোনা-রুপা পায়,
কেউবা অতীতকাল,
যুদ্ধের পর আমি খুঁড়ে পাই
খুলি আর কঙ্কাল।


ছড়া-কবিতা নম্বর- ছত্রিশ
----------------------
স্বজাতির অনেক খুঁজে পাই নাই
তন্নতন্ন খুঁজি,
গণকবরের হাড় বলে দেয়,
আর পাবো না বুঝি।


বাঙালি জাতি যেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'চির উন্নত শির'-এর জাতি। হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেও জাগরণী গান গেয়ে উঠে সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যয় নিয়ে। তাই যেন কবি তাঁর ছড়া-কবিতায় দ্বিধাহীন চিত্তে উচ্চারণ করেন সেই কথা।


ছড়া-কবিতা নম্বর- তেতাল্লিশ
--------------------------
পুড়ে যায় ঘর, উড়ে যায় ব্রিজ
লাশ পাই সবখানে,
ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেও
বাঙালি দাঁড়াতে জানে।


'চারলাইন/৭১'  কাব্যগ্রন্থটির সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন ঘুড়ি টিম। নামলিপি ও অলংকরণ করেছেন নবী হোসেন। এক রঙা এক ঘুড়ি প্রকাশনী থেকে নীলসাধু কর্তৃক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির মূল্য ১৮০ টাকা। বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান, এ দেশের প্রতিজন সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে উৎসর্গকৃত; কবি ফারহাত আহমেদ 'চারলাইন/৭১'  কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি; তথা, সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণ, ডিসেম্বর, ২০২১- এ । কবির এহেন বলিষ্ঠ কাব্যধারা চলতে থাকুক দীর্ঘকাল, এ কামনা করছি।