ছন্দ শেখার জন্য প্রথমে অক্ষর ও মাত্রা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতেই হবে। এখন অক্ষর এবং মাত্রা কি? এ সম্পর্কে ধারণা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।


আমরা অনেক সময় বর্ণ এবং অক্ষরকে একই ভেবে গুলিয়ে ফেলি। আসলে তা এক নয়। বাংলা ভাষার ধ্বনিকে লিখিতরূপ দানের জন্য যে প্রতীক ব্যবহার করা হয়; তাকে বর্ণ বলে। যেমন- অ, আ, ই, ঈ...  এবং  ক, খ, গ, ঘ, ঙ... ।
অন্যদিকে, এক প্রয়াসে যে ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ একবারে উচ্চারিত হয় তাকে অক্ষর বলে। অর্থাৎ, কোনো শব্দের যতটুকু অংশ একটানে বা এক ঝোঁকে উচ্চারিত হয়; তাকে অক্ষর বলে। ছন্দবিজ্ঞানে অক্ষরকে কেউ কেউ 'দল' বলেন। আমি আলোচনার সুবিধার্থে সর্বদাই 'অক্ষর' ব্যবহার করবো। যেমন : আমরা। আমরা উচ্চারণের সময় কিভাবে করি? প্রথমে বলি, 'আম্'; তারপর, 'রা' । আপাত দৃষ্টিতে এখানে তিনটি বর্ণ (আ, ম এবং রা) থাকলেও, অক্ষর আছে দু'টি।
আমি = আ+মি (এখানে দু'টি অক্ষর আছে)। বন্ধন = বন্ + ধন্ (এখানে দু'টি অক্ষর আছে)।


অক্ষর দুধরণের-
(১) মুক্তাক্ষরঃ যে সমস্ত অক্ষর উচ্চারণকালে আটকে যায় না, ইচ্ছেমতো টেনে পড়া যায় প্রয়োজনে প্রলম্বিত করা যায়, তাকে মুক্তাক্ষর বলে। যেমন, না, কি, সু ....... । অর্থাৎ, স্বরান্ত অক্ষরগুলোই 'মুক্তাক্ষর'।
(২) বদ্ধাক্ষরঃ যে সমস্ত অক্ষর উচ্চারণ কালে আটকে যায়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে। যেমন, ধ্যান, হাত, ফুল .........। অর্থাৎ, ব্যাঞ্জনান্ত অক্ষরগুলোকে 'বদ্ধাক্ষর' বলা হয়। ছন্দবিজ্ঞানে অক্ষর মাত্র দু'টি- মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর। মূলতঃ এ দু'প্রকার অক্ষরের ব্যবহারই ছন্দের প্রতিপাদ্য মূল বিষয়।


এবার আসি, 'মাত্রা' প্রসঙ্গে।
মুক্তাক্ষরের শেষে সব সময় একটি স্বরচিহ্ন থাকবেই। এই কারণে মুক্তাক্ষরকে স্বরান্ত অক্ষর বলা হয়। বদ্ধাক্ষরের শেষে ব্যঞ্জন বর্ণ থাকবে। এক একটি অক্ষরকে উচ্চারণ করতে যতোটা সময় লাগে,  তাকে ঐ অক্ষরের মাত্রা বলে।


স্বরবৃত্ত ছন্দে উভয় প্রকার অক্ষরকে এক মাত্রা হিসাবে গণ্য করা হয়। স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি পর্ব (ব্যতিক্রম ছাড়া) সাধারণত ৪ মাত্রার হয়ে থাকে। উদাহরণ-


থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
- সংকল্প, কাজী নজরুল ইসলাম।


উপরের কবিতাটি স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা। আসুন, তা আমরা বিশ্লেষণ করি।
থাক+ব +না +কো / বদ+ধ +ঘ+রে, / দেখ+ব+এ+বার / জ+গৎ+টা+কে,
কে+মন+ক+রে /  ঘুর+ছে +মা+নুষ / যু+গান+ত+রের / ঘুর+ণি+পা+কে।


এখানে, প্রতি লাইনে চারটি করে পর্ব আছে। '/ ' (শ্লেস) চিহ্ন দিয়ে ভাগ করে দেখানো হলো। প্রতিটি পর্বে চারটি অক্ষর, অর্থাৎ, চার মাত্রা। কবিতা হচ্ছে আবৃত্তি করার একটি বিষয়। কবিতা আবৃত্তি করার বেলায় স্বাভাবিকভাবেই কোন কোন স্থানে উচ্চারণে কিছুটা বিরতি ঘটে, তাকে যতি বলে। আর, চরণের শুরু থেকে বা এক যতিচিহ্ন হতে পরবর্তী যতিচিহ্ন পর্যন্ত কাব্যাংশকে পূর্ণপর্ব বলে।


আমরা জানি, সব কবিতার চরণগুলো পূর্ণপর্ব বিশিষ্ট নয়। অধিকাংশ কবিতায় অপূর্ণপর্ব থাকে। নিচের কবিতাংশটি দিয়ে তা বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করবো। উদাহরণ-


অন্ধ মেয়ে / দেখছে না তা, / নাইবা যদি / দেখে,
শীতল মিঠা / বাদল হাওয়া / যায় যে তারে/ ডেকে।
- অন্ধ মেয়ে, সুকুমার রায়।


এখানে, 'দেখে' এবং 'ডেকে'  দুই মাত্রার শব্দ। পূর্ণপর্বের চেয়ে কম মাত্রার যে সকল শব্দ বা শব্দগুচ্ছ কবিতার চরণের শেষে বসে, তা অপূর্ণপর্ব। পর্বের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে, আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়; তা হলো অতিপর্ব। যা কবিতার চরণের প্রথমে বসে এবং তা পূর্ণ পর্বের চেয়ে কম মাত্রার। উদারহণ-


বাবুদের / তাল পুকুরে
হাবুদের / ডাল-কুকুরে
সে কি বাস / করলে তাড়া,
বলি থাম  /একটু দাঁড়া।
- লিচু চোর, কাজী নজরুল ইসলাম।


এখানে, 'বাবুদের', 'হাবুদের', 'সে কি বাস', এবং 'বলি থাম', ইত্যকার শব্দ বা শব্দগুচ্ছগুলো তিন মাত্রার; অর্থাৎ, পূর্ণমাত্রার চেয়ে কম মাত্রা; যা চরণের প্রথমে বসেছে। এগুলো হলো, অতিপর্ব। যাকে বলা যায়, কবিতায় চরণের অতিরিক্ত পর্ব।


আজ আমরা জানতে পারলাম, অক্ষর, মাত্রা, যতি, পর্ব (পূর্ণপর্ব, অপূর্ণপর্ব, অতিপর্ব)।


স্বরবৃত্ত ছন্দ মূলতঃ ছড়ার ছন্দ। আসুন, আমরা স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতা আবারও চর্চা করি।  ৪ থেকে অনুর্দ্ধ ৬ চরণের ছড়াটি মন্তব্যের ঘরে লিখি। বিষয়- উন্মুক্ত।