মিরপুর-১ এর গোল চক্কর পার হওয়ার আগে,
পাশে বসা স্ত্রী ভারী গলায় বললেন,
''আড়ংয়ের সামনে গাড়ি থামাইওতো, পনির কিনবো''।
স্টিয়ারিং বাম দিকে ঘুরাতে ঘুরাতে জিজ্ঞেস করলাম,
''আজকাল কি কাপড়-চোপড়ের সাথে আড়ংয়ে পনিরও বেঁচে নাকি''?
নাক মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন,
''যা বলছি, তাই করো।
কোথায় কী বেচে, তা তোমাকে জানতে হবে না''।
একমাত্র স্ত্রীর বাধ্য স্বামী!
এবং বাধ্য ড্রাইভারের মতো গাড়ি থামালাম।

গাড়িতে একেলা বসে অপেক্ষা করছি,
আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখছি।
গলায় ঝুলানো টিনের প্যাটরায় পান-সিগারেটওয়ালা,
লাল-হলুদ কাগজের অদ্ভুত টুপি পরা ঘটি-চানাচুর বিক্রেতা,
ফূলানো বেলুন হাতে চটপটে বালক,
পা ছড়িয়ে বসে থাকা হাত প্রসারিত ভিক্ষুক,
রোদেপোড়া শিয়াল রঙা উস্কুখুস্কু চুলের
নাদুস-নুদুস চেহারার ফুল-বিক্রেতা কিশোরী,
সিটে বসা আরাম করে বিড়িফোকা রিক্সাওয়ালা,
সিএনজির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীল শার্টের ড্রাইভার,
ইত্যকার নানান কিসিমের মানুষ;
ভাবলেশহীনভাবে দেখে যাচ্ছি।


এমন সময় চোখে পড়ে রাস্তার পাশের ফুটপাতে,
আমার দৃষ্টি আটকিয়ে যায়।
'দেখিবা মাত্র প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য' টাইপের
একজন দীঘলদেহী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  
পরনে নির্মেঘ আকাশের মতো নীল শাড়ি,
কপালে চাঁদের মতো বড়ো লাল টিপ,
খোপায় জড়ানো বেলি ফুলের মালা,
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ
এবং হাতে সুন্দর করে সাজানো একটি ফুলের তোড়া।
বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটি কারো না কারোর জন্য অপেক্ষা করছে;
আমি ভীষণভাবে নস্টালজিক হয়ে গেলাম।


আমার স্মৃতিকাতর হওয়ার অনেক কারণ আছে,
এ ধরণের দৃশ্য আজকাল আর দেখা যায় না।
এটা গত শতাব্দীর দৃশ্য।  
সে সময়কালে ফুল হাতে রাস্তার পাশে
অপেক্ষারত এমন তরুণী প্রায়ই দেখা যেতো।
এভাবে শাড়ি পরে সেজেগুজে, ফুল হাতে
কারোর জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে
কোন তরুণীকে আজকাল আর দেখা যায় না।
এই আধুনিক যুগে,
মোবাইল আসার পরে,
এই দৃশ্যের মৃত্যু হয়েছে ।
এখন সবাই পদে পদে কল দিয়ে,
ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেখা করতে যায়;
তাদের কাঙ্খিত জায়গায়।
কথা হয়, গল্প হয়, মাস্তি হয়,
হাসি-তামাসা এবং মাঝে মাঝে ঝগড়াও হয়।
ঐ সময়ে প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝেও ঝগড়া হতো,
অভিমান হতো;
তবে, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেরি করে আসার জন্য।
আজকাল এটা নিয়ে তেমন ঝগড়া হয় না।
এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের ঝগড়ার বিষয়বস্তু আলাদা
এবং বড়ই অদ্ভুত।


কয়েকদিন আগে একটি ক্যাফেতে বসে আছি।
একটি যুগল তরুণ-তরুণী ঝগড়া করছে।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে তুমুল আওয়াজে সচকিত হয়ে যাই!
প্রেমিকার অভিযোগ-
''বল্, তুই কেন তানিয়ার ছবিতে 'লাভ' রিয়েক্ট দিয়েছিস'?
নষ্টামী করার আর জায়গা পাস না?
হারামজাদা, কয়জন জিএফ আছে তোর?
বল্...''?
সেই ছেলেটি স্থান-কাল-পাত্র ভুলে উচ্চস্বরেই রিপ্লাই দিলো-
''মুখ সামলে কথা বলিস, হারামজাদি!
তুই যে ফেসবুকে ফেইক আইডি খুলে
তন্ময় নামের একজনের সাথে প্রেম করস;
মনে করছোস, সেটা আমি জানি না?
সব জানি; আমার কাছে স্ক্রিনশট আছে...''  


