প্রিয় বন্ধুরা, পূর্বের তিনটি পোষ্টে বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এবার, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে তুলে আনার চেষ্টা করছি।


বাংলা কাব্য সাহিত‌্যে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বিস্তার বাংলা কবিতার আধুনিকরণের দিগন্ত উন্মোচণ করে দিয়েছে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, ছন্দের আষ্টেপৃষ্টে নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধতার বলয় থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এই ধারার ছন্দ হচ্ছে রূপের বাহার। রূপকল্প সৃষ্টির এক ছন্দধারা।


মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিলো 'পুঁথি'। আর এ পুঁথি রচিত হতো 'পয়ার' অর্থাৎ, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। তাতে ৮+৬=১৪ মাত্রার হিসেব মেনে লিখা হতো।


যেমন,
এমন পিরীতি কভু / দেখি নাই শুনি।
পরাণে পরাণ বান্ধা / আপনা আপনি॥
দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে / বিচ্ছেদ ভাবিয়া।
আধ তিল না দেখিলে / যায় যে মরিয়া॥


এর বৈশিষ্ট হলো, সমিল চরণের সুরাশ্রয়ী ।  প্রথম চরণে এক দাড়ি এবং দ্বিতীয় চরণে দুই দাড়ি।
এহেন ধারাটি কবিতায় অনেকদিন বজায় ছিলো। প্রাক-রাবিন্দ্রীক কালে কবিগণ তা ব্যবহার করতেন। তবে, এখানে যতিচিহ্নের ব্যবহারে পূর্বের নিয়মকে পরিত্যাগ করা হয়।


যেমন,
সকালে উঠিয়া আমি / মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন / ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা / মোর গুরুজনে
সেই কাজ আমি যেন / করি ভালো মনে।


পয়ারের এই আকৃতির পরিবর্তনের কৃতিত্ব কবি মাইকেল মধুসূদনের। তিন ১৪ মাত্রার ভেতরে থেকেই অন্তমিলের দেয়াল ভেঙ্গে কাব্যধারাকে নিয়ে এলেন সাহিত্যের অঙ্গনে। যাকে 'অমিত্রাক্ষর' নামে অভিহিত করা হয়।


যেমন,
সোনার পালঙ্কে মহারাণী, শত শত
দাস দাসী সৈন্য প্রজা লয়ে, বসে আছি
তপ্তবক্ষে শুধু এক শিশুর পরশ
লালসিয়া, আপনার প্রানের ভিতরে
আর একটি প্রানাধিক প্রাণ করিবারে
অনুভব- এই বক্ষ, এই বাহু দুটি
এই কোলে এই দৃষ্টি দিয়ে, বিরচিতে
নিবিড় জীবন্ত নীড়, শুধু একটুকু
প্রাণ কণিকার তরে।


এখানে প্রবাহমান ১৪ মাত্রার ছন্দে যতি চিহ্নের ব্যবহারে স্বাধীনতা বিরাজমান। এখানে সমিল ও অমিল যা-ই হোক না কেন, যতির স্বাধীনতা  কবিতাকে আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি দিয়েছে।


পরবর্তীতে ১৪ মাত্রা অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে ৮+১০= ১৮ মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে যতি চিহ্নের ব্যবহার এবং প্রবাহমানতা অধিকতর প্রসারিত হয়েছে।


যেমন,
সংসারে সবাই যবে / সারাক্ষণ শতকর্মে রত
তুই শুধু ছিন্নবাধা / পলাতক বালকের মত
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে / একাকী বিষন্ন তরুচ্ছায়ে
দূর বনগন্ধবহ / মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশী।


অক্ষরবৃত্ত ছন্দ পরবর্তীতে ১৪ বা ১৮ মাত্রার হিসেবকে ছাড়িয়ে কবির স্বাভাবিক উচ্চারণে রীতির উপর নির্ভর করে অসমমাত্রিক ও স্বাধীন পার্বিক  এবং অপ্রবাহমান ছন্দধারায় চলে আসে। এর ফলে কাহিনী কাব্যে এই ছন্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছে 'গদ্যছন্দ'।


যেমন,
শহীদের পুণ্যরক্তে সাতকোটি
বাঙালির প্রাণের আবেগ আজ
পুষ্পিত সৌরভ। বাংলার নগর বন্দর
গঞ্জ বাষট্টি হাজার গ্রাম
ধ্বংসস্তুপের থেকে সাতকোটি ফুল
হয়ে ফোটে।  


অক্ষরবৃত্ত ছন্দ পদ্যকাব্যের সসজ্জ, সলজ্জ অবগুণ্ঠনের প্রথাকে দূরে ঠেলে দিয়ে কাব্যসাহিত্যকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আর, ছন্দের বেড়াজাল ভাঙ্গার নিয়মনীতি এখান থেকেই উত্থিত হয়েছে।