এই " হারামজাদা-হারামজাদির" যুগে
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটি বেমানান।  
বেমানান বলেই মনে হয়, মেয়েটা বারবার ঘড়ি দেখছে।
এই যে ঘড়ি দেখার বিষয়টি, তাও কিন্তু এই সময়ের ঘটনা নয়,
এটা সে-ই সময়ের দৃশ্য।
এই সময়ের তরুণীরা অপেক্ষায় থেকে ঘড়ি দেখে না;
বরং, মোবাইল হাতে নিয়ে অনবরত ফোন করে,
টেক্সট পাঠায়,
যে আসছে তার জীবন ঝালাপালা করে ছাড়ে।
গভীর মনোযোগ দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি,
মেয়েটার গল্পটা কল্পনায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।


আমার গাল্পিক মন বলছে-
কিছুক্ষনের মধ্যেই
পাঞ্জাবি পরা একটি ছেলে এসে মেয়েটির সামনে দাঁড়াবে।
হয়তো আজ সেই ছেলেটির জন্মদিন।
এখান থেকে তারা হাঁটতে হাঁটতে
চলে যাবে চিড়িয়াখানায় অথবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
সেখানে কোনো বাদামওয়ালাকে দেখে
মেয়েটা ছেলেটাকে বলবে,
''এক ঠোঙা বাদাম কিনে দাও তো''।
ছেলেটা আশ্চর্য হয়ে বলবে,
''তুমি তো বাদাম খাও না।
আজ হঠাৎ বাদাম খেতে চাচ্ছো যে''?  
মেয়েটা প্রতিউত্তর দেবে,
''আমি খাবো না,
তোমাকে বাদাম ছিলে দেবো,
তুমি খাবে''।
ছেলেটা আশ্চর্যরকম বিস্ময়ে দুষ্টামি করে বলবে,
''বলো কী?  আমাকে ছিলে দিলে তো মরে যাবো''!
মেয়েটা হি হি  করে হাসতে হাসতে বলবে,
''হুমম,
শুধু ছিলেই দেবো না; ছিলে লবনও মাখিয়ে দিবো।
হি হি হি...''।
এবার ছেলেটা মরে যাওয়ার ভান করবে।
তবে, সেটা অবশ্য 'ছিলে লবন মাখিয়ে' দেবার জন্য না,
মেয়েটার অনাবিল হি হি হি ধ্বণীর হাসি শুনে।


যেই মুহূর্তে আমি পুরোপুরি গল্পের মাঝে ঢুকে গেছি;
সে-ই মুহূর্তে গাড়ির দরজা খুলে
ঢুকে পরলেন আমার স্ত্রী।
ঘর্মাক্ত মুখটি মুছতে মুছতে বললেন,
''চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।  
পনির খাবে''?
আমি তখনও গল্পের ভেতরে হাঁটছি;
গাড়িতো স্টার্ট দিতে দিতে অন্যমনস্কভাবে বললাম,
''হুম খাবো। ছিলে দাও''।
ম্যাডাম খেপে আগুন!
''পনির আবার ছিলে দেয় ক্যামনে?
কোন দুনিয়ায় থাকো তুমি''?
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মনে মনে বললাম,
'আর কোথায় থাকবো! গল্পের দুনিয়ায় আছি'।
তবে, জোরে জোরে বলার সাহস হলো না।  


আড়ং এর সামনে থেকে
চলে আসতে আসতে ভিউ মিররে আরেকবার মেয়েটিকে দেখলাম।  
সে এখনও অপেক্ষায় আছে।  
কতক্ষণ থাকবে, কে জানে?
আমার কল্পনার পাঞ্জাবী পরা ছেলেটার ভাগ্য নিশ্চয়ই ভালো।
তার কপালে এই সময়ের প্রেমিকা জোটে নাই,
কারণ, এই সময়ের প্রেমিকারা কারোর জন্য অপেক্ষা করে না।


১১/১১/২০২০
মিরপুর, ঢাকা।